More

Social Media

Light
Dark

জ্যোৎস্নার যে জৌলুস নেই, স্থায়িত্ব আছে

সিডনির সকাল। কয়েক হাজার মেইল দূরে আড়মোড়া ভাঙছে শহর কলকাতা। অজি সফরের তৃতীয় টেস্ট। ছোটে ওস্তাদের অধিনায়কত্বে ভারত পাড়ি জমাল ডনের দেশে। প্রথম ইনিংস ১৫০ রানে শেষ।

এদিকে জাস্টিন ল্যাঙ্গার আর রিকি পন্টিংয়ের দাপটে অজিদের স্কোরবোর্ড ৫৫২ ছুঁয়ে গেছে। ম্যাচ পকেটে পুরতে ডিক্লেয়ার দিলেন স্টিভ। দ্বিতীয় ইনিংসে ভারত ব্যাট করতে নামতেই শুরু হল ত্রিমুখী আক্রমণ। তিন স্লিপ এক গালি, লাল পালিশের চকচকে বলটা হাতে দৌড়ে আসছেন গ্লেন ম্যাকগ্রা আর ড্যামিয়ান ফ্লেমিং।

গিলির চিৎকার, স্লিপ থেকে পান্টারের স্লেজিং এর সামনে দুই ভারতীয় ওপেনার। এম এস কে প্রসাদ আর গোবেচারা চেহারার হায়দ্রাবাদি তরুণ। তৃতীয় পেসার হিসেবে আছেন ব্রেট লি। ম্যাকগ্রার দ্বিতীয় ওভারেই একটা বল পা বাড়িয়ে দুরন্ত টাইমিং করে কভার ড্রাইভ করে দিলেন। পন্টিং-ম্যাকগ্রার আত্মশ্লাঘায় প্রথম আঘাত।

ads

এদিকে অন্য দিকে উইকেট খোয়ানো শুরু। ম্যাচ ক্রমশ ঢলছে ব্যাগি গ্রিনের দিকে। ক্রিজে শচীন টেন্ডুলকার এলেন, সৌরভ গাঙ্গুলি এলেন। অন্য এন্ডে লক্ষ্মণ অনড়। রাগটা বেরিয়ে এল পিজিয়নের।

স্টিভের নির্দেশেই একটা ঘাতক বাউন্সার ছুঁড়ে দিলেন ভিভিএস লক্ষ্মণের দিকে। চোয়ালের তলায় যত জোরে ধাক্কা মারল লাল বলটা তার দ্বিগুন জোরে যেন চোয়াল শক্ত করে নিলেন ভারতের ‘ভেরি ভেরি স্পেশাল ওয়ান’। পরের দুটো ওভার লাগাতার ঐশ্বরিক টাইমিং আর নিখুঁত টেকনিকে পিজিয়নকে পাঠালেন মাঠের বাইরে।

লি এলেন। ভারতের রথী-মহারথীরা সিডনির পিচে বেকায়দায় পড়ে একের পর এক সার বেঁধে প্যাভিলিয়ন ফিরে গেলেও এই একটা খুঁটি যেন কাঁটা হয়ে রইল অজি সাম্রাজ্যের বুকে। শেন ওয়ার্নকে দু পা এগিয়ে স্ট্রেট ব্যাটে তিনবার তুলে দিলেও শেষ রক্ষা হল না। ১৬৭ রানে থামতে হল স্পেশাল ওয়ানকে। ভারতের ইনিংস হার।

কিন্তু নব্বই-এর নৃশংস অজি আলেক্সান্ডারের সামনে অকুতোভয় পুরু হয়ে থেকে গেলেন এই হায়দ্রাবাদি ক্রিকেট বিষ্ময়। ইডেন থেকে মেলবোর্ন, ভারতের সমস্ত দরজা বন্দ হয়ে গেলে জাদুকাঠি হাতে অনন্তের পথ খুলে দিত এক একটা কভার ড্রাইভ আর পুল।

ইডেনের ঐতিহাসিক কামব্যাক হয়ত ভিভিএসকে একটা মাইলস্টোন দিয়েছিল কিন্তু একজন লক্ষ্মণকে চিনতে হলে একটা ইডেন টেস্ট নয়, দেখতে হয় তার নিজেকে জাতীয় পতাকার ওপর চাদরের মতো বিছিয়ে দেওয়া ক্রিকেট প্রতিভাকে। শচীন-সৌরভ-দ্রাবিড়ীয় সভ্যতায় লক্ষ্মণ নেই। থাকবেন ও না। থাকার কথাও বলেন না কেউ।

২০০৩ বিশ্বকাপের দল নির্বাচনে যেদিন শেষমুহুর্তে দীনেশ মঙ্গিয়াকে নিয়ে বাদ দিয়ে দেওয়া হল তাঁকে মিষ্টি হেসেছিলেন ভিভিএস। তিনি বুঝেছিলেন রামরাজত্বে লক্ষ্মণদের এভাবেই বেঁচে থাকতে হয়। ক্যাপ্টেন সৌরভ তাই হয়ত বলেই ফেলেছিলেন-  ‘আ রঙ ডিসিশন অফ মাইন।’ এখানেই হয়ত অনেকটা পাওয়া লুকিয়ে ছিল লক্ষ্মণের।

তিনি গম্ভীরের মতো দেশকে বিশ্বকাপের মঞ্চে বুক চিতিয়ে লড়িয়ে দিতে পারেন নি, একদিনের ক্রিকেটে ছয়টা সেঞ্চুরি নিয়েও একটা বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ হল না লক্ষ্মণের। তাতে আক্ষেপ করলে হয়ত শেন ওয়ার্নকে ওই স্টেপ আউটটা করা হত না। হয়ত আজও অস্ট্রেলিয়া ভারতের বিপক্ষে খেলতে নামলে মনে মনে ঐ ইডেনের দুঃস্বপ্নের কথা ভাবত না।

ভারতকে টেল এন্ডারদের সাথী করে টেস্ট ক্রিকেটে একটার পর একটা ম্যাচ জিতিয়ে যাওয়া নিশ্চুপ প্রহরী হয়ত এভাবেই গুটিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। জ্যোৎস্নার যে জৌলুস নেই, স্থায়িত্ব আছে।

জৌলুস আর রাজকীয়তায় মোড়া ভারতীয় ক্রিকেটে রামদের রত্ন সিংহাসনে বসতে পারেন না লক্ষ্মণ। সবুজ গালিচা ঘেঁষে ছুটে যাওয়া লাল বলটা শুধু জানত কোন জাদুকর তাকে ঠেলে দিয়েছিল শিল্পের পসরা করে। কোন ঐশ্বরিক টাইমিং ভারতকে পার করে দিত টেস্টের একটার পর একটা হার্ডল। কোন মন্ত্রবলে ক্রিকেটের রূপরসগন্ধ গড়ে দিয়েছিল ভারতের দ্য ভেরি ভেরি স্পেশাল ওয়ানকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link