More

Social Media

Light
Dark

ধোনি ও মিয়াঁদাদ একই সূত্রে গাঁথা

একই দিনে দুই ভিন্ন গল্প। স্থান, কাল, পাত্র, প্রেক্ষাপট সব আলাদা। তবে গল্পের মূল উপজীব্য এক। সে গল্পের পেছনে যেমন অভিজ্ঞতা রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে দুইটি শান্ত মস্তিষ্কের কারুকাজ। দিনকতক আগেই ভারতের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে চেন্নাই সুপার কিংসের ব্যাটার মহেন্দ্র সিং ধোনি মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের তরুণ বোলার জয়দেব উনাদকাতের শেষ বলে চার মেরে দলকে ম্যাচ জেতান।

এটা হয়ত অধিকাংশ মানুষই দেখেছে। প্রায় হুবহু এক ঘটনা ঘটেছিল ক্রিকেট অঙ্গনে ১৯৮৬ সালে। সেবার ভ্যেনু ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ। সেখানটায় মুখোমুখি হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান। সে ম্যাচের শেষ বলে তরুণ চেতান শর্মার করা বল হাওয়ায় ভাসিয়ে মাঠ ছাড়া করেছিলেন পাকিস্তানের ব্যাটার জাভেদ মিয়াঁদাদ। তবে দুই ম্যাচের প্রেক্ষাপট যেমন ভিন্ন ঠিক তেমনি দুইটি ম্যাচের মাহাত্ম্যও ভিন্ন।

মিয়াঁদাদের সে ছক্কার উপর ভর করে বদলে গিয়েছিল ভারতে পাকিস্তানের মধ্যকার ক্রিকেটিয় সম্পর্ক। আর ধোনির আইপিএলে মারা বাউন্ডারি যেন খুবই সাধারণ এক ঘটনা, যা ধোনি সচারচরই করে আসছেন। তবে চল্লিশের ঘরের পদার্পণ করে এমন পারফরমেন্স নজর কাড়া স্বাভাবিক। তবে এই দুই ম্যাচ একটা বিষয় আমাদের মনে করিয়ে দেয়। ক্রিকেট খেলাটা আসলে পুরোপুরি শুধু ব্যাটিং কিংবা বোলিং দক্ষতার খেলা নয়।

ads

এই খেলাটা অনেকবেশি মস্তিষ্কের। এই খেলাটা অনেক বেশি বুদ্ধির। এই দুই ব্যাটার নিজেদের অভিজ্ঞতা ও ক্রিকেটিয় প্রজ্ঞা থেকে দুইটি ভিন্ন জয় বের করে নিয়েছেন। তাঁদের বিপক্ষে অপেক্ষাকৃত তরুণরা যখন খাবি খেয়েছেন তাঁরা তখন ছিলেন সাবলীল, শান্ত। তাঁরা তাঁদের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করা গেছেন প্রতিপক্ষ বোলারকে পড়ে দেখবার। সেকেন্ডের ফ্যাকশনে তাঁরা সে কাজটা দারুণভাবে করতে পেরেছিলেন।

ধোনি কিংবা মিয়াঁদাদ তাঁরা দুইজন পপিং ক্রিজে বেশ শান্ত স্বভাবের ব্যাটার। তাঁরা খুব বেশি নড়াচড়া করে বোলারকে দ্বিধায় ফেলে দিতে চাননা। বরং তাঁরা নিজেরা বোলারের প্রতিটা পদক্ষেপ আগে থেকেই পড়ে নেওয়া চেষ্টা করেন। এখানটায় ক্রিজে তাঁদের শান্তস্বভাব যতটা না বড় অবদান রাখে, তাঁর থেকেও বড় অবদান রাখে তাঁদের শান্ত মস্তিষ্ক। সে মস্তিষ্ক তাঁদেরকে খুব বেশি বিচলিত হতে দেয় না। তাঁরা সম্ভাব্য সবকিছুর ছক নিজেদের মাথায় কষে নিতে পারেন।

তবে সে সম্ভাবনার পরিমাপটা হয় সাময়িক। তাঁরা খুব দূরের কিছু নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করেন না। অনেকবারই বহু খেলোয়াড়দের বলতে শোনা যায় তাঁরা এমন স্নায়ুবিক চাপের মুহূর্তে শুধুমাত্র পরবর্তী বল নিয়েই চিন্তা করেন। সে বলকে নিয়ে পরিকল্পনার নীল নকশা করেন। তাঁদের মাথায় তখন ম্যাচ জিতলে কিংবা হারলে কি হবে সে চিন্তা থাকে না। তাঁদের কল্পনায় থাকে না তাঁদের সতীর্থরা ঠিক কি ভাবে উল্লাস করবে কিংবা মূর্ছে যাবে।

তাঁরা থাকেন নির্ভার। যেন এই একটি বল পাড়ার ক্রিকেটের টেস্ট বল। এখানটায় আউট হলেও যেন কোন ক্ষতি নেই। তাঁরা বরং এতসব চিন্তা বাদ দিয়ে খুজতে থাকেন সুযোগ। ঠিক কোথা দিয়ে আদায় করে নেওয়া যাবে একটা বাউন্ডারি কিংবা ঠিক কোথায় রয়েছে এক মস্তবড় গ্যাপ। টেবিল টেনিস খেলোয়াড়দের উপর চালানো এক গবেষণায় জানা যায় যে যদি কোন খেলোয়াড় ম্যাচ জয়ের চিন্তায় মশগুল হয়ে যায় অথবা ম্যাচ হারার ভয়ে থাকে তবে তাঁর সমগ্র মনোযোগ চলে যায় বলের উপর।

এই জায়গাটায় সবচেয়ে বড় ভুলটা হয়ে যায়। মনোযোগ সব সেই বলের উপর চলে গেলেই আর তখন কোন সুযোগের সন্ধ্যান করা হয়ে ওঠে না। প্রতিপক্ষ সে ফায়দা তুলে নিতে নিশ্চয়ই দুইবার চিন্তা করে না। ঠিক এখানটায় ধোনি কিংবা মিয়াঁদাদরা মাত করে দেন প্রতিপক্ষকে। তাঁরা যে সুযোগ সন্ধানী। তাঁরা নিজের বুদ্ধিমত্তাকে অতিরিক্ত ব্যস্ত করে ফেলেন না ম্যাচ পরবর্তী পরিস্থিতি চিন্তা করে।

একটু যদি ধোনি আর উনাদকাতের মধ্যকার সে ওভারটা পর্যালোচনা করলে বিষয়টা খানিক পরিষ্কার হবে হয়ত। শেষ চার বলে চেন্নাইয়ের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ১৬ রানের। ধোনিকে যখন প্রথম বলটা করলেন উনাদকাত সেটা করলেন ওভার দ্য উইকেট থেকে। সুতরাং তীর্যকভাবে ক্রস সিমের বল গিয়ে পড়লো ফুল লেন্থে। ধোনি শট দেখলেই বলে দেওয়া যায় যে তিনি আন্দাজ করে নিয়েছিলেন যে উনাদকাত সেরকম কোন বলই করতে চলেছেন। আর যেহেতু পরিস্থিতি এবং কোথায় ঠিক কতটা সুযোগ রয়েছে তা ধোনির জানা তিনি সপাটে মেরে দিলেন বল বোলারের মাথার উপর দিয়ে।

ব্যাস ঘাবড়ে গেলেন তরুণ উনাদকাত। যদিও তাঁকে বেশ বুদ্ধিমান বোলার হিসেবেই গণ্য করা হয়। আর টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তাঁর একটা আলাদা চাহিদাও রয়েছে। তাই তো জয়দেব উনাদকাতকে নিয়ে নিলামঘরে মোটামুটি লড়াই হয়। তবে তিনি তাঁর থেকেও বুদ্ধিমান একজনে বিপক্ষে ঠিক কতটা খেই হারিয়ে ফেলেন তাঁর প্রমাণ দিয়ে দিয়েছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। সাধারণত একজন পেস বোলার যখন ইনিংসের শেষ দিকে ফুলার লেন্থ বলে মার খান তখন স্বাভাবিকভাবেই তিনি স্লোয়ার বলের সহয়তা নেবেন।

উনাদকাত তাই করলেন। আর একজন অতি সাধারণ মানুষও যা আন্দাজ করতে পারবেন তা ধোনি পারবেন না এমনটা ভাবা ভুল। পপিং ক্রিজে শান্ত থেকে ফাইন লেগে থাকা ফিল্ডারের মাথার উপর দিয়ে চার আদায় করে নেন ধোনি। সমীকরণ তখন আরও কঠিন। চাপ আর যেন সইতে পারছিলেন না উনাদকাত। তবে অপরদিকে ধোনি ছিলেন ধীরস্থির। তিনি বাড়তি কিছু করার চেষ্টাই করেন নি। ধোনির কাছে সম্ভাব্য সকল সুযোগের তথ্য ছিল। উনাদকাতের প্রায় ইয়োর্কার লেন্থের বল স্বভাবচারিত ভাবে খেলেই তিনি আদায় করে নেন শেষ বাউন্ডারি। তাঁর সতীর্থরা যখন উৎসবে মাতোয়ারা তখন ধোনি স্থীর এবং সাবলিল।

অন্যদিকে মিয়াঁদাদের সেই ছক্কা প্রসঙ্গে খোদ মিয়াঁদাদ এক পত্রিকায় বলেছিলেন, ‘আমি পুরো মাঠটা একবার সার্ভে করে দেখে নেই। আর লেগ সাইডে থাকা খেলোয়াড়দের অবস্থান থেকে আন্দাজ করে নেই যে চেতান আমাকে একটা ইয়োর্কার বল করতে চলেছ। তাঁর আর কি ই বা করার ছিল? আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি একটু এগিয়ে দাঁড়াবো যাতে করে লেন্থে তারতম্য ঘটাতে পারি। তাই করলাম। আর এরপর আমার কাজটা আরও সহজ হয়ে গেল। আমি একটা জ্যুসি ফুলটস পেলাম আর সেটা মিড উইকেট এবং লং অনের মাঝ বরাবর মাঠ ছাড়া করতে আমার বিন্দুমাত্র বেগ পোহাতে হয়নি।’

যদিও ধোনি ম্যাচ শেষে কথা বলেননি। তবে মিয়াঁদেদের থেকে ভিন্ন কিছু হয়ত বলতেন না। ক্রিকেটের অগাধ জ্ঞান, পরিস্থিতি পড়তে পারার শক্তি আর শান্ত মস্তিষ্ক এইসব কিছু মিয়াঁদাদ ও ধোনির মত দুই ভিন্ন সময়ের ভিন্ন দুই খেলোয়াড়কে গেঁথেছে একই সূত্রে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link