More

Social Media

Light
Dark

কিউই বজ্র বিদ্যুৎ

ক্রিসমাসের আগে সেবার অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি প্রতিবেশি নিউজিল্যান্ড।

১৯৯৩ সালের পর তখনও অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে জয়হীন কিউইরা। অসহায় আত্মসমর্পন করেছে আগের ম্যাচেও। হোবার্টে তাই ম্যাচ শুরুর আগে তাই ভীষণ চাপে রস টেলরের দল। কোচ এবং ম্যানেজার সিদ্ধান্ত নিলেন অতিরিক্ত পেসার নেবার, অভিজ্ঞ ড্যানিয়েল ভেট্টোরির বদলে তাই সুযোগ পেলেন তরুণ এক বাঁহাতি পেসার। ডগ ব্রেসওয়েল এবং ক্রিস মার্টিনের তোপে মাত্র সাত রানে জিতে সেবার ১৮ বছরের খরা কাটিয়েছিল কিউইরা।

তরুণ সেই পেসারও খারাপ করেননি, নিয়েছিলেন চার উইকেট। তবে বোলিংয়ের চাইতে সম্ভবত সেবার ব্যাট হাতে অবাক করেছিলেন সবাইকে। লো স্কোরিং সেই ম্যাচে নয়ে নেমে তাঁর করা ২১ রানই পার্থক্য করে দিয়েছিলো সেদিন। সেই খেলোয়াড়টি হলেন ট্রেন্ট বোল্ট, বাঁ হাতের ত্রাসে যিনি মোহমুগ্ধ করে রেখেছেন পুরো বিশ্বকে।

ads

১৯৮৯ সালে রুতুরুয়াতে জন্মগ্রহণ করেন এই ক্রিকেটার। তার বড় ভাই জোনো বোল্টও ক্রিকেট খেলতেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না খেললেও নর্দান ডিস্ট্রিকসের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে ছিলেন নিয়মিত মুখ।

২০০৮ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপগামী কিউই দলে সুযোগ পান বোল্ট। ছোটদের সেই দল থেকে নিউজিল্যান্ড পেয়েছে তার পরবর্তী প্রজন্মের সেরাদের। কেন উইলিয়ামসন, টিম সাউদি, কোরে অ্যান্ডারসন, হামিশ রাদারফোর্ডের পাশাপাশি সেই দলে ছিলেন বোল্টও। টিম সাউদির সাথে বিধ্বংসী জুটির শুরুটাও সেখান থেকেই। যদিও বৃষ্টিবিঘ্নিত সেমিফাইনালে কোহলির ভারতের কাছে হেরে বিদায় নেয় কিউইরা। কিন্তু সবার মাঝে আলাদা করে আলো ছড়িয়েছিলেন বোল্ট, গ্রুপপর্বে ম্যাচে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে নিয়েছিলেন সাত উইকেট।

এরপরের তিন বছর টানা পারফর্ম করে গেছেন নর্দান ডিস্ট্রিকসের হয়ে। কিন্তু বন্ধু টিম সাউদি কিংবা ডগ ব্রেসওয়েল, ক্রিস মার্টিনদের উত্থানে দলে সুযোগ পাচ্ছিলেন না। অবশেষে ডাক পান সেই ঐতিহাসিক হোবার্ট টেস্টে। সে ম্যাচে ভালো খেলার সুবাদে অপেক্ষা করতে হয়নি রঙিন পোশাকের ক্রিকেটে ডাক পেতেও। পরের বছরেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হয়ে যায় একদিনের ক্রিকেটে অভিষেকও।

সাদা-কালো জার্সির সাথে সেই গাঁটছড়া শুরু, যা চলছে এখনও।

হতে পারতেন টানা দুই বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য। কিন্তু ভাগ্যের মারপ্যাঁচে দুবারই হারতে হয় ফাইনালে গিয়ে। ২০১৫ বিশ্বকাপে ২২ উইকেট নিয়ে নির্বাচিত হন সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। যদিও সমান ২২ উইকেট ছিল মিচেল স্টার্কেরও, কিন্তু তার ১৬.৮ স্ট্রাইকরেট ছিল স্টার্কের চেয়ে ভালো।

সেবার অকল্যান্ডের আগুন ঝড়ানো ম্যাচে একাই গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন অজি ব্যাটিং লাইনআপ; মাইকেল ক্লার্ক, ম্যাক্সওয়েল, মার্শদের ফিরিয়ে অজি মিডলঅর্ডারের মেরুদন্ড ভেঙে দিয়েছিলেন তিনি। তার পাঁচ উইকেটের ফলে মাত্র ১৫১ রানে অলআউট হয় অস্ট্রেলিয়া।

পরবর্তীতে স্টার্কের আগুনে বোলিংয়ের পরও উইলিয়ামসনের দায়িত্বশীল বোলিংয়ে জয় পায় কিউইরা। ২০১৯ বিশ্বকাপেও ধরে রেখেছিলেন নিজের ফর্ম, নিয়েছিলেন ১৭ উইকেট। ফাইনালের সুপার ওভারও করেছিলেন তিনিই, কিন্তু উদ্ভট নিয়মের কারণে সেবারও ফিরে আসতে হয়েছে শিরোপার হাতছোঁয়া দূরত্বে থেকেও।

তার বোলিংয়ের মূল অস্ত্র ইনসুইঙ্গার, নিয়মিত ১৪০ গতির পাশাপাশি ইয়র্কারও দিতে পারেন দারুণভাবেই। পাশাপাশি যোগ করুন মাঠে তার সরব উপস্থিতি, ফিল্ডার হিসেবে বিশ্বের অন্যতম সেরাদের একজন তিনি। দারুণ সব ক্যাচ কিংবা রান আউট করে সবসময় ব্যাটসম্যানদের তটস্থ করে রাখেন।

সবমিলিয়ে পরিপূর্ণ ক্রিকেটার তিনি। ইনিংসে শুরুতে কন্ডিশনের সুবিধা পেতে কিংবা ডেথ ওভারে রান আটকাতে তার জুড়ি মেলা ভার। গত কয়েক বছর ধরেই তিন ফরম্যাটেই বিশ্বের সেরা পেসারদের একজন তিনি। বন্ধু টিম সাউদি আর নেইল ওয়াগনারকে সাথে নিয়ে গড়েছেন পরিসংখ্যানে সর্বকালের সেরা টেস্ট বোলিং ত্রয়ী। একসঙ্গে খেলেছেন এমন ৩৬ ম্যাচে ৪৯০ উইকেট—টেস্ট ইতিহাসের যেকোনো পেসত্রয়ীর চেয়ে বেশি উইকেট এখন এই তিন ব্ল্যাক ক্যাপ বোলারের।

যতই ভালো খেলুক শিরোপা ছাড়া পূর্ণতা পায়না কোনো দলই। কিউইদের এই সোনালি প্রজন্মেরও যেন তীরে এসে তরী ডুবছিল বারবার। নিউজিল্যান্ড এবারের টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠার পর থেকে তাই এই কথাগুলো ভাসছিল বারবার।

কিন্তু, সব সমালোচনার জবাব দিলেন ফাইনালেই। ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে নেন পাঁচ উইকেট। নিউজিল্যান্ড জেতে পরম আরাধ্য চ্যাম্পিয়নের খেতাব। প্রথম টেস্ট জিততে যাদেরকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২৬ বছর, সেই তারাই কিনা জিতে নেয় প্রথম টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপ।

টেস্ট কিংবা ওডিয়াইয়ের পাশাপাশি টি-টোয়েন্টিতেও সমান সফল এই তারকা। আইপিএলে হায়দ্রাবাদ – কলকাতা ঘুরে থিতু হয়েছেন মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সে। বুমরাহকে সাথে নিয়ে মুম্বাইকে জিতিয়েছেন টানা দুই আইপিএল শিরোপা। ২০২০ মৌসুমে নিয়েছিলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ ২৫ উইকেট।

সাদা পোশাকের ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত ৭৩ ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ২৯২ উইকেট। ইনিংসে আটবার পাঁচ উইকেটের পাশাপাশি ম্যাচে দশ উইকেট নিয়েছেন একবার। এছাড়া ৯৩ টি একদিনের ম্যাচ খেলে তার শিকার ১৬৯ উইকেট। ৩৪ টি টি-টোয়েন্টি খেলে ব্যাটসম্যানদের সাজঘরে পাঠিয়েছেন ৪৬ বার। ধুমধারাক্কা টি-টোয়েন্টি এবং ব্যাটসম্যানদের এই সময়ে ক্রিকেট খেলে সবটুকু আলো নিজের দিকে টেনে নেয়া ট্রেন্ট বোল্ট এভাবেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাবেন আরো কয়েকবছর, ক্রিকেট ভক্তদের চাওয়া এটাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link