More

Social Media

Light
Dark

মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, অজস্র ‘কেন’ ও তার জবাব

মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ নামটা যতবার মাথায় আসে, সাথে করে আনে রাশি রাশি প্রশ্ন।

  • তিনি কেন এতো কম জনপ্রিয় কেন?
  • এত বছর জাতীয় দলে খেলে ফেলার পরও তার সুনির্দিষ্ট ব্যাটিং পজিশন নেই কেন?
  • তাঁর গ্ল্যামার নেই কেন?
  • ওয়ানডেতে এতো ইফেকটিভ বোলার হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত বোলিং পায় না কেন?
  • হঠাৎ করেই দলে ব্রাত্য হয়ে পড়লো কেন?

___________________

প্রশ্নের পৃষ্ঠে প্রশ্ন আসতেই থাকবে অফুরন্ত আলোর মতো, তবু মাহমুদউল্লাহ সংক্রান্ত ধোঁয়াশার সমাধান হবে না। ক্ষেত্রবিশেষে মনে হয় মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ না হয়ে তার নাম হওয়া উচিত কেনবন্দী রিয়াদ!

ads

পাল্টা প্রশ্ন হলো, যে মানুষকে নিয়ে এতগুলো ‘কেন’ সে কী করে কম জনপ্রিয় হয়; তাকে ঘিরে আগ্রহ আছে বলেই তো প্রশ্ন বেশি; শফিউল বা শামসুর রহমান শুভকে নিয়ে তো ‘কেন’ আসে না। একটা গেম খেলতে পারেন; ক্রিকেট দেখে বা দেখে না এমন যে কোনো মানুষকে রেন্ডমলি বাংলাদেশের ২ জন ক্রিকেটারের নাম বলতে বলুন, তাদের চিন্তা করার সময় দেয়া যাবে না; ধরা যাক ১৬৭ জনকে জিজ্ঞেস করেছেন।

বাছাই-টাছাই করে সাজাতে গিয়ে দেখবেন নামগুলো এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ: মাশরাফি, আশরাফুল, সাকিব, তামীম, বুলবুল, আকরাম খান, সৌম্য। স্যাম্পল সাইজ এর চাইতে অনেক বড় হলেও উত্তরে তারতম্য হবে না বিশেষ। এমনকি নাসির হোসেন, দুর্জয়, পাইলট, অপি, মুশফিকুর রহিম- এরাও কিছু ভোট পাবেন, কিন্তু ৫ জন মানুষও বলবেন না মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ নামটি। কেন বলবেন না, এই লেখার মধ্য দিয়ে আমি মূলত সেই ব্যাপারটাই বোঝার চেষ্টা করেছি।

বাংলাদেশ আগে ব্যাটিং করুক, বা চেজ করুক, যদি বলা হয় একজনমাত্র ব্যাটসম্যানকে ২০ বল খেলার দৈব নিশ্চয়তা দেয়া হবে (অর্থাৎ এর মধ্যে সে আউট হবে না), এরপর তার ব্যাটিং শুরু হবে, কাকে নেবেন? আমি নির্দ্বিধায় মাহমুদউল্লাহ নামটিই তুলবো।

  • কিছু একটা মিসিং

মাহমুদউল্লাহর অবয়বটা খুব ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করা যাক। তার চেহারা, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এবং মুভমেন্ট কোনোকিছুর মধ্যেই ঠিক ক্রিকেটার স্পিরিটটা পাওয়া যায় না। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ অতিরিক্ত ক্যা্জুয়াল হওয়ায় আমাদের দর্শকমন তার প্রতি একটা ইনহারেন্ট নেগেটিভ রেসপন্স তৈরি করে ফেলে।

আগের প্রজন্মে হাবিবুল বাশার ছিলেন এরকম একজন ক্রিকেটার। ক্রমাগত ফিফটি করেছেন টেস্টগুলোতে, কিন্তু ক্রেজ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন, কারণ বডি ল্যাঙ্গুয়েজে ক্রিকেটার স্পিরিটের ঘাটতি। আমাদের দর্শকমন ক্রিকেটারের একটা স্পিরিট তৈরি করে নিয়েছে। ক্রিকেটার হবে এথলেট এর মতো, কিংবা রাশভারি। হাবিবুল বাশার বা মাহমুদুল্লাহ এর দেহভঙ্গি অনেকটাই দার্শনিকের মতো, মাঠে যখন তারা ফিল্ডিং করেন, দেখে মনে হয় মাথার ভেতর কবিতার লাইন ঘুরপাক খাচ্ছে। যে কারণে দুজনই চরম বাজে ফিল্ডার।

মাহমুদউল্লাহ অদ্যাবধি কতগুলো ক্যাচ মিস করেছেন হিসাব নেই, সৌম্য বা তামীম বাউন্ডারি লাইনে যেরকম অবিশ্বাস্য ক্যাচ ধরেন, কিংবা ক্লোজিংয়ে সাব্বির বা নাসিরের যেরকম রিফ্লেক্স, তার কিছুই মাহমুদুল্লাহর নেই, এমনকি ডাইভ দিয়ে ক্যাচ ধরেছেন এই সংখ্যাটাও হাতেগোণা। তার এই শ্লথ রিফ্লেক্সের সাথে আমাদের চোখ অভ্যস্ত নয়, ফলে ম্যাস পপুলেশনের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি প্রশ্নে তিনি পিছিয়ে পড়েন।

  • ‘একই টাইপ প্লেয়ার’ থিওরি

এক চক্করে মাহমুদউল্লাহর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জার্নিটা ঘুরে আসা যাক। সম্ভবত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচে তাকে প্রথম দেখেছিলাম, তিনি খেলেছিলেন বোলার হিসেবে, সাঙ্গাগারাকে বোল্ড করেছিলেন। সেসময় তিনি ছিলেন ব্যাটিং জানা অফস্পিনার, ব্যাট করতেন আট নম্বরে। কাছাকাছি সময়ের ব্যবধানে দলে ঢুকেন নাঈম ইসলাম, যে ব্যাটসম্যান হয়েও বোলার হিসেবেই বেশি প্রাধান্য পান।

ফলে নাঈম ইসলাম আর মাহমুদউল্লাহ মিলে একটা মিনি অলরাউন্ডার প্যাকেজ হওয়ার প্রক্রিয়ার শুরু হয়। ক্রমাণ্বয়ে মাহমুদউল্লাহ বোলার থেকে ব্যাটসম্যান হয়ে উঠতে থাকেন, আর নাঈম ইসলাম আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকতে থাকতে হারিয়ে যান। কয়েক বছরের মধ্যে দলে চলে আসেন নাসির হোসেন, যিনি কাজ চালানোর মতো বোলিং জানেন। কিন্তু পিউর ব্যাটসম্যান না হওয়াতে দলে জায়গা পোক্ত করতে নাসিরকে বোলিংয়ে জোর দিতে হয়।

ফলে নাঈম আড়াল হতেই নাসির হাজির। এরকম ‘একই টাইপ প্লেয়ার’ কোটায় খেলেন যারা তাদের একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগতে হয়; এরা পিউর ব্যাটসম্যান, নাকি মিনি অলরাউন্ডার এই মীমাংসাটা দর্শকও করতে পারে না। ব্যতিক্রম হিসেবে নাসির হোসেন যে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন এর কারণ ক্রিকেটিয় যতটা, তার চাইতে বেশি বাঙালির ষড়যন্ত্র তত্ত্বে অতিভক্তি। ‘নাসিরকে কোচ পছন্দ করে না, বিসিবি সভাপতি দেখতে পারে না, সুতরাং নাসিরকে ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচানো নৈতিক দায়িত্ব’- এই সমণ্বিত বোধ ছড়িয়ে পড়াতেই নাসির জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।

ওয়ানডেতে মাহমুদউল্লাহ যে পর্যাপ্ত বোলিং করেন না, এই বিষয়ে আমার একটি ব্যক্তিগত হাইপোথিসিস আছে। অনেকে বলতে পারেন কোচ বা অধিনায়ক তাঁকে বোলিং দেয় না। কিন্তু আমি মনে করি, তিনি নিজেই বোলিং করতে চান না। তাহলে ঘরোয়া লিগ বা বিপিএলে তো বেশ বোলিং করেন যে!

মনে রাখা দরকার জাতীয় দল আর লোকাল টিম এক ব্যাপার নয়। জাতীয় দলে নিজেকে নিরঙ্কুশভাবে প্রতিষ্ঠিত করার একটা ব্যাপার আছে; এটা অনেকটা অফিসে নিজের অবস্থান সংহত করার মতো। তিনি আসলে ‘একই টাইপ প্লেয়ার’ তকমা থেকে বেরিয়ে নিজস্ব আইডেন্টিটি তৈরি করতে চান। তামিম ইকবাল বা ইমরুল কায়েস কি বোলিং করেন? বা সৌম্য সরকার কি এখন বোলিং করেন? অর্থাৎ জেনুইন ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে এস্টাব্লিশ করা।

‘একই টাইপ প্লেয়ার’ যেহেতু দলের মধ্যে অনেক আছে, বোলিংয়ে গুরুত্ব দিলে তাকেও সেই দলেই থাকতে হবে, কিন্তু ৩ বা ৪ নম্বরে ব্যাটিং করতে হলে তো ব্যাটিংয়ে একাগ্র মনোসংযোগ দরকার, ‘একই টাইপ প্লেয়ার’ থিওরিতে পড়ে গেলে সেটা আর হবে না। এজন্যই তিনি ওয়ানডেতে বোলিং করতে চান না আমার ধারণা, কিন্তু এখন তাকে ৭ নম্বরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, নিশ্চিত করে বলতে পারি, এখন প্রায় ম্যাচেই তাকে বোলিং করতে দেখা যাবে, কারণ দীর্ঘদিন পর আবারো তাকে ‘একই টাইপ প্লেয়ার’ হিসেবে ফাইট করতে হচ্ছে। মোসাদ্দেক, নাসির, মিরাজ- ৩ জন একই টাইপ প্লেয়ার, এর মধ্যে টিকে থাকতে হবে তো আগে!

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, মাহমুদুল্লাহর ব্যাটিং পজিশন হওয়া উচিত ৫ নম্বরে। ২,৩,৪ এই ৩টা পজিশনে আমাদের স্ট্যাবিলিটি নেই। সৌম্যের ধারাবাহিকতার অভাব, সাব্বিরের ক্রিকেট সেন্সের ঘাটতি, আর ৪ এ ক্রমাগত অদল-বদল চলছেই। সাকিব ওয়ানডেতে যেভাবে ব্যাট করে তাতে ৪ এ খেলার জন্য তিনিই যোগ্যতম ব্যক্তি। মুশফিক ৬এই বেস্ট। নতুন বল খেলার ক্ষেত্রে তার মধ্যে আড়ষ্টতা কাজ করে, সুইঙ্গিং বলে লেগবিফোর অথবা বোল্ড হওয়ার প্রবণতা অত্যধিক বেশি। মাহমুদুল্লাহ ৫ এ খেলা মানে খেলাটা মাঝখান থেকে ধরা। কিন্তু ডিফেন্সিভ স্ট্র্যাটেজি সাজিয়ে তাঁকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে ৭এ।

অন্তত ওয়ানডেতে কি তার অলরাউন্ডার হওয়ার ক্যালিবার ছিলো? এর উত্তর দেয়া মুশকিল। কারণ অলরাউন্ডার হওয়া মানে তখন একাদশে পজিশন পাওয়া নিয়ে সাকিবের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা। আমাদের উপমহাদেশীয় ক্রিকেট কালচারেই নিউজিল্যান্ডের মতো অলরাউন্ডার ভরতি একাদশ সাজানোর রীতি নেই; ডেভ হোয়াটমোর মাল্টি স্কিল্ড প্লেয়ার থিওরি দিয়ে এরকম একটা এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছিলেন, রেজাল্ট ভালো না আসায় পরবর্তী কোচরা সেই চেষ্টা আর করেনি।

ফলে প্রথম ৭ জনের মধ্যে ২ জন স্পিনিং অলরাউন্ডার, এই কম্বিনেশনটা দলের জন্য দুর্দান্ত হলেও খেলোয়াড়দের পারসপেক্টিভ থেকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ; কেবলই মনে হবে যে কোনো একজনকে খেলালে তো জায়গা হারাতে হবে। সাকিবের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার মানসিক শক্তি সঙ্গত কারণেই থাকার কথা নয়। তার চাইতে মিডিওক্রিটিকে অস্বীকার করে জেনুইন ব্যাটসম্যান হয়ে গেলেই তো নিরাপদ।

কিছু মানুষের জীবনটাই স্ট্রাগল আর ক্রাইসিসে ভরপুর থাকে। মাহমুদউল্লাহর ক্যারিয়ারকে তেমনটা বলা যায়। ১২-১৩ বছর পার করে ফেলেও তিনি ‘একই টাইপ প্লেয়ার’ এর ঘেরাটোপ থেকে বের হতে পারেননি; আরও যদি ৫ বছর খেলেন, এরকম অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়েই যেতে হবে হয়তো।

একই অফিসে চাকরি করে কেউ ফ্ল্যাট কেনে, ব্যাংকে লক্ষ লক্ষ টাকা জমায়, আর কেউবা ভাড়া বাসায় থেকে চিকিৎসা খরচ যোগাতে পারে না; পার্থক্যটা হয়ে যায় এপ্রোচে। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের নিয়তি তাই বাংলা সিনেমায় বুলবুল আহমেদ এর মতো। সেই আমলে মহানায়ক এর মতো অত্যাধুনিক সিনেমার নায়ক হয়েছিলেন যিনি, বাংলা সিনেমার লিখিত ইতিহাসে সেই বুলবুল আহমেদ আদৌ কি থাকবেন!

  • স্পেশাল ট্যালেন্ট ডিসকাউন্ট

মাহমুদউল্লাহ ঠিক গ্ল্যামার ম্যাটেরিয়াল নন। আশরাফুলের ব্যাটিং দেখলে যে প্রশান্তি, সৌম্য বা তামীমের ব্যাটিংয়ে যে স্বস্তি, মাহমুদউল্লাহ কি তা পূরণে সক্ষম? স্পেশাল ট্যালেন্ট মানে কি তাহলে সুন্দর শট খেলার ক্ষমতা শুধু? এই প্রশ্নটা খুব গভীর। রেডিমেড উত্তর দেয়া কঠিন। তার চাইতে আরেকটু বোঝার চেষ্টা করি। মাহমুদউল্লাহ ব্যাকফুট পাঞ্চ এর যে শটগুলো খেলেন, স্পিন বলে কাভার দিয়ে যে শটগুলো খেলেন, কিংবা  এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টিতে মোহাম্মদ ইরফানকে যেভাবে লংঅফের উপর দিয়ে আলতো করে ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন, ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ক্রিস ওকসকে মিড উইকেট দিয়ে ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন- এই শটগুলো তো একবার দেখলে ভোলার কথা নয়।

নাকি আবারো সেই বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ফ্যাক্টরেই আটকে পড়বেন? তামীম জহির খানকে ডাউন দ্য উইকেটে ছক্কা হাঁকাচ্ছেন বা সৌম্য পয়েন্ট অঞ্চল দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে বলকে সীমানাছাড়া করেছেন, এর মাঝে যেরকম এরোগেন্স, এলিগ্যান্স থাকে, তুলনায় মাহমুদুল্লাহকে মনে হয় নিরীহদর্শন একজন ব্যাটসম্যান, যার ব্যাটিং স্ট্যান্স দেখলে বোঝারই উপায় নেই, এই ব্যাটসম্যানের মধ্যে কনফিডেন্স আছে কিনা- এগুলোই কি কারণ?

আমাদের ডিসিশন মেকিং প্রসেস এতো নিখুঁত ক্যালকুলেশন দ্বারা তাড়িত হয় না, অনেকটাই ইরেশনালিটি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়; সুতরাং দৃষ্টিনন্দন শট খেলা প্রশ্নে মাহমুদউল্লাহ পিছিয়ে পড়বেনই। তিনি সৌম্যের মতো পেরিস্কোপ খেলেন না, আশরাফুলের মতো স্কুপ খেলেন না, সাব্বিরের মতো একটানা রিভার্স সুইপ খেলেন না; অন্য ব্যাটসম্যানের থেকে দর্শক তাকে আলাদা করবে কীভাবে! অনেকটা কাছাকাছি কারণেই স্টিভ ওয়াহ এর চাইতে মার্ক ওয়াহ এর দর্শকপ্রিয়তা বেশি, কারণ মার্ক ওয়াহ যেভাবে রিস্ট প্লেয়িংয়ের প্রদর্শনী করতেন, স্টিভ ওয়াহ সেটা পারতেন না; অথচ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে দুই ভাইয়ের কে কোন্ অবস্থান অর্জন করতে পেরেছেন, এতোদিন পরে আমরা আজ তা দেখতে পাচ্ছি।

অস্ট্রেলিয়া দলে ডেমিয়েন মার্টিন নামে একজন ব্যাটসম্যান খেলতেন। কিন্তু গিলক্রিস্ট, হেইডেন, পন্টিং, বেভানরা যতোটা পরিচিত, মার্টিন বললে অনেকেই মনে করতে পারবেন না। অথচ, এই ব্যাটসম্যানটির খেলা দেখার মধ্যে যে তৃপ্তি ছিলো তা স্মরণ করতে গেলে বারেবারেই মাহমুদউল্লাহ ফিরে আসেন।

ধরা যাক দৃষ্টিনন্দন শট প্রশ্নে পিছিয়ে পড়লেন। কিন্তু এডাপ্টিভ বা এডজাস্টিং ন্যাচার প্রশ্নে তার সমকক্ষ কোনো প্লেয়ার কি বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসেই আছে কেউ? একজন ছিলেন অলক কাপালি, কিন্তু কনসিসটেন্সির বিকট অভাবে সে তো কবেই হারিয়ে গেছে। ৩,৪ এ ব্যাট করেছেন, ৭,৮ এও সমান দক্ষ।

একসময় সেট হতে সময় নিতেন, বিগ হিটিংয়ে দুর্বলতা ছিলো, সেটাও সুনিপুণভাবে কাটিয়ে উঠেছেন, ঠাণ্ডা মাথায় ম্যাচ শেষ করে আসেন- এই বৈশিষ্ট্যকে কি স্পেশাল ট্যালেন্টের অধীনে নেয়া যায় না? লারা বা টেন্ডুলকার তো চেষ্টা করে হওয়া যায় না, জন্মগত কিছু দক্ষতা থাকতে হয়, কিন্তু ঐকান্তিক চেষ্টা থাকলে যে স্পেশাল হওয়া যায়, এটা তো মাহমুদুল্লাহর ট্রান্সফরমেশন থেকে ব্যাপকভাবে ইন্সপাইরেশন পাওয়া যায়। একে কি উপেক্ষা করা হবে?

মাহমুদউল্লাহ কি ফ্যানবেইজ ম্যাটেরিয়াল নন? এখনো পর্যন্ত সৌম্য বা সাব্বিরের যতগুলো ইন্টারভিউ নেয়া হয়েছে, এতো বছর খেলার পরও মাহমুদউল্লাহ কি তার অর্ধেক ইন্টারভিউ দিতে পেরেছেন? অথচ, নিউজ এলিমেন্ট তো প্রচুর। পাকিস্তানের সাথে এশিয়া কাপের সেই পরাজয়, ২০১১-২০১৫ বিশ্বকাপে দুইবার ইংল্যান্ডকে হারানো, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের সাথে ১ রানে হারা ম্যাচ- প্রত্যেকটাই তো হতে পারতো বিশদ আলোচনার রসদ।

বরং, রাহুল দ্রাবিড়ের মতো তাঁকে আনসাং হিরো ইমেজে প্রতিষ্ঠিত করার দিকেই ঝোঁক বেশি। অনেকে বলবেন এটাও বরং একদিক থেকে ভালো, কারণ মাশরাফির মতো পেস বোলিং ট্রেন্ড তৈরি করতে পারেননি, সাকিবের মতো দেখাতে পারেননি বাংলাদেশের একজন ক্রিকেটারও র‌্যাংকিংয়ের শীর্ষে থাকতে পারে, তামীমের মতো দেখাতে পারেননি বাংলাদেশের ওপেনার যে কোনো পেসারকে ঠ্যাঙানি দিতে পারে; কোথাও যেহেতু নেই, তার চাইতে আনসাং হিরো একটা ইউনিক চরিত্র।

কিন্তু, আমাদের দেশে যেখানে শো-অফ করাটাই বড় কৃতিত্ব সেখানে ক্রিকেটের স্বার্থেই মাহমুদউল্লাহর মতো ক্রিকেটারদের বেশি করে ফোকাস পাওয়া উচিত, কারণ আমাদের মধ্যে লেগে থাকার অভ্যাস নেই, অল্পতেই তুষ্ট হওয়ার প্রবণতা ভয়ানক; এখানে যদি ডিটারমিনেশনকে হিরোয়িক ইমেজ দেয়া হয়, তরুণদের মধ্যে সেটা গ্রো করবে। কিন্তু ডিটারমিনেশনে তো চার্ম নেই, গ্ল্যামার নেই, তার চাইতে ‘আনসাং হিরো’ শুনতে ভালো লাগে, এর মধ্যে সিমপ্যাথেটিক একটা টোন আছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে মাহমুদউল্লাহ হওয়া উচিত একটি ‘ক্রাইসিস ম্যান’ চরিত্র যিনি বলবেন ‘ভয় পেয়ো না; আছি এবং থাকবো’।

  • ছন্দপতনে পিনপতন

টেস্ট আর ওয়ানডে পুরোপুরি দুই ফরম্যাটের খেলা। ওয়ানডেতে যতোটা অপরিহার্য, টেস্টে মাহমুদউল্লাহকে সেই পর্যায়ে ভাবার সুযোগ কম। কিন্তু টেস্টে তিনি খেলে গেছেন, পারফরম না করলে বাদ পড়বেন; হিসাব তো সহজ। হঠাৎ একদিন সংবাদ বেরুলো টেস্টে ৮ বছর ধরে তার কোনো সেঞ্চুরি নেই, এরপরই একাদশ থেকে বাদ, দেশে ফেরত পাঠানোর আয়োজন, দলের সাথে না রাখা- এরকম অদ্ভুতুড়ে এবং চরম ক্রিকেটবর্বরতার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাইনি।

একাদশ থেকে একজন খেলোয়াড় বাদ পড়তেই পারে, তার ট্রিটমেন্ট কি এমন? এবং টেস্টে খারাপ করেছে বলে ওয়ানডেতেও নজরে পড়ে যাবে? কী অদ্ভুত! মুশফিক টেস্টে যতোটা ভালো খেলে, ওয়ানডেতেও কি তেমন? একেকজনের একেকটা আইডিয়াল ফরম্যাট থাকে।

২০১৫ সালের বিপিএলে মাহমুদউল্লাহর পারফরম্যান্স, বিশেষত ক্যাপ্টেন্সি দেখে অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিলেন মাশরাফির পর তিনিই হবেন অধিনায়ক, তা তিনি টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে হয়েছেনও। তারপর থেকে ভোজবাজির মতো দৃশ্যপট পাল্টে গেলো, মাহমুদুল্লাহ এখন আবারো পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে লড়ছেন।

সাকিব, তামিম, বা মুশফিকের মতো খেলোয়াড়ের কি নতুন করে কিছু প্রমাণ করার আছে এখনো? অথচ ম্যাচ ইমপ্যাক্ট প্রশ্নে মাহমুদুল্লাহ তো কোনোভাবেই তাদের চাইতে পিছিয়ে নেই। তবু তাকে বরাবরের মতো প্রমাণ করে যেতে হয়; এই দৃশ্যচিত্র দেখলে সমগ্র জাতির ক্রিকেট সেন্সকে প্রহসনের মতো লাগে। নিজেদের অযোগ্যতা, অদক্ষতাকে মেনে নেয়ার সাহস নেই যাদের তারা অবিরল স্বজনপ্রীতির দুর্গন্ধ খুঁজে বেড়ায় সর্বত্র; সেই সমাজের একজন হয়ে দলের অধিনায়কের সাথে শ্যালিকার বিয়ে দিয়ে তিনি যে ক্যারিয়ারের জন্যই বিরাট ক্ষতি করে ফেলেছেন এই বোধটি তার রেশনাল মাইন্ডে হয়তোবা কাজ করেনি।

করার কথাও নয়। কারণ ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স এবং আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগা যে সমস্ত মানুষ তাকে ‘ভায়রা ভাই’ বলে উপহাস করে বা করতো, তারা ভেবেও দেখে না জাতীয় দল নির্বাচন করার দায়িত্ব অধিনায়কের থাকে না, (তা-ই যদি হতো তাহলে মাশরাফি ক্যাপ্টেন থাকাবস্থায় আব্দুর রাজ্জাক কোনোদিনই বাদ পড়তো না), এবং যখন তিনি সুযোগ পেয়েছিলেন, তখন মুশফিক ক্যাপ্টেন ছিলেন না, আত্মীয়তার সম্পর্কও স্থাপিত হয়নি; জায়গাটা নিজের মেধা আর শ্রম দিয়ে অধিকার করে নিতে হয়েছে।

অন্য সবকিছুর মতো ক্রিকেটারদের মধ্যেও আমাদের দর্শকমন বিভাজন তৈরি করে ফেলে। বাংলাদেশের খেলা দেখতে বসেও আমরা প্রার্থনা করি তামিম যেন ভালো খেলে, মাশরাফি যেন ভালো বোলিং করে; ফলে দলের মধ্যে থেকেও খেলোয়াড়ভিত্তিক চয়েজ আমাদের কাজ করে। তামিম বা সৌম্য চার মারলে সেটা যেমন দলের স্কোরে যোগ হয়, ইমরুল কায়েস মারলেও তা-ই, কিন্তু তারা চার মারলে তালি বেশি, ইমরুলের বেলায় তালি আসে না।

মাহমুদউল্লাহরও একই অবস্থা। নাসিরের জন্য আন্দোলন হয়, কিন্তু মাহমুদুল্লাহ এর ব্যাটিং দেখবো- এই ডিটারমিনেশন নিয়ে টিভির সামনে বসে খুব অল্প মানুষ। পৃথিবী বরাবরই রাজা-মন্ত্রীদের বরণ করেছে, তাদের নামে বীরত্বগাঁথা লিখেছে, কিন্তু যে শান্ত্রী রাজ্য পাহারা দিয়েছে, যে সৈন্যটি রাজাকে বাঁচাতে গোলার সামনে বুক পেতে দিয়েছে, সে বা তারা এখন ধূলোর রাজ্যে লুটোপুটি খাচ্ছে। পৃথিবী একটি চরম ইনজাস্টিসের জায়গা। ভাই মাহমুদুল্লাহ, আপনাকেও এই সত্যি মেনে নিতে হবে।

কিন্তু সঙ্গে এটাও বলে রাখি, আজ থেকে ৪৭ বছর পরে বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে যদি কোনো বিশ্লেষক কাজ করেন, তখন ডাটা স্যাম্পল হিসেবে যখন মাহমুদউল্লাহ আসবেন, নিশ্চিত করে বলতে পারি, ‘কেন’ এর প্রাবল্যে তিনি ত্রাহিত্রাহি করবেন। হ্যাশট্যাগ এর মতো তিনি একটি নতুন ট্যাগ এর নাম প্রস্তাব করবেন, যার নাম হবে ‘কেন ট্যাগ’।

সাকিবকে নিয়ে বই লেখা হয়েছে, বইয়ে আছেন মাশরাফিও; আমার হাতে যদি আরেকটু সময় থাকতো, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের একটা বায়োগ্রাফি অবশ্যই লিখতাম, যে শুধু ক্রিকেট নয়, মানুষের অভ্যন্তরীণ মনোজগতের এক ব্যতিক্রমী ম্যানিফেস্টেশন। কারো না কারো সময় নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু আগ্রহ আছে কিনা দিনশেষে সেটাই প্রশ্ন। গ্ল্যামারহীন একজন ক্রিকেটারকে ‘আনসাং হিরো’ বলে সিমপ্যাথি দেখানো যায়, কিন্তু তার বায়োগ্রাফি লেখা? এ যেন ঠিক চীনের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার গল্প!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link