More

Social Media

Light
Dark

কিংবদন্তি হয়েই বিদায় নেবেন তাসকিন!

গতিময় পেসার আগেও ছিলেন। তবে সময়ের ব্যবধানে পরিবর্তিত হয়েছে অনেক কিছুই। বোলিং অস্ত্রে যোগ হয়েছে ক্ষুরধার ক্রিকেটীয় মস্তিষ্ক। এ ছাড়া ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রতিপক্ষ ব্যাটারকে পর্যবেক্ষণ করে স্লোয়ার, কাটার, সুইং দেওয়ার কারিকুরি তো আছেই। এসব মিলিয়ে তাসকিন আহমেদ হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের বড় এক অস্ত্র।

পরিসংখ্যান বলে, মুস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের নেতা। কিন্তু শেষ এক বছরে সেটা বদলে গিয়েছে। পেস বোলিংয়ের নেতৃত্বের ব্যাটনটা এখন তাসকিনের হাতে। দেশ কিংবা দেশের বাইরে- দুই উইকেটেই সমান আধিপত্য দেখাচ্ছেন এ পেসার।

সম্প্রতি ক্রিকেট গণমাধ্যম ইএসপিএনক্রিকইনফো’র কাছে নিজের এমন উত্তরণের গল্পই শুনিয়েছেন তাসকিন আহমেদ। সেখানে উঠে এসেছে নিজের প্রত্যাবর্তন সহ, আইপিএলে সুযোগ পেয়েও না খেলার নেপথ্যের গল্প।

ads

ইনজুরির কারণে তাসকিন একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত জাতীয় দলের বাইরেই ছিলেন। ক্যারিয়ারের শুরুতেই তারকাখ্যাতি পেয়েছিলেন। আর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল মাঠেও। ক্রমেই জাতীয় দলে তাঁর ফেরার রাস্তাটা কঠিন থেকে কঠিতর হয়ে উঠছিল। কিন্তু তাসকিন সেই কাঠিন্যকে জয় করেছিলেন দুর্দান্তভাবে। জাতীয় দলে তাঁর প্রত্যাবর্তনটা হয়েছিল দোর্দণ্ড প্রতাপে।

তাসকিনের এমন ঘুরে দাঁড়ানোর রহস্য কি? তাসকিন অবশ্য এর পিছনে কৃতিত্ব দিচ্ছেন নিজের দৃঢ় মানসিকতাকে। তিনি বলেন, ‘দলে ফেরার পর থেকেই আমি একজন টিমম্যান হতে চেয়েছি। আমার একটা আত্মবিশ্বাস ছিল, আমি যেভাবে কাজ করেছি তাতে ফল পাবোই। ক্রিকেটে সব কিছু নির্ধারিত হয় ঐ বাইশ গজেই। তাই আমি সবসময় মাঠে নিজের সেরাটাই দিতে চেয়েছি। নিজের সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলে দিতে চেয়েছি।’

এই ইংল্যান্ড সিরিজেই তাসকিনকে নিয়ে প্রশংসা ঝরেছিল ইংলিশ পেসার মার্ক উডের কাছ থেকে। তিনি বলেছিলেন, ‘তাসকিনের কাছ থেকে তাদের পেসারদের অনেক কিছু শেখার আছে। ও যেভাবে আমাদের ব্যাটারদের চাপে রেখেছে তা এক কথায় দুর্দান্ত।’ এমন প্রশংসায় অবশ্য পা মাটিতেই রাখছেন তাসকিন। তিনি বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই, উড পেসারদের মধ্যে সেরাদের একজন। তিনি যা বলেছেন, সেটা তো একজন পেসারেরই কাজ। আমি দলের হয়ে ঐ কাজটাই শুধু মাঠে করতে চেয়েছি।’

গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে দুর্দান্ত এক স্পেল করেছিলেন তাসকিন। উইকেট পাননি, তবে রানপ্রসবা সেই পিচে ৪ ওভারে মাত্র ১৫ রান দিয়েছিলেন তিনি। এ নিয়ে তাসকিন বলেন, ‘ভাল বোলিং মানদন্ডটা সব সময় উইকেট দিয়ে হয় না। এমন অনেক সময় হয় যে, আপনি বাজে বোলিং করলেন, কিন্তু শেষ করলেন কয়েকটি উইকেট নিয়ে। আবার ভাল বল করেও দিনশেষে উইকেটশূন্য থাকলেন। মূলত দলের যেটা কাজে আসবে সেটাই মূখ্য। আমি সবসময় মাঠে ১১০ ভাগ দিতে চাই। যেখানেই শেষ করি না কেন, তার চেয়ে আরো উন্নতির চিন্তা করি।’

শেষ তিন বছরের হিসেবে, বাংলাদেশের পেস বোলিং ইউনিটে সেরার স্বীকৃতিটা নিশ্চিতভাবেই তাসকিন আহমেদের। তবে তাসকিন এমন কিছুর স্বীকৃতিতে আবার বিশ্বাসী নন। তাঁর মতে, দেশের হয়ে যার হাতে বল থাকবে, সেই-ই তখন নেতা। এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি তো দলের পেসারদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে আসিনি। আমরা পরিবারের মতো। আমরা সমষ্টিগতভাবে যদি আর শক্তিশালী হতে পারি তাহলে প্রতিপক্ষের জন্য একটা আতঙ্কের নাম হতে পারব। আর ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বের শীর্ষ পেসারদের মধ্যে নিজেকে নিয়ে যেতে চাই। আমি সেভাবেই মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করছি।’

কোভিডের পর জাতীয় দলে ফিরেছিলেন তাসকিন আহমেদ। আর এরপর থেকেই দারুণ ধারাবাহিক তিনি। এ সময়ের মধ্যে তাঁর সেরা মুহূর্তগুলো কোন গুলো? তাসকিন বেছে নিয়েছেন আগের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, যেখানে তিনি দুটি ম্যাচে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ, যেখানে তাঁর হাতে উঠেছিল সিরিজ সেরার পুরস্কার। এ ছাড়া নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয়ের মুহূর্তটিও রয়েছে তাঁর সুখস্মৃতির তালিকায়।

মাউন্ট মঙ্গানুইতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয়ের সে স্মৃতি টেনে তাসকিন বলেন, ‘ আমার কামব্যাকটা দেশের প্রতি আরো ভালোবাসা জাগিয়েছিল। আমার এখনও মনে আছে, এবাদত চা বিরতির পর যখন বল করছিল তখন আমরা হিসাব করছিলাম। শেষ দিনে লাঞ্চ বিরতির আগে যদি নিউজিল্যান্ডকে অলআউট করা যায় তাহলে আমরা জিততে পারব। আর তা না হলে আমাদের ড্র’য়ের জন্য খেলতে হবে। হঠাৎ করে এবাদত তখনই কিছু সময়ের ব্যবধানে তিন উইকেট তুলে নেয়। এরপর তো গল্পটা তো সবার জানা। পরের দিন সকালে আমি তিন উইকেট নিই। আর বাকি তিনটা এবাদত নেয়। আমরা ম্যাচটা জিতে যাই।’

নিউজিল্যান্ডের পরেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তাদের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজ জেতে বাংলাদেশ। আর সেই সিরিজে ম্যান অব দ্য সিরিজ নির্বাচিত হয়েছিলেন তাসকিন। ঐতিহাসিক সে সিরিজ জয়ের স্মৃতি টেনে তাসকিন বলেন, ‘ঐ সময় আমি আইপিএলে লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টসের হয়ে খেলার জন্য ডাক পেয়েছিলাম। কিন্তু অনাপত্তি পত্র পাইনি। কারণ তখন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট চলছিল। সবারই স্বপ্ন থাকে আইপিএল খেলার। সত্যি বলতে সেই সুযোগ হারিয়ে আমি কিছুটা ব্যথিত ছিলাম। তারপরও দেশের হয়ে খেলাটাকে নিজের প্রথম কাজ, এটা দিয়ে নিজেকে বুঝানোর চেষ্টা করি।’

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচের আগের রাতে বেশ চিন্তাতেই পড়ে গিয়েছিলেন তাসকিন। তাসকিন সেই রাতের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘আগের রাতে আমি ঘুমাতেই পারছিলাম না। আমি বেশি চিন্তা করছিলাম। বারবার ভাবছিলাম, কালকে যদি আমি খারাপ করি তাহলে তো লোক বলবে, আইপিএলে যেতে দেয়নি বলে, বোলিংয়ে ওর মন নেই। তাছাড়া ম্যাচের দিন সকালে পরিবার নিয়ে আমার একটু মন খারাপ হয়েছিল। যেটা দীর্ঘ সফরে গেলে সবারই হয়। তবে মাঠে নামার পরই উজাড় করে দিতে চেয়েছিলাম। প্রতিটা বলই ভেবে ভেবে করেছিলাম। আমি ভাগ্যবান, ঐদিন ৫ উইকেট পেয়েছিলাম। আর দল জিতেছিল। দিনশেষে, দলের জেতাটাই মূখ্য।’

তাসকিনের বলে ফিল্ডারের ক্যাচ মিস করা- এ যেন এক চিরন্তন দৃশ্য। কিন্তু তাসকিন তাতে প্রতিক্রিয়া দেখান খুব কম সময়েই। এমন ইস্যুতে তাসকিন অনেকটা হেসেই বলেন, ‘একশো বারে দুই একবার প্রতিক্রিয়া আসেই। তবে কেউ তো আর ক্যাচ ইচ্ছা করে মিস করে না। বিশ্বকাপে রাব্বি ভাই কিন্তু আমার বলে দারুণ একটা ক্যাচ নিয়েছিল। আবার এই ইংল্যান্ড সিরিজেই শান্ত ভাল ক্যাচ নিয়েছে।’

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচে ছিলেন না তাসকিন। সে ম্যাচে না থাকার কারণ হিসেবে তাসকিন বলেন, ‘আমি খেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অধিনায়ক, টিম ম্যানেজমেন্টরা আমাকে বিশ্রাম দিতে চেয়েছিল। কারণ সামনে অনেক ম্যাচ আছে।’

তাসকিনের রোল মডেল কারা? আর এই সময়ের পেসারদের মধ্যে কারা একজন কিংবদন্তী হয়ে ক্যারিয়ার শেষ করবে? এমন সব প্রশ্নে তাসকিন অবশ্য জলঘোলা করেননি। অকপটে জানিয়েছেন, গ্লেন ম্যাকগ্রা, ওয়াসিম আকরাম, ব্রেটলিদের অনুসরণ করেন তিনি। আর এই সময়ের পেসারদের মধ্যে তাসকিনের দৃষ্টিতে শাহিন শাহ্‌ আফ্রিফি, কাগিসো রাবাদা, জাসপ্রিত বুমরাহ, জশ হ্যাজলউডরা রা কিংবদন্তীদের পর্যায়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশের বোলিং কোচ হিসেবে এখন পর্যন্ত দারুণ সফল অ্যালান ডোনাল্ড। তবে তাসকিনের দৃষ্টিতে ডোনাল্ড বাদেও আগের কোচ ওটিস গিবসন তাঁর বোলিংয়ে অনেক ভূমিকা রেখেছিল। তাদের কৃতিত্ব জানাতে গিয়ে তাসকিন বলেন, ‘দুইজনই দারুণ কোচ। গিবসন সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো নিয়ে কাজ করতো। আর ডোনাল্ড আমাদের সব ব্যাপার গুলো খতিয়ে দেখেন। এর পাশাপাশি সুজন স্যারও অনেক কাজ করেছেন। প্রধান কোচ হিসেবে চান্দিকা হাতুরসিংহেকে আমার বেশ পছন্দ। তাঁর ভাবনা আলাদা। ম্যাচ নিয়ে তিনি সব সময় তৎপর থাকেন।’

একটা সময়ে তাসকিনকে নিয়ে টেস্ট ফরম্যাটে চিন্তাই করা হতো না। কারণ দীর্ঘ স্পেলে তিনি বল করতে পারতেন না। সেই তাসকিন এখন ওভারের পর ওভার বল করে যান ধারাবাহিকভাবে। দলের পেস বোলিং ইউনিটে হয়ে উঠেছেন অন্যতম ভরসার নাম। তাসকিন নিজে এটাকে কিভাবে দেখেন?

তাসকিন এটাকে সাফল্য হিসেবে ধরছেন। তিনি বলেন, ‘এটা গর্বের ব্যাপার যে, আমি ঐ জায়গা থেকে একটা ভরসার জায়গা হতে পেরেছি। আমি বাংলাদেশে পেস বোলিং একটা ট্রেন্ড সেট করতে চাই। বাংলাদেশে আরো পেসার উঠে আসুক। পেসারদের তৈরি হতে হবে ১৫ বছর বয়স থেকেই। বাংলাদেশের এখন বাংলাদেশ টাইগার্স প্রোগ্রাম চালু হয়েছে। এর মাধ্যমে আরো অনেক পেসার উঠে আসবে। আর ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেকে আরো বড় জায়গায় দেখতে চাই। নিজের সামর্থ্য নিয়ে একজন কিংবদন্তী পেসার হিসেবে ক্যারিয়ার শেষ করতে চাই।’

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link