More

Social Media

Light
Dark

ভরসার মেঘ বরষা

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসার আগেই তাঁকে ভাবা হচ্ছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সাকিব আল হাসান। তাই হয়তো দল তাঁকে নিয়ে একটু বাড়তি সতর্কই ছিল। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নামার আগে পুরোপুরি প্রস্তুত করা হচ্ছিল আফিফকে। তাই অনেকদিন ধরে জাতীয় দলের পরিকল্পনাতে থাকলেও নিয়মিত ম্যাচ খেলার সুযোগ হচ্ছিল না।

তবে এবছরের শুরুতে নিউজিল্যান্ড সফর থেকেই টি-টোয়েন্টি দলের নিয়মিত মুখ আফিফ। শুধু নিয়মিত বললে ভুল হবে। বিশেষ করে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে নিজেকে দলের সবচেয়ে কার্যকর ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রমাণ করেছেন। ফলে বিশ্বকাপে বাংলাদশের ব্যাটিং লাইন আপের সবচেয়ে বড় ভরসার নাম আফিফ হোসেন ধ্রুব।

তিনি বিশ্বকাপ দলে কীভাবে জায়গা পেলেন সেটা নিয়ে এখনো নিশ্চই কারো মনে প্রশ্ন থাকার কথা না। তবে তাঁকে বিশ্বকাপে কীভাবে ব্যাবহার করা হবে কিংবা তাঁকে কী বিশ্বকাপের আগে পুরোপুরি প্রস্তুত হবার সুযোগ দেয়া হলো কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে আমাদের। আফিফের পুরো সার্ভিস আমরা পাচ্ছি কিংবা নিচ্ছি কিনা প্রশ্ন আছে সেটি নিয়েও।

ads

আফিফ ধারাবাহিক ভাবে রান করে গেলেও আমরা বোধহয় তাঁকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছিনা। তাঁকে যেখানে নামানো হচ্ছে সেখানে নেমেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে স্লগ করতে হয়। কিন্তু আফিফ কী কখনোই স্লগার ছিলেন? নাকি মাঠের পুরো ব্যবহার করে সিঙ্গেল ও ডাবল বের করে স্কোর বোর্ড সচল রাখা এবং ইনিংস বিল্ড আপ করাই আফিফের বিশেষত্ব? ছয়-সাত নম্বরে ব্যাট করতে নেমে কী সেটা আদো সম্ভব। ওদিকে বোলার আফিফকেই বা কী আমরা ব্যবহার করতে পারছি। ক্রিকেট পাড়ায় তাঁকে ভবিষ্যতের সাকিব নিশ্চই সাধে ডাকা হয় না।

প্রথমে আফিফ কেমন ব্যাটসম্যান সেদিকে একটু নজর দেয়া যাক। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ দুইটা টি-টোয়েন্টি সিরিজে আফিফ কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন সেটা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। মিরপুরের যেই উইকেট নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা, যেখানে প্রতিটা রানের জন্য দুই দলের সেরা ব্যাটসম্যানদের রীতিমত লড়াই করতে হচ্ছে সেখানেও আফিফ সুন্দর ও সাবলীল।

আফিফের এই সাফল্যের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে তিনি বাড়তি কিছু করতে চাননি। নিজের স্বাভাবিক ব্যাটিংটাই করেছেন। আর এই ধরনের পিচে আপনি চাইলেও খুব বেশি কিছু করতে পারবেননা। সাকিব আল হাসানের মত ক্রিকেটারও বলছেন এই পিচে ১০-১৫ টা ম্যাচ খেললে একজন ব্যাটসম্যানের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে।

তবে এই পিচেই শেষ দশ ম্যাচে আফিফের ব্যাটিং দেখে তা বোঝার উপায় নেই। আফিফ মূলত বিজি ক্রিকেটার। তিনি পুরো মাঠ ব্যবহার করতে পারেন। মাঠের চারপাশে কোথায় কতটুকু গ্যাপ আছে সেগুলো ভালো করে লক্ষ্য করেন এবং ব্যবহার করেন। মিরপুরে যেমন তিনি সিঙ্গেল কিংবা ডাবলের দিকে বেশি নজর দিয়েছেন। গ্যাপে কিংবা সফট হ্যান্ডে খেলে দুই-তিন রান বের করেছেন। জোর করে বাউন্ডারি মারতে চাননি। এটাই আফিফের স্বভাবসুলভ ব্যাটিং।

এখানে আমরা একটা জিনিস গুলিয়ে ফেলি। ঘরোয়া ক্রিকেটে কিংবা শেষ দুইটা সিরিজেও আফিফের স্ট্রাইকরেট বেশ প্রশংসনীয়। মিরপুরে অন্য ব্যাটসম্যানরা যেখানে ৮০-৯০ স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করেছে সেখানে আফিফ গড়ে প্রায় ১২৫-১৩০ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করেছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটেও অন্য ব্যাটসম্যানদের তুলনায় তিনি স্ট্রাইকরেটে অনেক এগিয়ে থাকেন।

আফিফের এই স্ট্রাইক রেটে এগিয়ে থাকার মূল কারণ আমাদের বোঝা জুরুরি। বাংলাদেশের অন্য ব্যাটসম্যানরা স্ট্রাইকরেটে পিছিয়ে যান মূলত ডট বলের কারণে। আমাদের ব্যাটসম্যানরা অনেক বেশি ডট বল খেলে ফেলেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে যা রীতিমত অপরাধ।

১২০ বলের ম্যাচে যদি ৩০-৪০ বল ডট হয়ে যায় তখন বড় রান করা আর সম্ভব হয়না। তখন ব্যাটসম্যানদের বাউন্ডারির প্রতি ঝুকতে হয়। বাড়তি রিস্ক নিতে হয়। ওদিকে আমাদের ব্যাটসম্যানদের কেউই তেমন পাওয়ার হিটার না যে জায়গায় দাঁড়িয়ে চার-ছয় মারবেন। ফলে ব্যাটসম্যান ও দল চাপে পড়ে যায়।

ওদিকে আফিফ নিয়মিত স্ট্রাইক রোটেট করতে থাকেন। ফলে স্কোরবোর্ড সচল থাকে। উল্টো প্রতিপক্ষের বোলাররা চাপে পড়ে যান। এতে করে অপর প্রান্তের ব্যাটসম্যানও স্বচ্ছন্দে ব্যাট করতে পারেন। অর্থাৎ আফিফের শুধু নিজে রান করেন সেটাই না বরং অন্য ব্যাটসম্যানদের কাজটাও সহজ করে দেন। আফিফের আরেকটা বড় গুন তিনি তাঁর শক্তির জায়গায় বল পেলে সেগুলোকে বাউন্ডারি ছাড়া করতে ভুল করেন না।

ফলে আফিফের স্ট্রাইকরেটটা অন্য ব্যাটসম্যানদের তুলনায় অনেক বেশি থাকে। এবং আফিফ যতক্ষণ ক্রিজে থাকেন ততক্ষন প্রতিপক্ষ দলের বোলারদের কাজটাও কঠিন হয়ে যায়। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটায় তিনি ৩৩ বলে করেছেন ৪৯ রান। স্ট্রাইকরেট ১৫০ ছুঁই ছুঁই।

বিশ্বের যেকোন পিচে যা দারুণ ইনিংস। অথচ এই ইনিংসটিতে কী তিনি খুব বেশি স্লগ করেছেন? তাঁর ব্যাটিং দেখে কী মনে হয়েছে তিনি দ্রুত রান তুলতে চান? তিনি তাঁর স্বাভাবিক ব্যাটিংটাই করে গিয়েছেন। বাজে বল পেলে সীমানা ছাড়া করেছেন। এটাই আফিফের স্পেশালিটি।

তাঁর দারুণ স্ট্রাইকরেট দেখে আমরা তাঁকে স্লগার ভেবে ফেলি। তিনি বিজি ক্রিকেটার তবে স্লগার নন। তিনি ইনিংস বিল্ড আপ করতে পারেন তবে তাঁকে দিয়ে চার-ছক্কা মারাতে চাইলেই সমস্যা। তিনি চার ছক্কার বন্যা ছাড়াই আপনাকে ১৪০-১৫০ স্ট্রাইকরেটে রান এনে দিবেন। তবে তাঁকে সময় দিতে হবে বাইশ গজে। তিনি বাইশ গজে যত বেশি সময় থাকবেন তাঁর ও দলের স্ট্রাইকরেট তত ভালো হবে।

কিন্ত ছয়-সাতে ব্যাট করতে নামিয়ে আমরা আফিফকে ব্যবহার করতে পারছিনা। গত দুই সিরিজে তাঁকে নিয়ে অনেক প্রশংসা হয়েছে ঠিক, তবুও বলছি আমাদের আরো অনেক কিছু পাওয়ার আছে আফিফের কাছ থেকে। ফলে বিশ্বকাপে তাঁকে যত উপরে ব্যাট করতে পাঠানো যায় দলের জন্য সেটা ততই লাভজনক হবে। মোদ্দাকথা শেষের দিকে নামিয়ে চাপে না ফেলে আফিফকে নিজের মত ব্যাট করতে দেয়া হোক। তবেই পাওয়া যাবে আফিফের পুরোটা।

ঠিক পুরোটা নয়, কেননা আফিফের বোলিং নিয়ে এখন আলোচনাই হয়নি। তিনি প্রথম খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন তাঁর বোলিং দিয়েই। ২০১৬ সালের বিপিএলে নিজের অভিষেক ম্যাচেই চিটাগাং ভাইকিংসের বিপক্ষে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। সেখানে দ্য ইউনিভার্স বস ক্রিস গেইলের উইকেটটিও ছিল। আফিফের বয়স তখন মাত্র ১৭ বছর ৭২ দিন।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচেও তিন ওভার বল করে মাত্র ১৮ রান দিয়ে তুলে নিয়েছিলেন ১ উইকেট। তবে সেদিন তিনি বল হাতে পেয়েছিলেন পাক্কা ১৫ ম্যাচ পরে। সবমিলিয়ে ২৮ টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলা আফিফ বোলিং করেছেন মাত্র ১০ ম্যাচে।

কখনো নিয়মিত বোলিং না পেলেও যে ১৮ টি ওভার করেছেন সেখানেই তাঁর ঝুলিতে আছে ৭ টি উইকেট। এখন পর্যন্ত তাঁর ইকোনমি রেট ৭.৭২। বোলিং গড় ১৯.৮৫ ও বোলিং স্ট্রাইকরেট মাত্র ১৫.৪। এই সংখ্যাগুলো একজন নিয়মিত বোলারের জন্যেও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে যথেষ্ট ইর্ষণীয় বলে মনে করি।

বোলার আফিফের সবচেয়ে বড় গুন হচ্ছে ব্রেক থ্রু এনে দেয়া। বাংলাদেশের হয়ে অল্প যতুটুকুই বোলিং করেছেন তাঁর মোটামোটি প্রতিবারই উইকেট এনে দিয়েছেন। একজন পার্টটাইম বোলারের কাছ থেকে অধিনায়ক যা আশা করেন আফিফ তাই করে দিয়েছেন।

ফলে বিশ্বকাপে আরব-আমিরাতের স্পিনিং উইকেটে বোলার আফিফকে অবশ্যই ব্যবহার করা উচিৎ। হঠাৎ করেই বিশ্বকাপে তাঁকে দিয়ে হয়তো পুরো চার ওভার বোলিং করানো যাবে না। তবে পার্টটাইম বোলার হিসেবে অন্তত নিয়মিত ব্যবহার করা যায়। এছাড়া যেহেতু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখনো খুব বেশি বোলিং করেননি ফলে বড় দলগুলোর বিপক্ষে তাঁর বোলিং একটা ধাঁধার মত হয়ে উঠতে পারে।

সবমিলিয়ে টপ অর্ডারে আফিফের ব্যাটিং এবং বোলার আফিফের ব্রেক থ্রু বিশ্বকাপে দেখা গেলে পুরো দলের চেহারাই বদলে যেতে পারে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে আফিফের মত ইমপ্যাক্টফুল ক্রিকেটাররাই হার-জিতের পার্থক্য গড়ে দেন। তাই এই বিশ্বকাপে আমাদের সবচেয়ে বড় বাজি আফিফই। শুধু পুরো ব্যবহারটা করা চাই।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link