More

Social Media

Light
Dark

হাই ‘বোল্ট’ শক!

ফ্ল্যাশব্যাক। ২০০২ সালের ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অ্যান্টিগা টেস্ট। ব্যাটিংয়ের সময় মার্ভ ডিলনের এক বাউন্সারে মারাত্মকভাবে আঘাত পান অনিল কুম্বলে। চোয়ালে লাগার কারণে অসহনীয় ব্যথা স্বত্ত্বেও তিনি ব্যাটিংটা চালিয়ে গেলেন। ইনিংস শেষে দেখা গেল, চোয়ালটা তার ভেঙেই গেছে। সিরিজের বাকি অংশে তিনি যে আর খেলতে পারবেন না তা অনুমিতই ছিল। তাই সংবাদমাধ্যমকে সেটা অফিশিয়ালি জানিয়েও দেয়া হয়। এমনকি পরদিনই তার জন্য ফ্লাইটে টিকিট বুকিং করা হয়।

কিন্তু পরের দিন হঠাৎই সারা মুখে ব্যান্ডেজ বেঁধে বোলিং করতে নেমে পড়লেন অনিল কুম্বলে। একেক স্পেলে লম্বা সময় ধরে বোলিং করে গেলেন। সে ইনিংসে ভাঙা চোয়াল নিয়ে ব্রায়ান লারার উইকেটটি তিনিই নিয়েছিলেন। ক্রিকেটের এমন নিবেদনের ঘটনা আরো আছে। বাউন্সারের কারণে কিউই ব্যাটসম্যাম বাট স্যাটক্লিফের একবার খুব বাজেভাবে কানে লেগেছিলো।

ম্যাচ চলাকালীন তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তার তাকে ম্যাচটি না খেলার পরামর্শ দেন। কিন্তু স্যাটক্লিফ মাঠে ফিরে আসেন এবং আবারো ব্যাটিং করতে নামেন। শেষ পর্যন্ত ৮০ রানের একটা ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। যদিও সে ম্যাচটি জিতেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু বীরদর্পে বাট স্যাটক্লিফের সেদিনের ফিরে আসাটা এখনো স্মরণীয়।

ads

ক্রিকেটীয় নিবেদন নিয়ে কথার ডালপালা আরো ছড়ানো যাবে। তার আগে একটা নতুন খবরে দৃষ্টিপাত করা যাক। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন পেসার ট্রেন্ট বোল্ট। কেন্দ্রীয় চুক্তি শেষ হওয়া মানে, নির্বাচকদের এখন তার দেওয়া সময় অনুযায়ী দল নির্বাচন করতে হবে।

৩৩ বছর বয়সী এ পেসার বর্তমানে পেসারকে বেশি সময় দিতে চাচ্ছেন। তবে ধারণা করা হচ্ছে ফ্রাঞ্চাইজি লিগ খেলতেই তার এ সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েছে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটও (এনজেডসি)। বোর্ডের প্রধান নির্বাহী নিউজিল্যান্ডের সিইও ডেভিড হোয়াইট বলেছেন, ‘বোল্ট নিজের খেলার প্রতি সৎ। আমরা ওর সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই। বোল্ট চুক্তিতে না থাকায় দলের উপর প্রভাব পড়বে তা জানি। আগামী দিনের জন্য শুভেচ্ছা রইল।’

৩১৭ টেস্ট, ১৬৯ ওয়ানডে ও ৬২ টি-টোয়েন্টি উইকেটের মালিক ট্রেন্ট বোল্ট নিশ্চিতভাবেই কিউই দলের বোলিং লাইনআপের অন্যতম সেরা ছিলেন। ছন্দে থাকা অবস্থাতেই তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কম খেলার সিদ্ধান্ত তাই কিউই সমর্থকদের কিছুটা বিষণ্ন করবেই।

তবে এখানে একটা প্রশ্ন জাগে। এভাবে চুক্তি নবায়ন না করে বেছে বেছে কিছু ম্যাচ খেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট চালিয়ে যাওয়াটা কতটা সততার পরিচয় দেয়? আজ থেকে ১০ বছর আগেও সম্ভবত ক্রিকেট এমন একটা টার্মের সাথে পরিচিত ছিল না। একজন ক্রিকেটারকে কোন সিরিজে পাওয়া যাবে আর যাবে না এমন একটা ভাবনা মাথায় রেখে নির্বাচকদের দল সাজাতে হবে। এতে নিশ্চিতভাবেই দল গঠনে বেগ পোহাতে হয়। দলের কম্বিনেশন বজায় রাখতে অসুবিধা হয়।

তবে এ ধরনের সিদ্ধান্তে দায়টা শুধু ক্রিকেটারেরই না। ক্রিকেটে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট-সহ ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের আবির্ভাবের কারণে ক্রিকেট যে অনেক আগেই পাল্টে গেছে। বিশেষ করে পেসারদের জন্য আরো কঠিন হয়ে গেছে বর্তমান ক্রিকেট। ব্রেট লি থেকে শুরু করে শোয়েব আখতার, ডেল স্টেইন কেউই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সময় নিজের বয়স ৩৫ পেরোতে পারেনি।

ব্যতিক্রম উদাহরণ হতে পারে, জিমি অ্যান্ডারসন। ৪০ বছর বয়সেও চালিয়ে যাচ্ছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। ইতিহাসের প্রথম পেসার হিসেবে টেস্টে নিয়েছেন ৬০০ উইকেট। নির্দিষ্ট ফরম্যাটে এমন দুর্দান্ত রেকর্ডের কারণ হলো, তিনি শেষবার ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছিলেন ৭ বছর আগে, ২০১৫ সালে।

শেষ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ হিসেব করলে দাঁড়ায় দীর্ঘ ১৩ বছর আগে, ২০০৯ সালে। নির্দিষ্ট একটি বা দুটি ফরম্যাটে মনোনিবেশ করলে নির্দিষ্ট করে সে ফরম্যাট নিয়ে কাজ করা যায়। লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে যাওয়া যায়। ইংল্যান্ডের এমন সংস্কৃতি অবশ্য বেশ পুরনো। বাঁহাতি ব্যাটাসম্যানদের মধ্যে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক অ্যালিস্টেয়ার কুক ওয়ান খেলেছেন একশো টারও কম। কখনোই খেলেননি বিশ্বকাপ।

ইংলিশ ক্রিকেটারদের এমন নির্দিষ্ট ফরম্যাটে সফলতার পিছনে অবদান আছে বোর্ডেরও। এখন ৩৩ বছর বয়সী বোল্টকে নিয়ে কিউই বোর্ডের এমন ভাবনা কি ছিল? সেটা আমরা জানি না। তবে এমন ভাবনা প্রত্যেক দেশের ক্রিকেট বোর্ডেরই থাকা উচিত। ভিভিএস লক্ষণ কখনোই বিশ্বকাপ খেলেননি। কিন্তু তাতে কি?

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফলোঅনে পড়েও ভারত ঐ ম্যাচটা জিতেছিল লক্ষণের ২৮১ রানের এক মহাকাব্যিক ইনিংসের কারণে। একইভাবে, চেতেশ্বর পুজারাও টেস্ট বাদে বাকি দুই ফরম্যাট খেলেন না। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যাবে এই ফরম্যাটে তার রেকর্ডও সমৃদ্ধ।

বর্তমান ক্রিকেট যেভাবে এগোচ্ছে তাতে বোর্ডেরই উচিত ফরম্যাটভেদে দল করা। খেলোয়াড়দের সাথে আলোচনায় বসা। নচেৎ ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের ভিড়ে খেলোয়াড়দের বেঁছে বেঁছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার প্রবণতাই বাড়বে। কেন জানে ফুটবলের রিয়াল-বার্সা জোয়ার না জানি আবার চেন্নাই-মুম্বাই হয়ে যায়!

চুক্তি নবায়ন না করার ব্যাপারে ট্রেন্ট বোল্ট বলেছেন, ‘এটি আমার জন্য সত্যিই একটি কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল এবং আমি এই অবস্থানে আসার জন্য তাদের সমর্থনের জন্য এনজেডসি-কে ধন্যবাদ জানাতে চাই। নিউজিল্যান্ডের হয়ে ক্রিকেট খেলাটা আমার জন্য গর্বের ছিল এবং আমি গত ১২ বছরে ব্ল্যাক ক্যাপদের সাথে যা অর্জন করতে পেরেছি তার জন্য আমি গর্বিত। অবশেষে এই সিদ্ধান্তটি আমার স্ত্রী গার্ট এবং আমাদের তিনজন ছেলের বিষয়ে। পরিবার সবসময়ই আমার জন্য সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণাদায়ক এবং আমি এটাকে প্রথমে রাখতে চাই।’

বোল্টের বিবৃতিটা খুবই স্পষ্ট। তিনি পরিবারকে বেশি সময় দিতে চান। আর এ কারণেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত। তবে অদূর ভবিষ্যতে যদি বোল্টকে দেশের খেলা ছেড়ে আইপিএল, বিবিএল, সিপিএল, পিএসএল মাতাতে দেখা যায় তাহলে? তখন ক্রিকেটীয় নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা খুব অযৌক্তিক হবে।

নাকি এটাকেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে ধরে নেওয়া শিখে নিতে হবে? এরই মধ্য দিয়ে ক্রিকেটেই নতুন একটা ট্রেন্ডের প্রতিষ্ঠা স্থায়ী ভাবে হয়ে গেল? আবার সকল সমালোচনার ঊর্ধ্বে গিয়ে এটাও তো সত্যি যে, সবাইকে জাতীয় দলের প্রতি শতভাগ নিবেদন দিয়ে খেলার দিব্যি কে দিয়েছে!

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link