More

Social Media

[ivory-search id="135666" title="Post Search"]
Light
Dark

ছোট্ট ডাইনির জাদুর বই

স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন তাঁর অটোবায়োগ্রাফিতে লিখেছেন, ‘ভেরন ছিলেন বিশাল স্ট্যামিনাধারী একজন অসাধারণ খেলোয়াড়।’

শুধু যে ফার্গুসন এমন কথা লিখেছেন তা নয়। তিনি রীতিমত হুয়ান সেবাস্তিয়ান ভেরনের জন্য সাংবাদিকদের গর্দভ বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন ভরা মজলিশে।

হুয়ান সেবাস্তিয়ান ভেরন, একজন আর্জেন্টাইন ফুটবল খেলোয়াড়। ১৯৭৫ সালে নয় মার্চ তিনি জন্মেছিলেন আর্জেন্টিনার লা পালাটা নামক স্থানে। বাবা হুয়ান রেমন ভেরনও ছিলেন একজন পেশাদার ফুটবলার। বাবার কাছ থেকেই হয়ত ফুটবলের প্রাথমিক দীক্ষাটা পেয়েছিলেন সেবাস্তিয়ান ভেরন। তবে সে দীক্ষা তাঁকে তাঁর বাবাকে ছাড়িয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনে।

ads

বলের উপর অসাধারণ দখলের ফলে বাবা রেমন ভেরন পেয়েছিলেন ‘লা ব্রুজা’ তকমা। স্প্যানিশ এই শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ ডাইনি। বাবার দেখানো পথে হাঁটা সেবাস্তিয়ান ভেরন পরবর্তী সময়ে পেয়েছিলেন ‘লা ব্রুজিতা’ তকমা। বাংলায় যার মানে ছোট ডাইনি।

বাবার মতই বলের উপর দারুণ দখল ছিল সেবাস্তিয়ান ভেরনের। খেলোয়াড়ি জীবনে মধ্যমাঠ আগলে রাখতেন তিনি। আক্রমণ সাঁজানো থেকে শুরু করে রক্ষণে সাহায্য করার কাজটা দারুণভাবে সামাল দিতেন সেবাস্তিয়ান।

হুয়ান সেবাস্তিয়ান ভেরন আলো ছড়িয়েছেন ইউরোপের ফুটবলে। যাত্রাটা শুরু হয়েছিল ইতালি থেকে। তবে ফুটবলের হাতেখড়ি অথবা পায়েখড়ি জন্মস্থানের ক্লাব এস্তুডিয়ান্তেসে। যেই ক্লাবের কাছে তাঁর বাবা রেমন ভেরন ছিলেন ব্রাজিলিয়ান ক্লাব সান্তোসের পেলের মত। সে ক্লাবটা তাঁকে সুযোগ দিয়েছিল আর সেবাস্তিয়ান ভেরন সেই সুযোগের প্রতিদান দিতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি।

সেবাস্তিয়ান ভেরন যখন সবেমাত্র কিশোর খেলোয়াড় হিসেবে ক্লাব ফুটবলে নিজের আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায় ঠিক তখন এস্তুডিয়ান্তেস আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ ফুটবল লিগ থেকে অবনমনের সাক্ষী হয়। ঠিক তাঁর পরের মৌসুমেই ক্লাবের প্রথম দলের হয়ে খেলা শুরু করেন সেবাস্তিয়ান ভেরন এবং ক্লাবকে আবার ফিরিয়ে আনেন প্রিমিয়ার ডিভিশনে।

বাবার মত শৈশবের ক্লাবকে চাইলেই আঁকড়ে ধরে থাকতে পারতেন সেবাস্তিয়ান। তবে না তিনি চেয়েছিলেন উড়ে বেড়াতে, ফুটবলের অসীম আকাশে। সে পরিকল্পনা থেকেই আর্জেন্টিনার প্রতাপশালী ক্লাব বোকা জুনিয়রে নাম লেখান হুয়ান সেবাস্তিয়ান ভেরন।

তাঁদের হয়ে এক মৌসুমে ১৭ ম্যাচ খেলেন। তারপর তিনি নিজেকে নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়ে হাজির হন ইতালির ক্লাব স্যাম্পোডোরিয়াতে। সেখান থেকেই তাঁর উত্থানের শুরু। সেখানেই তিনি পরিচিত হন তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা কোচ সোভেন-গোরান এরিকসনের সাথে। তাঁর দিক নির্দেশনায় এবং যত্নে তরুণ সেবাস্তিয়ান ভেরন নিজের সামর্থ্যের সন্ধান পান।

সেবাস্তিয়ান ভেরন ছিলেন একজন সুদক্ষ মিডফিল্ডার। তাঁর বুক যেন ছিল বিশাল বড় কোন ঘর। যেখানে টনকে টন বাতাস আটকে থাকে। পুরো নব্বই মিনিট সমানতালে খেলে যেতে পারতেন তিনি। তাছাড়া দলের প্রয়োজন মাফিক অ্যাটাক কিংবা ডিফেন্স সব খানেই ছিল তাঁর বিচরণ।

ভার্সেটাইল একজন মধ্যমাঠের খেলোয়াড় সেবাস্তিয়ান ভেরন মূলত একজন প্লে-মেকার হিসেবেই বেশি ব্যবহৃত হয়েছেন তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ারে। পাঁচ মৌসুম তিনি কাটান ইতালিতে। স্যাম্পোডোরিয়া থেকে পার্মা হয়ে লাজিওতে শেষ হয় তাঁর ইতালিয়ান পর্ব। এই পাঁচ মৌসুমে তিনি ১৮৯টি ম্যাচ খেলেছেন। ২৫টি গোল করেছেন।

আসলে একজন মিডফিল্ডারকে গোল পরিসংখ্যান দিয়ে পরিমাপ করাটা অর্থহীন। তাছাড়া তাঁর মত প্লে-মেকারের দায়িত্বই থাকে গোল করার মত বলের জোগান দেওয়া। সে কাজটায় পটু ছিলেন সেবাস্তিয়ান ভেরন।

তাইতো স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের জহুরীর চোখ আর হেলাফেলা না করে ওল ট্রাফোর্ডে নিয়ে আসেন তাঁকে। ২০০১ সালের গ্রীষ্মকালীন দলবদলে তাঁর জন্য ২৮ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করে ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। এই বিশাল পরিমাণ অর্থ খরচে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয় রেড ডেভিল সমর্থকদের মাঝে সেবাস্তিয়ান ভেরনকে নিয়ে। তবে সব আলোড়ন মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই পরিণত হয় সমালোচনায়।

এটা সব সময় দাবি করা হয় ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের এক মহারণ। এখানের খেলার মান কিংবা গতি অন্য সব ইউরোপের লিগ গুলো থেকে অনেকটাই এগিয়ে। সেই গতির সাথে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন সেবাস্তিয়ান ভেরন।

তিনি সেখানে নিজেকে ঠিকঠাক মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে তাহলে কিসের জন্য এত অর্থ খরচ? প্রশ্নের বান তীব্র গতিতে ছুটে আসতে থাকে ফার্গুসনের দিকে।

ক্ষিপ্ত ফার্গুসন সাংবাদিকদের ভরা মজলিশে খোদ সাংবাদিকদেরই গর্দভ বলেও সম্বোধন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা সবাই হলে গর্দভের দল। সে যে একজন দারুণ ফুটবলার, এটা তোমরা বুঝবে না।’ রেড ডেভিল বসও দারুণ বিপাকে ছিলেন সেবাস্তিয়ান ভেরনকে নিয়ে।

দলের ফরমেশনে তিনিও যেন ফিট হচ্ছিলেন না খুব একটা। অগ্যতা তিনি যখনই খেলতে নামতেন একজন মুক্ত পাখি হয়ে উড়ে বেড়ানোর লাইসেন্স ছিল তাঁর। তিনি করতেনও তাই। তবুও খুব একটা যুতসই সময় তিনি পার করেছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ডেরায় সে কথা বলার সুযোগ নেই।

তিন মৌসুম ওল্ড ট্রাফোর্ডে কাটিয়ে তিনি তাই সিদ্ধান্ত নেন চেলসিতে যোগ দেওয়ার। চেলসির তৎকালীন সভাপতি রোমান আব্রাহামোভিচের আমলে ১৫ মিলিয়ন পাউন্ডে যোগ দেন চেলসিতে। তবে সেটা তাঁর জীবনের এক ভুল সিদ্ধান্ত ছিল সে কথা বেশ ক’বারই বলেছেন তিনি। তবুও ভাগ্যের লিখনতো আর চাইলেই পরিবর্তন করা যায় না।

চেলসি থেকে ধারে আবার গিয়েছিলেন ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানে। সেখানে দুই মৌসুম কাটিয়ে তিনি ফিরে যান শৈশবের ক্লাব এস্তুডিয়ান্তেসে। সেখানে ২০১৭ অবধি ফুটবল খেলেছেন তিনি। তাছাড়া ২০১০ বিশ্বকাপেও তিনি ছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনার তত্ত্বাবধানে থাকা আর্জেন্টিনা দলে।

আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে ৭২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন। আকাশী নীল জার্সিতে তাঁর করা গোলের সংখ্যা সাতটি। সিরি ‘এ’, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, উয়েফা সুপার কাপ জেতা হুয়ান সেবাস্তিয়ান ভেরন এস্তুডিয়ান্তেসের স্পোর্টস ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন।

২০১৬/১৭ মৌসুমে শেষ বারের মত তিনি নেমেছিলেন পেশাদার ফুটবল খেলতে। তারপর আর ফুটবলের সবুচ গালিচায় তাঁকে আর দেখা যায়নি খেলোয়াড় বেশে। নিশ্চয়ই তাঁর নেওয়া দূরপাল্লার শট, অসাধরণ সব ড্রিবলিং মিস করছেন তাঁর সমর্থকেরা। সময় যে সবচেয়ে বড় খেলোয়াড়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link