More

Social Media

Light
Dark

তুই শুধু ব্যাটিং কর!

হলুদ জার্সির অজিরা তখন বিশ্বক্রিকেটে আতঙ্কের নাম। বাংলাদেশের মত দূর্বল শক্তির দলের কাছে তো এই আতঙ্ক কয়েকগুণ বেড়ে মহা আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়ায়। অজিদের বিপক্ষে হারলেও সমস্যা নাই, খেলতে পারলেই খুশি! এমন অবস্থাই ছিলো তখন বাংলাদেশ ক্রিকেটে।

হেভিওয়েটরা আবার দূর্বল দলের বিপক্ষে মাঠে নামা তো দূরের কথা, দ্বিপাক্ষিক সিরিজের প্রস্তাব পেলেই নাকচ করে দিতে দু’বার ভাবেননা। সেই হিসেবে ত্রিদেশীয় সিরিজে যে একত্রে দুই হেভিওয়েট ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাঠে নামতে পারবে তাই সিরিজ শুরু হওয়ার আগে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বলে অনুমান করা হচ্ছিলো বাংলাদেশের জন্য।

প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির  খাতা যে কখন দীর্ঘ আবার কখন সংকীর্ণ হবে তা তো পূর্বানুমান করা সম্ভব নয়। ভাগ্যের লিখন সামনে এলে তবেই উত্তর মেলে, আসলেই অনুমান করা গিয়েছিলো কিনা। তবে ২০০৫ সালে ন্যাটওয়েস্ট সিরিজে যে অনুমান করা যায়নি বা অনুমান করার অংশটুকু ভুল ছিল!

ads

তার প্রমাণ পাওয়া গেছে সিরিজের মাঝপথেই। সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে প্রথম মাঠে নামে বাংলাদেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। শক্তিশালী অজিদের বিপক্ষে পুরো একশো ওভারের ক্রিকেট বাংলাদেশের পক্ষে খেলা সম্ভব হবে কিনা! এ নিয়ে শঙ্কা ছিলো পাহাড়সম।

তবে প্রথম শঙ্কা উড়িয়েছে মাশরাফি, টস হেরে বোলিংয়ে যখন বাংলাদেশ। দ্বিতীয় বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে সে যুগের আগ্রাসী ওপেনার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। আধুনিক ক্রিকেটেও ছিলেন তিনি সমান আগ্রাসী। তিন নম্বরে অধিনায়ক রিকি পন্টিং ক্যারিয়ারে আর কখনো এতোটা কষ্ট করেছেন কিনা  তা আমার জানা নেই! ১৬ বল মোকাবেলা করে তাপস বৈশ্যের কাছে পরজিত হওয়ার আগে রানের খাতায় সংখ্যা কেবল ১। গিলক্রিস্ট ও পন্টিং যথারীতি ০ ও ১ রানে ফিরে গেলেও দমানো যায়নি অস্ট্রেলিয়াকে।

সে যাই হোক, কথা বলতে চাচ্ছি সেদিনের ম্যাচ জেতানো আশরাফুল-সুমন জুটি নিয়ে। আশরাফুল একা বাহবা পেলেও আড়ালে হারিয়ে গেছে অধিনায়ক সুমনের হার না মানা লড়াকু ৪৭ রানের ইনিংসের গল্প৷ দল আর আশরাফুল বাহবার সাগরে ভাসলেও, সুমনের সেই ইনিংস পায়নি পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা। অধিনায়ক হিসেবে সুমন অনেকখানি সফল হলেও, এ ইনিংস সুমনকে দিয়েছে বিশেষ মর্যাদা।

অস্ট্রেলিয়া কতটা নির্ভার ছিলো সেদিন! তা স্কোরকার্ড দেখলে সহজেই বোধগম্য। শুরুর ২৫ রানেই তারা তুলে নেন দুই ব্যাটসম্যানকে। ৭২ রানের মাথায় তিন উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ। চার নম্বর পজিশনে ব্যাটিংয়ে আসেন আশরাফুল। পঞ্চাশ ম্যাচ খেলেও তিনি ছিলেন শতকশূণ্য। অন্যপ্রান্তে অধিনায়ক হাবিবুল বাশার। তাদের প্রথম দায়িত্ব ছিলো মাঠে টিকে থাকা। রানের চাকা যদি সচল রাখা যায় তাহলেই কিছু সম্ভব, দ্রুত তিন উইকেট হারানো অবস্থা থেকে এছাড়া আর কোনো উত্তরোনের উপায় ছিলোনা।

কিন্তু এই ভয়কে উপেক্ষা করে আশরাফুল আর হাবিবুল বাশার যা করলেন! তা এখন পর্যন্ত ইতিহাস হয়ে থাকলো এদেশের ক্রিকেটে। বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের আকাশ থেকে মাটিতে টেনে নামান তারা দুজন মিলে। ম্যাকগ্রা, গিলেস্পি আর ব্র‍্যাড হগের সামনে শির উঁচু করে লড়ে গেছেন তারা। আশরাফুল তো সেদিন নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান পুরোপুরি। ভিন্ন এক আশরাফুলের সন্ধান মিলেছিলো। অজি বোলারদের শাসন করে কার্ডিফের সবুজ গালিচায় আশরাফুল ও হাবিবুল বাশার গড়লেন ১৩৩ রানের জুটি।

কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেন ছাড়িয়ে বঙ্গের অলি-গলি জয়ের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিলো এই জুটির কল্যাণেই। অধিনায়ক সুমন মাত্র তিন চারের সহায়তায় ৪৭ রান করেন। যা প্রমাণ করে কতোটা ধৈর্য্য আর ঝুঁকি থেকে বেঁচে থাকার জন্য তিনি ব্যাটিং করেছেন।

অপরপ্রান্তে তরুণ আশরাফুলকে রুখে দেওয়ার কেউ ছিলনা, বছর চারেক আগে অভিষেক টেস্টে নিজের জাত তিনি চিনিয়েছিলেন। তাই তার সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন মোটেও ছিলোনা। তাই ম্যাকগ্রা, গিলেস্পি আর ব্র‍্যাড হগকে খেলা আশরাফুলের কাট, পুল, সুইপ, প্যাডেল সুইপের দৃশ্য এখনও লেগে আছে চোখের কোনায়।

দীর্ঘদিন জাতীয় দলে খেলে এবং অধিনায়কত্ব করে পুরোদমে পরিপক্ব এক ক্রিকেটার সুমন। তাই বাইশ গজে আশরাফুলের উত্তেজনা ও উন্মাদনায় লাগাম টেনে রেখেছিলেন বড় ভাই সুমন। প্রতি ওভার শেষে পিচের মাঝখানে কথা বলতে গিয়ে আশরাফুল বারবার সুমনকে বলছিলেন — ‘সুমন ভাই এই ম্যাচ জিততে হইবো।’

বারবার সুমনের এক জবাব — ‘ম্যাচ জিতা লাগবোনা, তুই শুধু ব্যাটিং কর।’ অর্থ্যাৎ জয়ের চিন্তা পরে, ব্যাটসম্যানের কাজ ব্যাটিং করা, তাকে এই দায়িত্ব আনন্দ নিয়ে করতে হবে। নিজের মত করে সাজিয়ে নিতে হবে। তাহলেই ম্যাচ সহজ হয়ে আসবে। জয় আপনা-আপনি ধরা দিবে। আশা করি সুমনের সেদিনের কথা বুঝতে এখন আর কারো সমস্যা হচ্ছেনা।

যদিও আশরাফুলের আগে সাজঘরে সুমন-ই ফিরে গিয়েছিলেন রানআউটে কাটা পড়ে। তবে আশরাফুল তার ব্যাটিং আনন্দ নিয়ে করেছেন। গ্যালারিকে থমকে দিয়েছিলেন। ধারাভাষ্যকাররা তো বন্দনা দিয়েই যাচ্ছিলো। চিন্তিত প্রতিপক্ষ অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়ের হাতের নখ সকল অত্যাচার সহ্য করেছে দাঁতের কামড়ে।

সুমনের বিদায়ের ৪ ওভার পরেই আশরাফুল শতকের স্বাদ পান। উইকেটের পেছনে গিলক্রিস্টের হাত-তালির দৃশ্য কেউ ভুলে যায়নি। শতকের পরের বলে আউট হয়ে ফিরে গেলেও জয় সেদিন ধরা দিয়েছিলো। ইতিহাসে প্রথমবারের মত অজিদের হারায় বাংলাদেশ ৫ উইকেটে।

আশরাফুল-সুমন জুটি ভেঙে গেলেও পরের ১৭ বলে ২৩ রানের কঠিন পথ সহজেই উৎরে যান রফিক ও আফতাব মিলে। লেগ সাইডে আফতাবের মারা ছয় তো এখনও সবার চোখে লেগে আছে। কঠিন পথ বলেছি, কারণ — তৎকালীন বাংলাদেশ দলের সামর্থ্য ছিলোনা বলের চেয়ে ৫-৬ রান বেশি করার। কিন্তু সেদিন সব ইতিহাস ব্যতিক্রম হয়ে যায়। তাই এই জয় এখনও আলোচিত হয়।

এই জয়ের গল্প উঠে এলে বাহবা পায় আশরাফুল। পর্যাপ্ত প্রশংসা করা হয় না সুমনের। কিন্তু তিনিও কোনো অংশে কম ছিলেন না। ম্যাচ জেতাতে তার ব্যাটিং, আশরাফুলের সাথে জুটিতে সহায়তা, অধিনায়কত্ব কিংবা ‘ম্যাচ জিতা লাগবোনা, তুই শুধু ব্যাটিং কর’ এই  মানসিকতার কারণেই সেদিন জয় সহজ হয় বাংলাদেশের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link