More

Social Media

Light
Dark

আফিফের ‘স্পেশালিটি’

এই মুহুর্তে বাংলাদেশ দলে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সবচেয়ে কার্যকর ব্যাটসম্যানের নাম আফিফ হোসেন।

এটা নিয়ে খুব বেশি বিতর্কের বোধহয় সুযোগ নেই। অল্প সময়েই আফিফ ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটটায় নিজেকে প্রমাণ করেছেন। এই বিশ্বকাপেও বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইন আপ তাঁকে কেন্দ্র করেই হতে পারতো এবং তাই হওয়া উচিৎ ছিল। তবে আমাদের মনে হয় সেই পরিকল্পনায় কিছু ঘাটতি থেকে গেল।

প্রথমে আফিফ কেমন ব্যাটসম্যান সেদিকে একটু নজর দেয়া যাক। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ দুইটা টি-টোয়েন্টি সিরিজে আফিফ কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন সেটা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। মিরপুরের যেই উইকেট নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা, যেখানে প্রতিটা রানের জন্য দুই দলের সেরা ব্যাটসম্যানদের রীতিমত লড়াই করতে হচ্ছে সেখানেও আফিফ সুন্দর ও সাবলীল।

ads

আফিফের এই সাফল্যের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে তিনি বাড়তি কিছু করতে চাননি। নিজের স্বাভাবিক ব্যাটিংটাই করেছেন। আর এই ধরনের পিচে আপনি চাইলেও খুব বেশি কিছু করতে পারবেননা। সাকিব আল হাসানের মত ক্রিকেটারও বলছেন এই পিচে ১০-১৫ টা ম্যাচ খেললে একজন ব্যাটসম্যানের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে।

তবে এই পিচেই শেষ দশ ম্যাচে আফিফের ব্যাটিং দেখে তা বোঝার উপায় নেই। আফিফ মূলত বিজি ক্রিকেটার। তিনি পুরো মাঠ ব্যবহার করতে পারেন। মাঠের চারপাশে কোথায় কতটুকু গ্যাপ আছে সেগুলো ভালো করে লক্ষ্য করেন এবং ব্যবহার করেন। মিরপুরে যেমন তিনি সিংগেলস কিংবা ডাবলসের দিকে বেশি নজর দিয়েছেন। গ্যাপে কিংবা সফট হ্যান্ডে খেলে দুই রান বের করেছেন। জোর করে বাউন্ডারি মারতে চাননি। এটাই আফিফের স্বভাবসুলভ ব্যাটিং।

এখানে আমরা একটা জিনিস গুলিয়ে ফেলি। ঘরোয়া ক্রিকেটে কিংবা শেষ দুইটা সিরিজেও আফিফের স্ট্রাইকরেট বেশ প্রশংসনীয়। মিরপুরে অন্য ব্যাটসম্যানরা যেখানে ৮০-৯০ স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করেছে সেখানে আফিফ গড়ে প্রায় ১২০-১৩০ স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করেছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটেও অন্য ব্যাটসম্যানদের তুলনায় তিনি স্ট্রাইকরেটে অনেক এগিয়ে থাকেন।

আফিফের এই স্ট্রাইকরেটে এগিয়ে থাকার মূল কারণ আমাদের বোঝা জুরুরি। বাংলাদেশের অন্য ব্যাটসম্যানদের স্ট্রাইকরেটে পিছিয়ে যান মূলত ডট বলের কারণে। আমাদের ব্যাটসম্যানরা অনেক বেশি ডট বল খেলেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে যা রীতিমত ক্রাইম। ১২০ বলের ম্যাচে যদি ৩০-৪০ বল ডট হয়ে যায় তখন বড় রান করা আর সম্ভব হয়না। তখন ব্যাটসম্যানদের বাউন্ডারির প্রতি ঝুকতে হয়। বাড়তি রিস্ক নিতে হয়। ওদিকে আমাদের ব্যাটসম্যানদের কেউই তেমন পাওয়ার হিটার না যে জায়গায় দাঁড়িয়ে চার-ছয় মারবেন। ফলে ব্যাটসম্যান ও দল চাপে পড়ে যায়।

ওদিকে আফিফ নিয়মিত স্ট্রাইক রোটেট করতে থাকেন। ফলে স্কোরবোর্ড সচল থাকে। উল্টো প্রতিপক্ষের বোলাররা চাপে পড়ে যায়। এতে করে অপর প্রান্তের ব্যাটসম্যানও স্বচ্ছন্দে ব্যাট করতে পারেন। অর্থাৎ আফিফের শুধু নিজে রান করেন সেটাই না বরং অন্য ব্যাটসম্যানদের কাজটাও সহজ করে দেন। আফিফের আরেকটা বড় গুন তিনি তাঁর শক্তির জায়গায় বল পেলে সেগুলোকে বাউন্ডারি ছাড়া করতে ভুল করেন না।

ফলে আফিফের স্ট্রাইকরেটটা অন্য ব্যাটসম্যানদের তুলনায় অনেক বেশি থাকে। এবং আফিফ যতক্ষণ ক্রিজে থাকেন ততক্ষন প্রতিপক্ষ দলের বোলারদের কাজটাও কঠিন হয়ে যায়। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটায় তিনি ৩৩ বলে করেছে ৪৯ রান। স্ট্রাইকরেট ১৫০ ছুঁই ছুঁই।

বিশ্বের যেকোন পিচে যা দারুণ ইনিংস। অথচ এই ইনিংসটিতে কী তিনি খুব বেশি স্লগ করেছেন? তাঁর ব্যাটিং দেখে কী মনে হয়েছে তিনি দ্রুত রান তুলতে চান? তিনি তাঁর স্বাভাবিক ব্যাটিংটাই করে গিয়েছেন। বাজে বল পেলে সীমানা ছাড়া করেছেন। এটাই আফিফের স্পেশালিটি।

৪৯ রানের এই ইনিংসটিতে ছিল ৩ টি ছয় ও ২ টি চার। অর্থাৎ ৫ টি বাউন্ডারি থেকে এসেছে ২৬ রান। বাকি ২৮ বলে তিনি করেছেন ২৩ রান। অর্থাৎ যেই বল গুলোতে বাউন্ডারি পাননি তাঁর মোটামুটি সবগুলোতেই রান বের করেছেন। ফলে তাঁর স্ট্রাইকরেট কমে যায়নি। এখন তাঁর এই স্ট্রাইকরেটকে আমরা ভুল ভাবে বিচার করি।

তাঁর দারুণ স্ট্রাইকরেট দেখে আমরা তাঁকে স্লগার ভেবে ফেলি। তিনি বিজি ক্রিকেটার কিন্তু স্লগার না। তিনি ইনিংস বিল্ড আপ করতে পারেন তবে তাঁকে দিয়ে চার-ছক্কা মারাতে চাইলেই সমস্যা। তিনি চার ছক্কার বন্যা ছাড়াই আপনাকে ১৪০-১৫০ স্ট্রাইকরেটে রান এনে দিবেন। তবে তাঁকে সময় দিতে হবে বাইশ গজে। তিনি বাইশ গজে যত বেশি সময় থাকবেন তাঁর স্ট্রাইকরেট তত বাড়বে।

তবে আমরা তাঁকে স্লগার ভেবে পাঠাচ্ছি ৬-৭ নম্বরে। শেষ মুহূর্তে নেমে তাঁকে বাউন্ডারির জন্য খেলতে হচ্ছে। নিজের স্বভাবসূল্ভ ব্যাটিংটা করতে পারছেন না। কিছুদিন আগে ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি বলেছেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে আপনার সেরা ব্যাটসম্যানদের বেশি বল খেলতে দিতে হবে। রোহিত শার্মার সাথে দলে শিখর ধাওয়ান কিংবা লোকেশ রাহুলের মত প্রমাণিত ওপেনার থাকার পরেও কোহলি নিজে ওপেন করার কথা বলেছিলেন।

কেননা খেলাটা মাত্র ১২০ বলের। আপনার দলের সেরা ব্যাটসম্যান যেন তাঁর পুরো সময়টা পায় সেটা নিশ্চিত করা জরুরি। আফিফ তাঁর ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই টপ অর্ডারের ব্যাটসম্যান। জাতীয় দলেও আফিফকে সেখানেই দেখতে চাই। এখানে অবশ্য আফিফকে ওপেন করানোর দাবিও উঠতে পারে। তবে আমি সেদিকে যেতে চাই না। ওপেনারদের উপরও পাওয়ার প্লে ব্যবহার করার একটা চাপ থাকে। বাউন্ডারি বের করার চেষ্টা করতে হয়।

আমি আফিফকে দ্রুত রান তোলার কোন চাপই দিতে চাই না। সেটা ইনিংসের একেবারে শুরুতেও না আবার শেষেও না। তাঁর ব্যাটিং করার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা তিন নম্বর পজিশন। তা নাহলে হয়তো চার নম্বরে। এর নিচে আফিফকে পাঠানো মানেই তাঁকে দ্রুত রান তোলার  চাপে ফেলা। আফিফকে চাপমুক্ত ভাবে খেলতে দেয়া গেলেই বরং তিনি আরো দ্রুত রান করবেন। আফিফের স্বভাবসুল্ভ ব্যাটিংটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link