More

Social Media

Light
Dark

ক্রিকেটের দুয়ারে আরেক বিপ্লব

বিবিসি ওয়ানের জনপ্রিয় ‘দ্য গ্রাহাম নর্টন শো’র এক এপিসোডে মার্কিন পপ তারকা টেইলর সুইফটের সাথে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ব্রিটিশ ক্রিকেট তারকা কেভিন পিটারসেন।

কথায় কথায় ক্রিকেটের কথা ওঠে। পিটারসেনের খেলোয়াড়ি জীবনের কথা। উপস্থাপক তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘সুযোগ পেলে ক্যারিয়ারের কোন ভুলটা শুধরে নিতে চাইতেন?’ কেপি বলা শুরু করেন অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসের শততম টেস্ট ম্যাচে বিপক্ষদলের কাছে স্ট্রাউসের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষুদে বার্তা চালাচালির ইস্যুটা নিয়ে।

কেপি একমনে নিজের কথা বলে চলেছেন; আর এদিকে গোটা সময়টা চোখেমুখে স্পষ্ট অস্বস্তি নিয়ে পাশে বসে আছেন টেইলর সুইফট। যেন গোটা বিষয়টা তাঁর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা টের পেয়ে কেপি তাঁর দিকে তাকিয়ে হেসে থেমে গেলেন। টেইলরও সাথেসাথে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘না ঠিক আছে আপনি বলুন, আমিও কিছু শিখি। তো কি করলেন আপনি আপনার শততম ‘চেজ ম্যাচে’?’

ads

আরেকবার হাসির রোল উঠল। কারণ সবাই বুঝতে পেরেছিল যে এই মার্কিন বিশ্ববরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী এর আগে কোনদিন ক্রিকেটের ‘ক’-এর সাথেও পরিচিত ছিলেন না।

মজার একটি ঘটনা। কিন্তু চরম একটি বাস্তবতার দিকেও ইঙ্গিত করে।

আমাদের উপমহাদেশে, ব্রিটেনে, অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডে ক্রিকেটের যে উন্মাদনা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল জনগোষ্ঠীর মানুষের কাছে তা প্রায় সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা, অপ্রাসঙ্গিক। আমেরিকানরা ক্রিকেট বোঝে না, ক্রিকেটারদের চেনে না এমনকি ক্রিকেট নিয়ে জানার চেষ্টাও করে খুব কম! এর শুধু এই একটাই উদাহরণ নেই। সাধারণ আমেরিকানদের ক্রিকেট নিয়ে প্রশ্ন করলে কি অজ্ঞতার পরিচয় ও বোকার মত সব উত্তর পাওয়া যায় তা নিয়ে অসংখ্য ভিডিও ইউটিউবে আছে।

সেই আমেরিকাতে এবার ক্রিকেট বিপ্লব আনার চেষ্টা হচ্ছে। মেজর ক্রিকেট লিগ দিয়ে এখানে ক্রিকেটের জোয়ার আনার পরিকল্পনা আটা হচ্ছে।

আমেরিকায় ক্রিকেট জাতীয় দল রয়েছে। রয়েছে নারী দল এবং যুবদলও। ২০১৯  সালে তারা আইসিসির নতুন সহযোগী সদস্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। আইসিসি ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ লিগ টুতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। কিন্তু এই সাফল্যের খবর সে দেশের জনগণের কাছেই অজানা। এমনকি ক্রিকেটকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেবার কথাও কেউ বিবেচনায় আনেন না।

তাদের প্রায় সব খেলোয়াড়ই উপমহাদেশীয়, ইংলিশ, তাসমানিয়ান, সাউথ আফ্রিকান বা ক্যারিবিয়ান প্রবাসী বা বংশোদ্ভূত নাগরিক। এমনকি ক্রিকেট বোর্ড, ইউএস ক্রিকেটেরও বেশিরভাগ কর্মকর্তাও তাই। সাধারণ আমেরিকানদের ক্রিকেট নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। এর মূল কারণ ক্রিকেটের সময়সাপেক্ষতা ও ব্যয়বহুলতা।

আমেরিকানরা ক্রীড়ানুরাগী নয় এমন না। রাগবি, আমেরিকান রুলস ফুটবল, বাস্কেটবল, আইস হকি বা প্রায়-ক্রিকেটে-সদৃশ একটি খেলা ‘বেসবল’ নিয়ে তাদের প্রচন্ড উন্মাদনা রয়েছে। তারা স্বভাবজাত এথলেট। শুধুমাত্র ক্রীড়ানৈপুণ্য থাকার সুবাদেই তাদের অসংখ্য তরুণ প্রতিবছর কোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়! কিন্তু বুঝতে হবে যে, আমেরিকানদের কাছে খেলা মানে ‘তা নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকা’ নয়।

আমেরিকানদের কাছে খেলা হল যান্ত্রিক জীবনের সমস্ত কাজের ফাঁকে অবসর বিনোদন। তাঁদের প্রচলিত খেলাসমূহ, যেমন এনএফএল বা সুপারবোল আসরগুলো যখন তাদের অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যেবেলা সংক্ষিপ্ততম সময়ে সর্বোচ্চ বিনোদনের খোরাক জুগাচ্ছে। যখন বেসবলের ৩ ঘন্টায়ই তারা পর্যাপ্ত উত্তেজনা পাচ্ছে তখন ক্রিকেট নিয়ে ৫-৫টা দিন বা গোটা একটা দিনই বা সময় নষ্ট করার মানসিকতা লালন করবে কেন?

কিন্তু আবার এটাও সত্য যে, ক্রিকেটের যদি সত্যিই বিশ্বায়ন করতে হয় তাহলে আমেরিকার মত একটি বিশাল ডেমোগ্রাফি, গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক পরাশক্তি এবং মিডিয়া মুঘল ও ধনকুবেরদের আঁতুড়ঘরকে খুব বেশিদিন এড়িয়ে চলা যাবে না। আজ নয়ত কাল আমেরিকার সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা ক্রিকেটে প্রয়োজন হবেই। আমেরিকার মানুষদের যদি একবার ক্রিকেট বুঝিয়ে ফেলতে পারা যায়, তাহলে এতে একদিকে যেমন ক্রিকেটের বৈশ্বিক, বাণিজ্যিক প্রসার ঘটবে, তেমনি ভারত ভিত্তিক কেন্দ্রীয়করণ নীতি থেকেও ক্রিকেট অনেকাংশে মুক্তি পাবে।

আইসিসি তাই বহুদিন যাবত নানাভাবে আমেরিকায় ক্রিকেটের প্রসার ঘটাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শেষ চেষ্টা করছে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট দিয়ে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ব্যপ্তি, উত্তেজনা, গ্ল্যামার, বিনোদনের ফুলঝুরি আমেরিকানদের ক্রীড়ামনস্কতার সাথে চমৎকারভাবে খাপ খায়। কাজেই এটা দিয়েই আমেরিকানদের ক্রিকেটমুখী করা সম্ভব বলে ধরে নিয়েছে ক্রিকেটের এই কর্তাসংস্থাটি। টুকটাক আন্তর্জাতিক সিরিজ, ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ, ২০১৫ সালে ক্রিকেট অলস্টার নামক টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে শচীন, লারা, ওয়াসিম,ওয়ার্নদের বেসবল মাঠে ক্রিকেট খেলিয়ে তারা আমেরিকানদের মাঝে ছড়াতে চেয়েছিল ক্রিকেটের রং। খুব একটা লাভ হয়নি। মেরেকেটে ঐ উপমহাদেশীয় প্রবাসীদের গন্ডিতেই আটকে ছিল সব।

তাই এবার আর ছুটকো ছাটকা আয়োজন নয়। গোটা আমেরিকাব্যাপী ক্রিকেটের গণজোয়ার তোলার বিশাল এক লক্ষ্য হাতে নিয়েছে দেশটির ক্রিকেট বোর্ড ইউএসএ ক্রিকেট। আমেরিকান ক্রিকেট এন্টারপ্রাইজ (ACE) নামক একটি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘আমেরিকার জনগণের মধ্যে ক্রিকেটের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি’ ও ‘দেশব্যাপী ক্রিকেটীয় অবকাঠামোর টেকসই উন্নয়ন সাধন’ এই দুই মূলনীতিকে কেন্দ্র করে এই ক্রিকেট বোর্ড ২০২০-২০২৩ মেয়াদী তাঁদের ‘ফাউন্ডেশন প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। তাদের এই প্ল্যানের বড় অংশ হল ২০২২ এ হতে যাওয়া ‘মেজর লিগ ক্রিকেট’ নামের একটি নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগ। এবং তার আগে এই বছর তারা প্রথম পর্বে ‘মাইনর লীগ’ নামের আরেকটি ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগও চালু করবে।

আদতে মাইনর লিগটি ২০২০ সালেই অনুষ্ঠিত করার প্ল্যান ছিল। মেজর লিগ করার কথা ২০২১ সালে। এসিই-এর মূল উদ্যোক্তাদের সবাই ভারতীয় কিংবা ভারত বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী। যুক্তরাষ্ট্র ক্রিকেটকে ১ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন ও করে তারা। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে তাদের সব আয়োজন এক বছর পিছিয়ে যায়।

তবে আর দেরি নয়! ২০২১ এই শুরু হবে ২৪ দলের, ৭ সপ্তাহ ব্যাপী, ১৫৫ ম্যাচের দেশব্যাপী ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট ‘মাইনর লিগ’। দেশকে চারটি ‘কনফারেন্স’-এ বিভক্ত করে প্রতিটি কনফারেন্সে থাকবে ছয়টি শহরভিত্তিক ফ্র্যাঞ্চাইজি দল। আমেরিকার আনাচ কানাচের ক্রিকেটীয় প্রতিভাদের শো-কেস করার পাশাপাশি প্রতিটি দলে খেলবেন ৩জন করে আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট তারকা। এই মাইনর লিগ হবে খেলোয়াড়দের মূল পাইপলাইন। এরপর সেখান থেকে উঠে আসা ক্রিকেটারদের নিয়ে ২০২২ সালে শুরু হবে মূল আয়োজন মেজর লিগ ক্রিকেট!

আটলান্টা, শিকাগো, লস অ্যাঞ্জেলেস, ডালাস, নিউ ইয়র্ক, এবং সান ফ্রান্সিসকো – ছয়টি ফ্র্যাঞ্চাইজিতে ভাগ হয়ে মেজর লিগ ক্রিকেটে খেলবেন ক্রিকেটাররা। মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী সত্য নাদেল্লা, এডবির সিইও শান্তনু নারায়ণ, পেটিএমের এর বিজয় শেখর শর্মা, টেক্সাসের ধনকুবের রস পেরট জুনিয়রদের মত বড়বড় নাম ও তাদের বিনিয়োগ জড়িত আছে এই টুর্নামেন্ট এর সঙ্গে। তবে সবচেয়ে বড় নাম সম্ভবত বলিউডের ‘বাদশাহ’ শাহরুখ খানের।

তাঁর নাইট রাইডারস গ্রুপ এই টুর্নামেন্টে বিনিয়োগকারী ও উপদেষ্টা হিসেবেই শুধু থাকবে না, লস এঞ্জেলস এর ফ্র্যাঞ্চাইজি টিমও ইতোমধ্যে কিনে নিয়েছেন কিং খান। কেকেআরে তাঁর ব্যবসায়িক পার্টনার জুহি চাওলা ও তাঁর স্বামী জয় মেহতাও খানের সঙ্গে থাকবেন। ইতোমধ্যে কোরি অ্যান্ডারসন, লিয়াম প্লাঙ্কেট, সামি আসলামদের মত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটাররা নাম লিখিয়েছেন এই টুর্নামেন্টে। ক্রিস গেইল, শহীদ আফ্রিদি, স্টিভেন স্মিথ, এবি ডি ভিলিয়ার্সদের মত তারকাদেরও সাইন করানোর প্রক্রিয়া চলমান।

প্রাক্তন ক্রিকেটার ও ব্রডকাস্টার সাইমন হিউজ বলেছেন, ‘ক্রিকেট যুক্তরাষ্ট্রে অতীতে খুব বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। এবারো এটি সহজ হবে না, তবে সম্ভাবনা রয়েছে ভীষণ।’ শাহরুখ খান বলেছেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা বিশ্বব্যাপী নাইট রাইডার্স ব্র্যান্ডটির সম্প্রসারন করে চলেছি, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সম্ভাব্না খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করছি। আমরা নিশ্চিত যে মেজর লিগ ক্রিকেট তার পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সঠিক পথেই রয়েছে এবং আমরা আগামী বছরগুলিতে আমাদের এই পার্টনারশিপকে একটি বিশাল সাফল্য হিসাবে দেখার প্রত্যাশা করছি।’

আমেরিকা কে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া অর্থনীতির দেশ। এনএফএল বা সুপারবোল আসরগুলি নিয়ে যে পরিমাণ অর্থ, গ্ল্যামার আর উত্তেজনার ছড়াছড়ি হয় তা থেকে এটা বলাও যথার্থ। এছাড়াও এইদেশে রয়েছে বিপুল পরিমাণ জাতিগত বৈচিত্র্য। যাঁদের টার্গেট অডিয়েন্স হিসেবে ব্যবহার করে যেকোনো কিছুর লাভজনক পণ্যায়ন করা সম্ভব। এবং এর মাধ্যমে সাধারণ আমেরিকানদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব।

একটা সময় আমেরিকানরা ফুটবল ও বুঝত না। হিস্প্যানিক বংশোদ্ভূত প্রবাসী জনগোষ্ঠীদের টার্গেট করে শুরু করা ‘মেজর লিগ সকার’-এর মধ্য দিয়ে ফুটবল এখন আমেরিকানদের একটি ক্রীড়া আমোদের উপলক্ষ্য। তেমনি প্রায় ৬২ লক্ষ উপমহাদেশীয় ও আরো অসংখ্য তাসমান, ব্রিটিশ, সাউথ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর কাছে ক্রিকেটের যে  জনপ্রিয়তা, মার্কিন মিডিয়া মার্কেটের যে প্রতাপ, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের যে উদ্দীপনা ও আমেরিকায় খেলাধুলার যে সংস্কৃতি, চারের মেলবন্ধনে এই ‘মেজর লিগ ক্রিকেট’ও আমেরিকায় অত্যন্ত সফল একটি প্রোডাক্ট হয়ে উঠতে পারে বলেই মনে হচ্ছে।’

ক্যারি পেকার বা আইসিএলের সাথে এটাকে মেলানো যাবে না। কারণ, এটা প্রতিষ্ঠানবিরোধী কোনো আয়োজন নয়। তবে ক্যারি প্যাকার যেভাবে ক্রিকেটকে রঙ্গীন বিপ্লব এনে দিয়েছে এবং আইসিএল যেভাবে ক্রিকেটে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের প্রতিষ্ঠা করেছে; তার তুলনা নেই। এবার মেজর ক্রিকেট লিগ তৈরী করতে পারে আরেকটি বিপ্লব।

আর কে জানে, এর মধ্যে ক্রিকেট অলিম্পিকে চলে এলে রাষ্ট্র হিসেবেও যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আগ্রহী হয়ে পড়তে পারে খেলাটিতে। তাহলেই বলা যাবে, বিপ্লব একটা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link