More

Social Media

Light
Dark

হেমন্তের সেই মিষ্টি সকাল

ক্রিকেট কারও কাছে খেলা, কারও কাছে নিছক বিনোদন, কারও কাছে প্রাণ! যার কাছে যেটাই হোক, উপমহাদেশে ক্রিকেট এক সঞ্জীবনী সুধা, প্রণয়লীলার শেষদৃশ্যের কেতন কিংবা অর্ধচন্দ্রের পূর্ণিমা বিলাস!

উপমহাদেশের গন্ডি ছোট করে এনে বাংলাদেশে এসে ঠেকালে ক্রিকেটকে বলে দেওয়া যাবে ঐকতানের সুর! নোংরা রাজনীতি, প্রতিনিয়ত খুন, ধর্ষণ, নারী-নিরাপত্তাহীনতার এই দেশে সবাই এক হয়ে যায় একটিমাত্র কেন্দ্রবিন্দুতে- ক্রিকেটে! শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের গ্যালারি তখন প্রণয়িনীর কোল, হাঁটু ভাঁজ করে সাকিবের ক্রস ব্যাট চালানোর পরে পয়েন্ট আর কাভারের উপর দিয়ে উড়ে চলা বল তখন ‘আদর’!

কিন্তু ক্রিকেটের এই পথচলা সহজ ছিল না মোটেও! শুধুই কি ক্রিকেট, বাংলাদেশের পথচলাও কি সহজ ছিল? স্বাধীনতার পর অস্থিতিশীল এই দেশে যখন দেশরক্ষাই প্রধান নিয়ামক-কৃত্য হয়ে উঠছে, সেই সময় ব্যাট বলের একটি খেলায় নজর দেবার সুযোগ কিংবা ফুরসত যেকোনটিই মেলানো ভার! তবুও ক্লাব ক্রিকেটের হাত ধরে সেই সময়েও ক্রিকেট এগিয়েছে বেশ, ক্লাব কর্তারা ক্রিকেটকে এগিয়ে নেবার অন্তত চেষ্টাটুকু করেছে, আজকের বাংলাদেশে ক্রিকেটের চারা রোপণ করা হয়েছে!

ads

এরপর গুটি গুটি পায়ে ক্রিকেট এগোনো শুরু করেছে, ১৯৯০ সালের দিকে আতহার আলী খান ইডেন গার্ডেনে ম্যাচ সেরা হয়েছেন। সেই খবর কোন একদিন আরাম কেদারায় শুয়ে রেডিওতে শুনতে শুনতে কোন এক বৃদ্ধ হয়ত আজকের দিনের স্বপ্নটি বুনে ফেলেছিলেন। কিংবা কে জানে, ঐদিনই কোন এক প্রাইমারি স্কুলের মাঠে কাদামাটি মেখে তক্তা দিয়ে বানানো ব্যাট হাতে ক্রিকেট খেলা ছেলেটিও আজকের দিনের স্বপ্ন বুনতে পারে। আজকের দিনের স্বপ্ন বুনতে পারেন সেদিনই ছেলেটি বাসায় ফিরলে রান্নাঘর থেকে আঁচল কোমরে গুজে ‘কি ছাইপাশ খেলিস?’ বলে বের হওয়া মা’টিও!

ওদের সেই স্বপ্ন আজ ডালপালা মেলেছে, দিগন্ত প্রসারিত করে দিগ্বিদিক উড়ে চলেছে, সাথে ভার বয়েছে সাত কোটির, নয় কোটির, চৌদ্দ কোটির, ষোল কোটির!

ক্রিকেটে চাই আত্মত্যাগ, সেই আত্মত্যাগও পেয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট। টেস্ট আঙ্গিনায় যখন আমাদের পা ও পড়েনি তখন একজন ফারুক আহমেদ মাথা ফেটে রক্ত বের হবার পরও ব্যাট হাতে নেমে প্রমাণ করেছেন ‘আমরা থামতে আসিনি’।

কে বলতে পারে, ফারুক আহমেদের সেইদিনের প্রত্যয় ছিল আজকের দিনের প্রেরণা, যে প্রেরণা প্রত্যয় হয়ে রূপ নিতে শুরু করেছে অভিষেকে! সময় এগিয়েছে, ক্রিকেট এগিয়েছে, ফুটবল থেকে বঙ্গদেশের মানুষ দেখতে শুরু করেছে ক্রিকেট! একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে ব্যাপারটিতে খানিকটা মজা পাওয়া যায়। চাল নেই, চুলো নেই নিধিরাম সর্দার!

সেই নিধিরাম সর্দার দিয়েই কিনা এতগুলো মানুষকে টেনে ফেলা যায়? নিউজিল্যান্ডে যেখানে এখনও প্রচেষ্টা চলছে বেসবলের পাশাপাশি জনমনে ক্রিকেটটাকে ‘টিকিয়ে রাখতে’, সেখানে কোন ধরণের বহুজাতিক শিরোপা না জেতা বাংলাদেশ কিনা চাতক পাখির মত আশায় চেয়ে আছে এই ভেবে যে ‘একদিন আমরাও …’! হবে নাই বা কেন? নব্বই দশকের সেই বৃদ্ধ হয়ত পৃথিবী ছেড়েছেন, কিন্তু তাঁর বোনা স্বপ্নের বীজ কি একটু একটু করে অঙ্কুরিত হবে না?

এমনি করেই একদিন জিতে গেলাম আইসিসি ট্রফি! বঙ্গদেশের অবস্থা এত উন্নত নয়, আবার সহযোগী দেশগুলো নিয়ে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠেয় টুর্নামেন্ট টিভিতেও দেখানো হচ্ছিল না। উপায়? রেডিওর ধারাভাষ্য! একবার কল্পনা করে ফেলুন তো, উঠোনের মাঝে রেডিও রেখে তাঁর চারপাশে কয়েকজন লোক কান পেতে রেডিওর ধারাভাষ্য শুনছে! ‘বল মাটি কামড়ে সীমানায় …’ শোনার সাথে সাথেই হয়ত উল্লসিত ধ্বনিতে ফেটে পড়ছে, আজকের মিরপুরের ইস্ট গ্যালারির সূচনা এখান থেকেই হয়নি তা কে বলতে পারে?

আইসিসি ট্রফি পেরিয়ে বিশ্বকাপে পা রেখেছি। তখনকার ক্রিকেটে মাইটি পাওয়ার পাকিস্তানকে কিছু বুঝে ওঠার আগে হারিয়েও দিয়েছি! সারা বিশ্বকে যেন জানান দিয়েছি, তক্তা দিয়ে বানানো ব্যাটের ধারে স্বপ্নও হয়েছিল ধারাল, কয়েক শতক পরও তা মহানির্বাণ লাভের সূচনা অব্দি করবে না!

ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দেওয়া হল, ঘর ছাপিয়ে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের দুনিয়ায় পা দিতে পরীক্ষামূলক সফর হিসেবে আমরা খেলতে গেলাম সাগরিকার ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির টুর্নামেন্টে! আভিজাত্যের ফরম্যাটে অভিজাত ছাপ রাখতে না পারলেও ‘কোন রকমে সংসার চালানো কুলীন’ সম্প্রদায়ের ইঙ্গিত সেবার নিউজিল্যান্ডে দিয়ে ফেললাম! আইসিসির প্রতিনিধির একের পর এক বাংলাদেশ সফর হল, খেলাটির প্রতি এদেশের মানুষের আবেগ তাঁদের মন কাড়ল … অভিজাত শ্রেণিতে পা ফেললাম আমরা! এতে একজনের অবদান স্বীকার করতে হবে জোরেশোরেই- জগমোহন ডালমিয়া! কুলীন সেই শ্রেণিকে অভিজাত এলাকায় বাসের ব্যাবস্থা তো উনিই করে দিয়েছিলেন এক রকম!

দুই হাজার সাল! আমরা তখন টেস্ট খেলুড়ে দল! নাইমুর রহমান দুর্জয় যখন হাতে খেলোয়াড় তালিকা নিয়ে সৌরভ গাঙ্গুলির সাথে টস করতে নামছে ‘ছাইপাশ’ বলা ‘মা’ তখন বৃদ্ধা হয়ে গিয়েছেন, চোখে ঠিকমত দেখতে পান না! তবু তিনি আজ টিভি খুলে বসেছেন, চশমার ফ্রেমটা নাড়িয়ে চাড়িয়ে তাঁর ছেলেকে খুঁজে নেবার ব্যার্থ চেষ্টা করছেন!

আরাম কেদারায় শুয়ে স্বপ্ন বোনা সেই বৃদ্ধ তখন এ পারের মায়া কাটিয়ে চলে গিয়েছেন জীবন-নদীর ওপারে! তবুও ওপারে বসেই আজ তিনি তাকিয়ে রয়েছেন কয়েনটির দিকে, সেই আরাম কেদারায় বসেই!

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link