More

Social Media

Light
Dark

খাঁটি ক্রিকেট মানব

১৪ মে ২০১০।

সেন্ট লুসিয়ায় তখন টান টান উত্তেজনা! টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে যেতে শেষ ওভারে পাকিস্তানের অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ১৮ রান! শেষ ওভারে বল করতে আসলেন সাইদ আজমল আর স্ট্রাইকে মিশেল জনসন। প্রথম বল থেকে সিঙ্গেল নিয়ে হাসিকে স্ট্রাইক দেন তিনি।

বাকি গল্পটা হয়তো আজমল কখনোই মনে করতে চাইবেন না, আর মনে পড়লেও সেটা নেহাৎ গল্প ভেবেই হয়তো ভুলে যেতে চাইবেন। শেষ ৫ বলে দরকার ১৭ রান! স্ট্রাইকে যেয়েই পর পর দুই বলে ছক্কা হাঁকান মাইক হাসি! ৩ বল থেকে ফাইনালে যেতে অজিদের প্রয়োজন মাত্র ৫ রান।

ads

পরের বলেই চার মেরে ফাইনাল প্রায় নিশ্চিত করে ফেললেন হাসি। অজি শিবিরে তখন জয়ের উল্লাস। শেষ ২ বলে দরকার ১ রান, পরের বলেই ছক্কা মেরে বাধ ভাঙ্গা উল্লাসে মেতে উঠেন হাসি! শেষ ওভারে তিন ছক্কা আর এক চারে সেদিন পাকিস্তানকে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় করে দিয়ে অজিদের ফাইনালে নিয়ে যান হাসি।

এই ম্যাচের কথা আপনার মনে থাকলে মাইক হাসির ক্রিকেটের প্রতি প্রেম আর ক্রিকেটে তার অবদান নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়। ক্রিকেটে যে সময়টায় একজন ক্রিকেটার তার ক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করে সেই সময়টায় মাইক হাসি অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হবার!

২৮ বছরে যখন তার ওয়ানডে অভিষেক হয় সেই সময়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি ১৫ হাজারেরও বেশি রানের মালিক! একটু নিঃশ্বাস ফেলুন আর ভাবুন ঘরোয়া ক্রিকেটে এমন প্রতিভা দেখানোর পরেও একজন জাতীয় দলে সুযোগ পেতে কত সময় পার করেছে।

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে তিনি খেলেছেন মাত্র সাত বছর। এই সাত বছরে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যা করে গেছেন সেটার সাথে যদি আর পাঁচ বছর বেশি সময় পেতেন তাহলে নি:সন্দেহে সর্বকালের সেরাদের কাতারে নিজেকে রেখে যেতে পারতেন। তিনি সাত বছরের ক্যারিয়ারে প্রমাণ করে গেছেন তার কতটুক প্রতিভা আর সামর্থ্য ছিলো।

মিস্টার ক্রিকেট উপাধি পাওয়া এই অজি গ্রেট কখনো কি রাত জেগে ভেবেছেন এতো রানের বন্যা ভাসিয়েও কেনো এতো দেরীতে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সুযোগ পেয়েছিলেন? কখনো সেই সুযোগ হলে অবশ্য জিজ্ঞেস করেও ফেলতাম। জানতে চাইতাম তার মধ্যে কি কোনো আক্ষেপ আছে? কেনো তাকে এতো দেরীতে সুযোগ দেওয়া হলো!

অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের কথা মনে হলেই আমার মনে পড়ে ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের যুবরাজের সাথে বাক বিতন্ডা আর যুবরাজ পরের ওভারে স্টুয়ার্ট ব্রডের ৬ বলে ৬ ছক্কা মেরে সেই ক্ষোভটা মিটিয়েছিলেন। আপনার প্রশ্ন জাগতেই পারে তাহলে মাইক হাসির সাথে ফ্লিনটফের কি সম্পর্ক? আপনি কি জানেন এই অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফই মাইক হাসিকে ‘মি. ক্রিকেট’ উপাধি দিয়েছিলেন!

মাইক হাসি একবার ডারহামের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেট খেলছিলেন। সেখানে সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফও ছিলেন। তো সেখানে ল্যাঙ্কাশায়ারের বিপক্ষে এক ম্যাচে সেদিন প্রচুর ঠান্ডা ছিলো ওল্ড ট্রাফোর্ডে। হাসি ভাষ্যমতে নাকি সেদিন দু:সহনীয় অবস্থা ছিলো! সেখানে তাদের দলের কোনো ক্রিকেটারই ওই মূহুর্তে খেলতে রাজি ছিলেন না, কিন্তু হাসি খেলার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন! তখনই ফ্লিনটফ তাঁকে মিস্টার ক্রিকেট উপাধি দেয়।

আরেকটা ব্যাপার, সচরাচর স্লেজিংয়ের জন্য অজি ক্রিকেটারদেরকে সেরা বলা হয়। অজি ক্রিকেটার আর স্লেজিং যেনো এক সূত্রে গাঁথা। আচ্ছা অজি ক্রিকেটার হওয়া সত্ত্বেও মাইক হাসি বেশ ভদ্র ক্রিকেটার ছিলেন যাকে ক্রিকেট মাঠে স্লেজিং করতে দেখা যেতো না! কিন্তু এর পিছনে কি কোনো কারণ আছে? একটু অনুসন্ধান করেই দেখি কিছু জানা যায় কিনা।

সাবেক ভারতীয় স্পিনার হরভজন সিং নিজের নামে একটা অনুষ্ঠান করতেন নাম ‘ভাজ্জি ব্লাস্ট’। সেই শো’য়ে একবার মাইক হাসিকে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেখানে সাবেক এই ভারতীয় স্পিনার মাইক হাসিকে ‘নো স্লেজিং’ পুরস্কার দেবার কথা বলেন। হরভজন হাসিকে বলেছিলেন একজন অজি ক্রিকেটার হওয়া সত্ত্বেও সে কিভাবে স্লেজিং না করে ক্রিকেট খেলেন এটা তার কাছে বেশ বিস্ময়কর!

উত্তরে মাইক হাসি বলেন তিনি কেনো স্লেজিং করেননা সেটা শুনলে হরভজন আরো বেশি অবাক হবে। এরপর হাসি বলেন, ‘আমি একবার দুইজন ব্যাটসম্যানকে স্লেজিং করেছিলাম! কিন্তু সেই দুইজনই ওই ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছিলো। এরপর থেকেই আমি আর কাউকে স্লেজিং করি না।’

আচ্ছা ছেলেবেলায় যে যা স্বপ্ন দেখেছিলেন সবাই কি তাই হতে পেরেছিলেন বড় হয়ে? যদি আপনার উত্তর না হয়ে থাকে তাহলে জেনে নিন মাইক হাসিও তা*র ছোটবেলার স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি!

২৭ মে ১৯৭৫ – ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম নেওয়া মাইক হাসি হতে চেয়েছিলেন একজন বিজ্ঞানের প্রফেসর। ছোট ভাই ডেভিড হাসির সাথেই ক্রিকেট খেলতেন আর স্বপ্ন দেখতেন একদিন বিজ্ঞানের শিক্ষক হবেন। তবে সেটা আর হয়ে ওঠা হয়নি তার! তবে ফুটবলেও তার বেশ নেশা ছিলো। ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ফ্যান তিনি। ছেলেবেলায় স্কুল শিক্ষা শেষ করার পর তিনি অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট একাডেমির স্কলারশিপ জিতে যান, তার সাথে সে সময়ে ব্রেট লি এবং জেসন গিলেস্পিও এই স্কলারশিপ পেয়েছিলেন।

এরপর থেকেই তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু। সেখান থেকে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট আর লিস্ট এ তে হাজার হাজার রান তিনি করে গেছেন তবু জাতীয় দলের দেখা মেলেনি! ২৮ বছর বয়সে তিনি যখন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ওয়ানডে ফরম্যাট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন এর আগেই তিনি ঘরোয়া ক্রিকেটে ১৫ হাজার ৩১৩ রানের মালিক! ব্যাপারটা বিস্ময়কর হলেও সত্যি। ২০০৪ সালের এক ফেব্রুয়ারি ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে আর তার দুই বছর পর ৩ নভেম্বর ২০০৫ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক!

তার সাত বছরের ক্যারিয়ারে ৭৯ টেস্টে ৫১.৫২ গড়ে ৬২৩৫ রান করেছেন। তার মধ্যে ২৯ ফিফটির পাশাপাশি আছে ১৯ সেঞ্চুরি। ১৮৫ ওয়ানডেতে ৪৮ গড়ে ৫৪৪২ রান করেছেন। ওয়ানডেতে ৩ সেঞ্চুরির পাশাপাশি করেছেন ৩৯টি ফিফটি। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট ও লিস্ট এ তে ৬৫৪ ম্যাচে প্রায় ৩৫ হাজার রান করেছেন ৫০ এর কাছাকাছি গড়ে! আছে ১৯৩ ফিফটি আর ৭৩ সেঞ্চুরি।

২০০৬ সালে ওয়ানডে ব্যাটিং র‍্যাংকিংয়ে তিনি এক নম্বরে ছিলেন। এছাড়া টি-টোয়েন্টি তেও তিনি বেশ সফল ছিলেন। ৩৮ টি-টোয়েন্টিতে প্রায় ৩৮ গড়ে ৭২১ রান, আছে ৪ ফিফটি। এছাড়া ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) ৫৯ ম্যাচে প্রায় ৩৯ গড়ে ১৯৭৭ রান করেছেন। তার ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান দেখলেই আপনি বলতে বাধ্য এই মিস্টার ক্রিকেট যদি ২২ গজে আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর পাঁচ বছর খেলতেন নিজেকে হয়তো সর্বকালের সেরাদের একজন হিসেবেই রেখে যেতেন।

সাত নম্বরে ব্যাটিং করে মাইক হাসির গড় কত জানেন কি? ২১ ওয়ানডেতে প্রায় ১২১ গড়ে ৭২৫ রাব করেছেন তিনি! সেই সাথ টি-টোয়েন্টিতেও ৮ ম্যাচে ১২৪ গড়ে ২৪৮ রান। টেইলএন্ডারে তিনি কি পরিমাণ রান পাগল ছিলেন সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের মাত্র ১৬৬ তম দিনে তিনি ১ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন যা দিনের হিসেবে সবচেয়ে দ্রুততম। দ্রুততম খেলোয়াড় হিসেবে হাসি আইসিসির সেরা দশ র‍্যাংকিংয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন! ২০০৬-০৭ মৌসুমে অ্যাশেজ সিরিজ ৫-০ তে জিতে নিয়েছিলো অজিরা, সেই সিরিজে ১০৫.২৫ গড়ে রান করেছিলেন হাসি। আইপিএলের উদ্ভোদনী আসরেই মাইক হাসি সেঞ্চুরি করেন যা আইপিএল ইতিহাসের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। ২০১৩ আইপিএলে ১৭ ম্যাচে ৭৩৩ রান করেছিলেন তিনি যা কিনা সেই আসরে সর্বোচ্চ রান।

তার ছোট ভাই ডেভিড হাসিও অস্ট্রেলিয়া দলে খেলেছেন। এমনকি দুই ভাই জাতীয় দলে বেশ কয়েকম্যাচে একসাথে খেলেছেন। ফ্র‍্যাঞ্চাইজি লিগ আইপিএলেও দুই ভাই চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে একসাথে মাঠ মাতিয়েছেন। ক্রিকেট থেকে অবসরের পর ফ্র‍্যাঞ্চাইজি লিগ আইপিএল এবং বিগ ব্যাশে কোচিং করাচ্ছেন হাসি সেই সাথে ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া দলেও তিনি ব্যাটিং কনসাল্টেন্ট হিসেবে কাজ করেন।

মাইক হাসির ক্যারিয়ারে যদি কোনো খুঁত বের করতে বলেন সেটা হবে ওয়ানডেতে তিনি ফিফটিকে সেঞ্চুরিতে রুপান্তর করতে সফল হতে পারেননি। মাত্র ৩ সেঞ্চুরি আর ৩৯ ফিফটি তার প্রমান। আর তার ক্যারিয়ারে অধিনায়ক হিসেবে ৪ ওয়ানডের ৪ টিতেই পরাজয়। এছাড়া মাইক হাসির ক্যারিয়ার জুড়ে শুধু রানের ফোয়ারা দেখতে পাবেন।

ক্রিকেট ক্যারিয়ারজুড়ে গায়ে বিতর্কের ছোঁয়া লাগতে দেননি অজি ক্রিকেটের অন্যতম এই ভদ্রলোক। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খুব বেশি সময় খেলতে না পারার আক্ষেপটা হয়তো মনের মধ্যেই পুষে রেখেছেন। কিন্তু ২২ গজে তার অবদান প্রমাণ করে তিনি সত্যিকারের মিস্টার ক্রিকেট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link