More

Social Media

Light
Dark

ইয়াসিন আরাফাত, দ্য ব্ল্যাক ডায়মন্ড

মৌসুম শুরুর টুর্নামেন্ট ফেডারেশন কাপের ফাইনালে ওঠে সবাইকে চমকে দিয়েছিল সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেডে। দলটির অধিনায়ক জামাল ভুইয়া ধারে সে সময় কলকাতা মোহামেডানের হয়ে খেলেছিলেন। দেশের গন্ডি পেরিয়ে সাদা-কালো দলটির হয়ে খেলেছেন ভারতের আই লিগে। কলকাতা মোহামেডানের হয়ে আলো ছড়িয়েছেন বাংলাদেশের ফুটবলের পোষ্টার বয় হিসেবে খ্যাত এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার।

তাঁর পারফরম্যান্সে খুশি কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির টিম ম্যানেজমেন্ট। অথচ মাঠে একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে সেভাবে খুজে পাওয়া যায়না। অদৃশ্য উপস্থিতিই মাঠের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়ায়। কখনো কখনো এটিই হয়ে দাড়ায় অনেক বেশি কাজের। কলকাতায় সেটিই করেছেন ডেনমার্কে জন্ম নেওয়া জামাল ভূঁইয়া। বাংলাদেশের ফুটবলের মানকে আরও উচুঁতে তুলে ধরছেন।

কয়েকটা ম্যাচ শেষ হওয়ার পর দায়িত্ব পাওয়া কোচ শঙ্করলাল চক্রবর্তীও খুশি বাংলাদেশি অধিনায়ক পারম্যান্সে। শুধু কি তাই অধিনায়ক নাইজেরিয়ান ওবুনেমে কিংসেলেও প্রশংসায় ভাসিয়েছেন জামালকে। দলের খেলোয়াড়দের দারুণ বোঝাপড়ার ফল হিসেবে ৭ বছর পর আই লিগের সুপার সিক্সে উঠেছে কলকাতা মোহামেডান। তবে নিজ ক্লাব প্রথমবার ফেডারেশন কাপের ফাইনালে ওঠলেও কলকাতায় থাকায় খেলতে পারেননি জামাল। ফাইনালের আগেরদিন ভারত থেকে পুরো দলকে শুভকামনা জানিয়েছিলেন।

ads

তখনি ডিফেন্ডার ইয়াসিন আরাফাতকে সাহস যুগিয়ে বলেছিলেন, তোমরা কোন চিন্তা করো না, আমাদের দলে ব্ল্যাক ডায়মন্ড আছেনা! সাইফ এসসিতে সতীর্থরা তাকে এ নামেই ডেকে থাকে। যারা খুব কাছ থেকে নারায়নগঞ্জের এই ফুটবলারকে চেনে তারা জানেন, বয়স কম হলেও গায়ে গতরে বড় হয়ে ওঠার পর দারুণ এক খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছেন ইয়াসিন আরাফাত। আর গতকাল তো ভারতের বিপক্ষে অতীব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোল করে জয়ের সমান ড্র নিয়ে মাঠে দলকে গোল উপহার দিয়েছেন।

তাঁর গোলে ম্যাচটা ড্র নয়, ভারতের খেলোয়াড়দের দেখে মনে হয়েছে তারা হেরে গেছে। আসলেই তো তাই, কারণ ১০ জনের বাংলাদেশ দল ১-০ গোলে পিছিয়ে পড়ে ম্যাচটা ড্র করতে পারাটা ভারতের জন্য তো হতাশারই। সেখানে ত্রাতার ভুমিকায় বাংলাদেশের ভবিষ্যত তারকা এই ইয়াসিন। ম্যাচের আগে যে ধারনা করা হয়েছিল সেটাই হয়েছে। সুনীল ছেত্রীকে হস্তারক হিসেবে দেখার কারণটা ম্যাচের শুরু থেকেই প্রমাণিত হয়েছে।

ভারতের বিপক্ষে আলোচিত ম্যাচটা ড্র করায় এখন বেঁচে রইল বাংলাদেশের ফাইনালে খেলার আশা। ভারতের বিপক্ষে ইয়াসিন আরাফাতের লাল-সবুজ জার্সিতে এটি দ্বিতীয় গোল। ২০১৯ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৮ সাফ চ্যাম্পিয়নশীপের ফাইনালে তার প্রথম গোল ছিল প্রতিবেশী দেশটির বিপক্ষে। আর কাল মালেতে আবারো তার বল জালে পাঠানোর দারুণ কৃতিত্ব।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, দুই ক্ষেত্রেই ইয়াসিনের গোল দল পিছিয়ে পড়ার পর। বয়সভিত্তিক সাফে অবশ্য গোল করার পর জার্সি খুলে অতিমাত্রায় উল্লাস করতে গিয়ে লাল কার্ড দেখেন। এরপর বাংলাদেশ দল ১-২ গোলে হেরে যায়। পরাজয়ের দায়টা এই ফুটবলারটির উপরই গিয়ে পড়েছিল, কারণ ইয়াসিন মাঠ থেকে বহিষ্কার না হলে ম্যাচটা জিতে যেত পারত বাংলাদেশ। তিন বছর আগে যেখানে নিজে দলকে ১০ জনের দলে পরিণত করেছিলেন আর এবার ১০ জনের দলকে গোল করে নিজে টেনে তুললেন।

খাঁদের কিনারে থাকা লাল সবুজ দলের হিরো যেমন ইয়াসিন তেমনি ম্যাচ সেরার পুরস্কারও জিতেছেন। প্রয়োজনীয় সময়েল গোলের জন্য আরাফাত ধন্যবাদ দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তাকে। অথচ জাতীয় দলে তার জায়গাটা পোক্ত ছিলনা। অস্কার ব্রুজোন কোচ হওয়ার পর টানা দুই ম্যাচেই প্রথম একাদশে জায়গা পেয়েছেন।

কোচের আস্থার প্রতিদান দারুণভাবেই দিয়েছেন ইয়াসিন আরাফাত। বয়সভিত্তিক বিভিন্ন দলের গন্ডি পেরিয়ে এখন জাতীয় দলের অন্যতম ভরসা হয়েছেন এই তরুন। বাংলাদেশের ফুটবলে তার নামের পাশে ২ লাখ ডলার রিলিজ ক্লজের কথাটি প্রথমবার লেখা হয়েছিল। তাঁর প্রতিভা দেখে সাইফ স্পোর্টিং তিন বছর আগে তার রিলিজ ক্লজ রেখেছিল ২ লাখ ডলার। বিষয়টি এমন দাড়ায় যে, কোন দল তাঁকে কিনতে চাইলে সাইফকে সমপরিমান অর্থ পরিশোধ করতে হতো। যদিও এখন আর ওই ‘শর্ত’ না থাকার কারণে তার বসুন্ধরা কিংসে যোগ দেওয়ার জোর গুঞ্জন রয়েছে।

১০ জন নিয়ে যখন হারের শঙ্কায় পেয়ে বসেছিল বাংলাদেশকে, ঠিক সেই সময়েই ত্রাতা হয়ে আবির্ভূত এই তরুণ। মাঠের খেলা থেকেই বোঝা যায়, ইয়াসিন এখন আগের চেয়ে অনেক ধারালো। ঘরোয়া ফুটবলে প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রমাণ করে চলেছেন। বয়সভিত্তিক ফুটবল থেকেই নিজের প্রতিভার জানান দিয়েছেন ইয়াসিন। ২০১৯ সালে জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার আগে বয়সভিত্তিক দলগুলোর নিয়মিত আর পরিচিত মুখ এই ডিফেন্ডার।

২০১৭ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে তাঁর নেতৃত্বেই কাতারকে হারিয়ে চারিদিকে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল বাংলাদেশ। কিশোর সাফে তার গোলও আছে একটি। অনূর্ধ্ব-১৮ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ও অনূর্ধ্ব-১৯ এএফসি চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্ব মিলিয়ে গোল আরও ৩টি গোল করে ভবিষ্যতের তপু বর্মন হিসেবেও নিজেকে প্রমাণ করে চলেছেন।

এর আগে লাল সবুজের প্রায় প্রতিটা বয়সভিত্তিক দলের জার্সিই উঠেছে তাঁর গায়ে। এবার যেমন সাফ শেষেই যোগ দিতে হবে অনুর্ধ্ব-২৩ জাতীয় দলে। ২০১৫ সালে অনূর্ধ্ব-১২ ও ২০১৬ সালে অনূর্ধ্ব-১৪ দলের সদস্য হিসেবে মালয়েশিয়ায় মক কাপ জেতার দারুণ সুখস্মৃতি রয়েছে ইয়াসিনের।

২০১৯ সালে সর্বশেষ আয়োজিত শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপের উদ্বোধনী ম্যাচে মালদ্বীপ চ্যাম্পিয়ন টিসি স্পোর্টস ক্লাবের বিপক্ষে চট্টগ্রাম আবাহনীর হয়ে তাঁর গোলটি এখনো চোখে লেগে আছে ফুটবলপ্রেমীদের। বাঁ প্রান্ত থেকে নেওয়া তাঁর দুর্দান্ত ক্রস মালদ্বীপ গোলরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে জড়িয়ে যায় জালে। ২০১৮ সাল থেকে সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবে খেলছেন ইয়াসিন।

সে বছরই ২ লাখ ডলারের রিলিজ ক্লজে তাঁর সঙ্গে ৩ বছরের চুক্তি করে ক্লাবটি। বাংলাদেশের ফুটবলে রিলিজ ক্লজের ধারণাটি সেবারই প্রথমবার মানুষ জানতে পারে। সর্বশেষ তিন মৌসুম খেলে সাইফ এসসির হয়ে প্রিমিয়ার লিগের ৫২ ম্যাচে ৪ গোল করেছেন। ফেডারেশন কাপের ৯ ম্যাচেও আছে তাঁর ৩ গোল। এই বছর অবশ্য সাইফ ছেড়ে তাঁর বসুন্ধরা কিংসে যোগ দেওয়াটা একরকম নিশ্চিতই।

এদিকে ভারতের বিপক্ষে অতি প্রয়োজনীয় সময়ে তার গোল বাংরাদেশকে যেমন বাচিঁয়েছে ঠিক তেমনি দলকে দিয়েছে স্বস্থির পরশ। গােলের পর উচ্ছ্বসিত কন্ঠে ইয়াসিন বলেন, ‘ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে গোল করতে পারায় প্রথমে মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। এরপর কোচ ও দলের সকল খেলোয়াড়দের ধন্যবাদ। সবার সহযোগিতায় আমি গোলটি করতে পেরেছি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link