ব্রিটিশ সম্রাজ্য তখন বর্ধনশীল। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে ব্রিটিশ উপনিবেশ। এরই ধারাবাহিকতায় সেই তালিকায় নাম উঠলো দক্ষিন আফ্রিকার এই অংশেরও, ব্রিটিশদের সাথে হাত মিলিয়ে রুড কনকাশন নামে একটি চুক্তি করেন মাতাবেলেল্যান্ডের লবেঙ্গুলা খুমালো৷
আর এরপর গোটা মাতাবেলেল্যান্ড চলে যায় চার্লস রুড, জেমস ম্যাগুয়ের আর ফ্রান্সিস থম্পসন নামে তিন ব্রিটিশের কাছে আর এই বিশাল চুক্তির পেছনে কলকাঠি নেড়েছিল এক ব্যবসায়ী, নাম সিসিল রোডস। আর এই সিসিল রোডসের নামেই ১৮৯৩ সালে এই উপনিবেশের নাম হয় ‘রোডেশিয়া’।
১৮৯০ সালের ১৬ আগস্ট ( মতান্তরে ১২ আগস্ট) ফোর্ট ভিক্টোরিয়াতে প্রথম বারের মতো প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটের আয়োজন করা হয়৷ আর সেই খেলায় অংশ গ্রহণ করে সালিসবুরি আর বুলাওয়ে। যে শহরটাকে ‘হারারে’ নামে চিনি সেই শহরটাই হচ্ছে সেই সময়ের রোডেশিয়ার রাজধানী সালিসবুরি৷
আর সেই ম্যাচেই গঠিত হয় রোডেশিয়া ক্রিকেট দল। ১৮৯১ সালে সালিসবুরিতে প্রথম তৈরী হয় ক্রিকেট ক্লাব এবং এর তিন বছর পর একইভাবে বুলাওয়েও একই পথ অনুসরণ করে। ১৮৯৫ সালে বুলাওয়ে সফরে যায় সালিসবুরি আর সেদিনই রোডেশিয়ার ইতিহাসে প্রথম আন্তঃপ্রাদেশিক ক্রিকেট অনুষ্ঠিত হয়৷
হারারে স্পোর্টস ক্লাব আর এর স্টেডিয়াম আমরা সবাই চিনি, কিন্তু এর ইতিহাস আমরা অনেকেই জানিনা। ১৮৯৭ সালে সালিসবুরি ক্রিকেট দলকে অফিশিয়ালি রুপান্তর দেয়া হয় আর নাম রাখা হয় ‘সালিসবুরি স্পোর্টস ক্লাব’। ক্লাবটি এখনো রয়েছে কিন্তু এর জৌলুস নেই আর। নাম পরিবর্তন হয়ে এখন হারারে স্পোর্টস ক্লাব।
লর্ড হক ছিলেন একজন অভিজ্ঞ ব্রিটিশ ক্রিকেটার, বেশকিছু ম্যাচে তিনি ব্রিটিশদের অধিনায়কত্ব করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকান উপনিবেশে একজন পাগলাটে ক্রিকেট ভক্ত আবার রাজনীতিবিদ ছিলেন যার নাম ছিল জেমস লোগান। তিনি লর্ড হককে অনুরোধ করেন রোডেশিয়ায় খেলতে আসেন যেন।
১৮৯৮-৯৯ সালে লর্ড হকের নেতৃত্তে একটি দল বুলাওয়েতে আসে দুই ম্যাচের সিরিজ খেলতে আর এটিই কোনো ব্রিটিশ দলের রোডেশিয়া সফর। এরপর ১৯০৩ থেকে শুরু হয় ‘লোগান কাপ’ যা এখন পর্যন্ত চলমান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব সময় থেকে রোডেশিয়া ক্রিকেট নিয়ে সচেতন হয় এবং বেশ কিছু প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট খেলে তারা। ১৯৩১-৩২ মৌসুমে জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত কুরি কাপে প্রথম বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় তারা কিন্তু বিপক্ষ ট্রান্সভালের কূট-কৌশলের কারণে রোডেশিয়া তাঁদের চ্যাম্পিয়নের খেতাব পায়নি।
চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কুরি কাপও বন্ধ। কিন্তু থেমে থাকেনি সেই রোডেশিয়ানরা। তখন পর্যন্ত রোডেশিয়াতে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট শুরু না হলেও, সেদেশ থেকে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে আফ্রিকার হয়ে টেস্ট খেলেন ডেনিস টমলিনসন।
জিম্বাবুয়ের সর্বকালের সেরা ক্যাপ্টেন বলা হয় ডেভিড লুইসকে। ১৯৫৩-৬৪ পর্যন্ত রোডেশিয়া দলের অধিনায়কত্ব করেন তিনি। তার অধীনে সেই সময় খেলেছিলেন আফ্রিকান লেজেন্ড পার্সি ম্যানসেল, গডফ্রি লরেন্স, জো প্যাট্রিজ।
তবে, রোডেশিয়া এক ব্যক্তির হাতে লাইমলাইটে আসে সে হলো আফ্রিকান গ্রেট ফিল্ডার কলিন ব্ল্যান্ড। যার ফিল্ডিং নাড়িয়ে দিতো বিপক্ষ দলকে। আর তার হাত ধরেই শুরু হয় আফ্রিকার বিখ্যাত ফিল্ডিং লিগ্যাসি। জন্টি রোডস, ল্যান্স ক্লুজনার, হার্শেল গিবস থেকে শুরু করে এবিডি ভিলিয়ার্স বা জেপিরা এখনো সেই লিগ্যাসি ধরে রেখেছে। আর এই কারণেই আফ্রিকার সর্বকালের সেরা ফিল্ডার কলিন ব্ল্যান্ডকে।
সত্তরের দশকের রোডেশিয়া দলে ছিল মাইক প্রোক্টরের মতো অলরাউন্ডার সাথে ছিল জ্যাকি দু প্রিজ, ব্রায়ান ডেভিসন, জন ট্রাইকোস, ডানকান ফ্লেচারের মতো খেলোয়াড়রা। বলা হয় সেই সময়ের দলটা রোডেশিয়ার সর্বকালের সেরা দল, শুধু রোডেশিয়া না এই দলটাকে বলা হয় সেই সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালি দল। কিন্তু এই শক্তিশালী দল নিয়েও গোটা সত্তরের দশকে কুরি কাপ ঘরে তুলতে পারেনাই রোডেশিয়া।
১৯৭৯-৮০ সালে ইয়ান স্মিথের থেকে প্রেসিডেন্ট পদটি নেন এবেল মুজোরেওয়া আর এরপর শুরু হয় রোডেশিয়ার স্বাধীনতা প্রক্রিয়া৷ সে মৌসুমে শেষবারের মতো কুরি কাপে অংশ নেয় রোডেশিয়া, কেতাবি নাম ছিলো জিম্বাবুয়ে-রোডেশিয়া। ১৯৮০ সালে স্বাধীনতার পর রোডেশিয়া রুপান্তরিত হয় জিম্বাবুয়েতে। আর এরফলে আফ্রিকার অন্তর্ভুক্ত অবস্থায় ভোগ করা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে মুক্তি পায় তারা৷
লিস্টারশায়ার আর মিডলসেক্স দুইটা পূর্ণশক্তির দল পাঠায় জিম্বাবুয়েতে প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলার জন্য। ১৯৮১ সালে ২১ জুলাই আইসিসির সহযোগী সদস্যপদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় জিম্বাবুয়ে। ফলাফল স্বরুপ ১৯৮৩ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পায় জিম্বাবুয়ে।
আর প্রথম বারেই অস্ট্রেলিয়াকে বিধ্বস্ত করে, নিজেদের জানান দেয় জিম্বাবুয়ে। এরপর শ্বেতাঙ্গদের প্রবেশ আর বর্ণবাদ নিয়ে স্থিমিত হয়ে পরে তাদের অগ্রযাত্রা। ১৯৮৩-৯২ পর্যন্ত তিনটি বিশ্বকাপে খেলেও সাফল্য না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে আইসিসির সহকারি দেশগুলোর সাথে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলতে হয় তাদের। সেখানে সবগুলো ম্যাচ খেলে নিজেদের স্রোতে ফিরে আসেন তারা।
সেই দলে ছিলেন জন ট্রাইকোস, যিনি প্রোক্টরের দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ছিলেন। সত্তরের দশকে মাঠ কাঁপিয়েছেন আফ্রিকার জার্সি পরে আর নব্বইয়ের দশকে মাঠ মাতিয়েছেন জিম্বাবুয়ের হয়ে।
নির্বাসন কাটিয়ে ক্রিকেটে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো দক্ষিন আফ্রিকা। আর এইদিকে জিম্বাবুয়ে দারুন এক দল নিয়ে মাঠে আছে। পাইক্রফট, হটনরা ছিলেন ফর্মের তুঙ্গে সাথে অভিষিক্ত হয়েছে ফ্লাওয়ার ভাইদ্বয়। এই সময় টেস্ট স্ট্যাটাস না পেলে খেলোয়াড়দের দক্ষিন আফ্রিকার কাছে হারানোর সেই সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছিলো।
১৯৯২ সালে জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেট ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট অলউইন পিচানিক আর ডেভ এলমানব্রাউবের দীর্ঘতদবীরের পর টেস্ট স্ট্যাটাস পায় জিম্বাবুয়ে । অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস। সেই বছরের ১৮ অক্টোবর হারারে স্পোর্টস গ্রাউন্ডে ভারতের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম টেস্ট খেলতে নামে জিম্বাবুয়ে ।
আর সেই ম্যাচেই বিশ্বকে চমকে দিয়ে ভারতের সামনে ৪৫৬ রানের বিশাল রান দাঁড় করায় তারা। ফলাফলে ভারতকে ফলো-অনে বাধ্য করে জিম্বাবুয়ে । কিন্তু সেই ম্যাচ ড্রতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় জিম্বাবুয়ের।
১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে তাদের এগারোতম ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে টসে জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে রীতিমতো তাণ্ডব চালায় জিম্বাবুইয়ান ব্যাটসম্যানরা। গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ারের ‘মহাকাব্যিক’ ২০১*, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের ১৫৬, গাই হুইটালের অপরাজিত ১১৩ রানের সুবাদে ৫৪৪ রান দাঁড় করায় জিম্বাবুয়ে।
পরে হিথ স্ট্রিকের বোলিং তোপে সেই ম্যাচ হারতে হয় পাকিস্তানকে। আর এই ম্যাচের পরেই জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের সোনালী প্রজন্মের। ফ্লাওয়ার ভ্রাতৃদ্বয়, মারে গুডউইন, অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল, পল স্ট্র্যাং, নীল জনসন, অ্যান্ডি ব্লিগনট, হিথ স্ট্রিক, সঙ্গে হেনরি ওলোঙ্গা – উজ্জ্বলতম ভবিষ্যতের স্বপ্নই দেখতে শুরু করেছিলো জিম্বাবুয়ে।
তবে, এর সব কিছুই এখন অতীত। প্রশাসনিক অদক্ষতা আর রাজনৈতিক প্রভাবে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের পর থেকে তিলে তিলে শেষ হয়ে গেছে। সোনালী প্রজন্মের বিদায়ের পর নতুন প্রতিভা আসাও এক অর্থে বন্ধ। এক সময়ের সেই পরাক্রমশালী জিম্বাবুয়ে দল এখন কেবলই এক অনন্ত হতাশার অপর নাম।