More

Social Media

Light
Dark

বাংলাদেশের উজ্জীবিত চমক

বিশ্বকাপের দল ঘোষণার আগে থেকেই আমরা নিশ্চিত ছিলাম নুরুল হাসান সোহান দলে থাকছেন। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচেই তাঁকে উইকেটের পিছনে দেখা যাবে এটাও মোটামুটি নিশ্চিত। এছাড়া শেষের দিকে দ্রুত কিছু রান করে দেয়ার জন্য ভাবা হচ্ছে সোহানকে। সবমিলিয়ে সোহান এখন দলের অটোম্যাটিক চয়েজ। তবে মাস কয়েক আগেও চিত্রটা ঠিক এমন ছিল কী?

একটু পিছনে ফিরে তাকানো যাক। বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সোহানের অভিষেক হয়েছিল আরো বছর পাঁচেক আগে। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ২০১৬ সালে বেশ আশা জাগানিয়া এক শুরুই করেছিলেন। অভিষেক ওয়ানডে ম্যাচে তাঁকে ব্যাট করতে নামানো হয় আট নম্বর পজিশনে। ক্রাইস্টচার্চের বিরুদ্ধ কন্ডিশনে দেশের সেরা ব্যাটসম্যানরাও যেখানে হিমসিম খাচ্ছিলেন সেখানে ২২ বছরের টগবগে এক তরুণকে ভীষণ আত্মবিশ্বাসি মনে হচ্ছিল। ওই পজিশনে নেমে খুব বেশি কিছু করার ছিল না তবুও ২৪ রানের লড়াকু এক ইনিংস খেলেছিলেন।

পরের ম্যাচে সোহান আরো অপ্রতিরোদ্ধ। শেষ দিকে তাঁর ৩৯ বলে ৪৪ রানের ইনিংসে ২৩৬ রান করতে পেরেছিল বাংলাদেশ। নিজের প্রথম দুই ম্যাচেই ক্রাইস্টচার্চে এমন পারফরম্যান্স করার পরেও সোহানের আর কখনো দলে জায়গা হয়নি। মূলত সেই সিরিজে মুশফিকের প্রক্সি দেয়ার জন্যই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁকে। মুশফিক আবার ফিরে এলে আট নম্বরে নেমে অমন ইনিংস খেলা ছেলেটাকে আর কখনো মনেও করিনি আমরা।

ads

এরপর প্রায় পাঁচ বছর আর তাঁর কোন খোঁজ রাখা হয়নি। হারিয়ে যাবার সব পথই সোহানের জন্য খোলা ছিল। সেই সময় তাঁকে নিয়ে সবচেয়ে বড় আপত্তির জায়গা ছিল অফ সাইডের দুর্বলতা। এটা অবশ্যই সত্যি যে অফ সাইডে এতটা দুর্বলতা নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বড় দলগুলোর বিপক্ষে রান করা কঠিন। সোহানও নিজের দুর্বলতার জায়গাটা ধরতে পেরেছিলেন। স্থানীয় কোচ মিজানুর রহমান বাবুলের সাথে নিজের ব্যাটিং নিয়ে কাজ করেছেন। বিশেষ করে অফ সাইডে উন্নতির জন্য কাজ করেছেন।

ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রায়ই তাঁর পরিশ্রমের প্রমাণ পাওয়া যেত। আস্তে আস্তে অফ সাইডে তাঁর শট খেলার সক্ষমতা বাড়ছিল। তবে সেটা বোধহয় যথেষ্ট ছিল না আবার জাতীয় দলে ফিরে আসার জন্য। তবে এইবছর ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে এক অন্য সোহানকে দেখা গেল।

তাঁর পরিশ্রমের ফল এবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও মিলতে শুরু করলো। জিম্বাবুয়ে, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে নিজের দায়িত্বটা বেশ ভালো ভাবে পালন করেছেন সোহান। তিনি যেখানে ব্যাট করতে নামেন সেখান থেকে নিয়মিত বড় ইনিংস খেলা সম্ভব না। তবে মোটামুটি প্রতি ম্যাচেই দ্রুত কিছু রান এনে দিতে পেরেছেন। মাঝেমাঝে দলকে নিয়ে গিয়েছেন জয়ের বন্দরে। বাংলার ক্রিকেটে একজন ফিনিশারের যে আক্ষেপ ছিল সেটা বুঝি এবার সোহানই মেটাবেন।

অফ সাইডে সোহানের যে দুর্বলতা ছিল সেটা যে একেবারে কেটে গিয়েছে তা বলছিনা। এখনো অফ সাইডের অনেক বল টেনে লেগে খেলতে চান। এটা আসলে তাঁর দুর্বলতা বলার চেয়ে স্বভাবসূলব ব্যাটিং বলাই ভালো। প্রতিটা ব্যাটসম্যানেরই প্রিয় কিছু স্কোরিং জোন থাকে। যেখান থেকে রান বের করতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

সবমিলিয়ে এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে সোহানকে। ছয়-সাত নম্বরে ব্যাট করতে নেমেই হাত চালাতে হবে। তাঁর থেকে প্রতি ম্যাচেই দ্রুত কিছু রান আশা করবে দল। তিনি তাঁর কাজটা ঠিকঠাক করতে পারলে বাংলাদেশের বড় সংগ্রহ পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। সবমিলিয়ে দেশের ক্রিকেটে একজন স্লগারের যে অভাব সেটা পূরণ করার গুরুদায়িত্ব সোহানের উপরে।

ওদিকে সোহান যে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সেরা উইকেটরক্ষক তা কোন রকম বিতর্ক ছাড়াই সবাই মেনে নিবেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাঁর কিপিংটা বাংলাদেশের জন্য বড় শক্তির জায়গা হয়ে উঠেছে। তাঁর দারুণ একটা ক্যাচ, একটা স্ট্যাম্পিং কিংবা একটা রান আউট ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। মাঠে তাঁর এমন কীর্তিতে পুরো দল আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এইসব ছোট ছোট বিষয় গুলোকে মোটেই অবহেলা করার সুযোগ নেই। এখানে শুধু ব্যাটিং বা বোলিং করেই ম্যাচ জেতানো যায় এমন নয়। ফলে উইকেটের পিছনে সোহান এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বড় শক্তির জায়গা।

সোহানকে বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তরা ইতোমধ্যেই ‘মোটিভেশনাল স্পিকার’ হিসেবে রায় দিয়ে ফেলেছেন। মোটিভেশনাল স্পিকার না হলেও মাঠে তাঁর কথাবার্তা যে দলের বাকি ক্রিকেটারদের উদ্বুদ্ধ করে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এছাড়া উইকেটের পিছন থেকে পুরো মাঠটা খুব ভালো ভাবেই দেখতে পান তিনি। ফলে ফিল্ডারদের পজিশন নিয়েও সারাক্ষণ কথা বলতে থাকেন। এতে অধিনায়কের কাজও অনেকটা সহজ হয়ে যায় অবশ্যই।

এছাড়া ফিল্ডিং মিস হলে ফিল্ডারদের শাসিয়ে যাচ্ছেন। সেই ফিল্ডার সোহানের বন্ধু মেহেদীই হোক কিংবা বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানই হোক। একটা রানও বাড়তি দেয়া যাবেনা এটাই তাঁর একমাত্র কথা। সোহানের কাছে সামনে কে বা কোন দল এগুলো কিছু যায় আসেনা। সোহান শুধু বোঝেন একটা রানের মূল্য, একটা উইকেটের মূল্য। সোহান আসলে ক্রিকেটটা বোঝেন।

সোহান এগিয়ে আরেকটি বিশেষ জায়গায়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যেটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো মানসিকভাবে অনেক শক্ত হওয়া, মাথা ঠাণ্ডা রাখা। এছাড় মাঠে তিনি যে একটা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খেলেন সেটি বাংলাদেশের খুব কম ক্রিকেটারের মধ্যেই দেখা যায়। তাঁর সহজাত নেতৃত্বগুণও তাঁকে আলাদা করে।

সবমিলিয়ে ফিনিশার সোহান বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বড় ভরসার জায়গা। তিনি বাইশ গজে থাকা মানে বড় ম্যাচের চাপ সামলে ম্যাচ বের করে আনার একটা বিশ্বাস অতিবাহিত হওয়া। উইকেটের পিছনে সোহান থাকা মানে একটা আস্থা। সোহান থাকা মানে পুরো দল উজ্জীবিত থাকা। সোহান মানে প্রতিটা রানের জন্য লড়াই করা, সোহান মানে প্রতিপক্ষকে একচুলও ছাড় না দেয়া যোদ্ধা।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link