More

Social Media

Light
Dark

হারানো সেই সিলেটের কথা

১৯৯৪ সাল; মধুশহীদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছি তখন।

একদিন ইশকুল ছুটি হয়ে গেলো আগেভাগেই। খালাতো ভাই সহ আরো কয়েকজন বড়ো ভাই কাছেই রিকাবি বাজারে অবস্থিত জেলা স্টেডিয়ামের দিকে দলবেঁধে ছুটছেন। সঙ্গী হলাম তাদের। স্টেডিয়ামের ভেতর ঢুকে দেখলাম অনেক মানুষ। সীমানা দড়ির কাছাকাছি বসে অনেকেই খেলা দেখছেন। আমরাও বসে পড়লাম, আমি আমার কেডস খুলে তার ওপরে বসলাম।

কেনিয়া আর বাংলাদেশ এ দলের খেলা চলছিলো সম্ভবতড়; স্পষ্ট মনে নেই। ক্রিকেটারদের গায়ে সাদা জার্সি, লাল বল ছুটছে সবুজ মাঠজুড়ে। আমরা যখন প্রবেশ করেছি খেলা তখন শেষের দিকে, চরম উত্তেজনা চারিদিকে। রেডিওতে অনেকেই ধারাবিবরনী শুনছেন। সেই অল্প বয়েসে উত্তেজনার আঁচটা খুব একটা গায়ে লাগেনি। ম্যাচটা বাংলাদেশ এ দল হেরে গিয়েছিলো। জয়-পরাজয় আমার কাছে তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। আমি মুগ্ধ হলাম বিশাল এক মাঠ, তাতে এত মানুষ, ক্রিকেটারদের অমন এক পরিবেশে খেলতে দেখে। প্রথম দিন গিয়েই এক মোহে আবদ্ধ হয়ে গেলাম।

ads

সেই দিন থেকে আজ অবধি নিয়মিতই যাওয়া আসা চলছে জেলা স্টেডিয়ামে। শিশু বয়সের সেই মোহ ক্রমেই অনির্বচনীয় আবেগে রূপান্তরিত হয়েছে। দেখেছি সিলেটের এই মাঠে জাতীয়, আন্তর্জাতিক খেলা। স্থানীয় খেলা দেখতে দেখতে স্বপ্ন বুনেছি একদিন নিজেও যুক্ত হবো এসবের সঙ্গে। সৌভাগ্য আমার, খেলাধুলার সঙে নানাভাবে যুক্ত হতে পেরেছি।

সেই নব্বই দশকের গোড়ার দিকে যখন ক্রিকেট লিগ দেখতে যেতাম। ভাঙাচোরা গ্যালারিতেও দেখতাম অনেকে বসে খেলা দেখছেন। মাঠের ভেতরেও সীমানা দড়ির পাশে বসে প্রচুর দর্শক খেলা দেখতেন। শুধু সিলেট লিগ নয়, দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগ, স্কুল ক্রিকেটেও প্রচুর দর্শকের আগমণ ঘটতো। ক্রিকেট ম্যাচ হলে রিকাবি বাজারে এক উৎসব মুখর পরিবেশের সৃষ্টি হতো। শুধু ক্রিকেটাররাই আসতেন, তা নয়, অনেক ক্রীড়া সংগঠক, ক্রীড়া সাংবাদিক, ক্রীড়া অনুরাগীরা আসতেন স্টেডিয়াম পাড়ায়। গ্যালারিতে বসে চা, সিঙাড়া, সমুচার স্বাদ নিতে নিতে ঝানু ক্লাব কর্তারা স্কুল আর দ্বিতীয় বিভাগে খেলা প্রতিশ্রুতিশীল ক্রিকেটারদের দিকে নজর রাখতেন। পছন্দের ক্রিকেটারকে ডেকে নিয়ে নিজের ক্লাবে ভিড়িয়ে নিতেন। এই চা-সিঙাড়ার আড্ডায় বসেই সিলেট লিগের অনেক ক্লাব নিজেদের দল গুছিয়ে নিয়েছেন।

ক্রিকেট মৌসুম শুরু হবার প্রাক্কালে স্টেডিয়াম জুড়েই ফিসফাস শুরু হতো কে কোন ক্লাবে যাচ্ছেন, কোন ক্লাব কাকে বাগাতে শ্যেন দৃষ্টিতে বসে আছে। ক্লাব কর্তারা একে অন্যের চোখে ধূলো দিয়ে পছন্দের ক্রিকেটারটেইকে দলে ভেড়াতে নানা রকম কৌশল করেছেন। এইসব হয়ে যাবার পর যখন মাঠে খেলা গড়াতো। তখন, ভিন্ন রকম উত্তেজনা। কোন খেলোয়াড় কেমন পারফর্ম করছেন, সেসব নিয়ে আলাপ-আলোচনা, স্থানীয় পত্রিকায় লেখালেখি, খেলা শেষে ক্লাব কর্মকর্তা, আম্পায়ার-স্কোরারদের স্টেডিয়ামে সান্ধ্যকালীন আড্ডা। প্রকৃত অর্থেই যেন স্টেডিয়াম তখন আনন্দ-উৎসবে ভরপুর।

আজকের মত এত আধুনিক সুযোগ-সুবিধা কিংবা অর্থকড়ির ছড়াছড়ি না থাকলেও সিলেট লিগের জৌলুস ছিলো। সৈয়দ পারভেজ আহমদ, নাসিরুল আলম নাহিদ, ফরহাদ কোরশি, তকরিমুল হাদি কাবি, রাজিন সালেহ আলম, তাপস বৈশ্য, অলক কাপালি, এনামুল হক জুনিয়র, নাসির হোসেন, কবির আহমেদ, গোলাম মাওলা তুষার, গোলাম মাবুদ শিশির, গোলাম রহমান হিমেল, মিষ্টু দাস প্রমুখ ধারাবাহিকভাবে দুর্দান্ত পারফর্ম করে গেছেন দীর্ঘদিন। চাইলে এই তালিকা আরো লম্বা করা যায়। শুধু যে স্থানীয় লিগেই এরা ভালো খেলেছেন তাই নয়, এদের অনেকেই ঢাকা লিগ, জাতীয় লিগেও ছিলেন অসাধারণ পারফর্মার। রাজিন, তাপস, অলক, এনাম তো একই সঙ্গে জাতীয় দলেও প্রধিনিধিত্ব করেছেন।

জাতীয় লিগের ৩ দিন এবং পরে যখন ৪ দিনের ম্যাচ হতো। তখনো অনেক দর্শক আসতো মাঠে। আমরা সকালে গিয়ে পুরো দিনের খেলা দেখে তারপর বাসায় ফিরতাম, এমন অনেকদিন হয়েছে। সিলেট তখন জাতীয় পর্যায়ে সমীহ জাগানো এক দল। জাতীয় লিগের একদিনের ফরম্যাটে সৈয়দ পারভেজ আহমদ এর নেতৃত্বে সিলেট ২০০১ সালে চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করেছিলো।

এই পারভেজ আহমদ সবার কাছে পরিচিত ছিলেন ভাইসাব নামে। ভাইসাব শুধু যে একটা দলের অধিনায়ক ছিলেন তাই নয়, তরুণ এবং উদীয়মান ক্রিকেটারদের জন্যে তিনি ছিলেন একজন পথপ্রদর্শক। তরুণদের আদর্শ ক্রিকেটার হবার জন্যে অনুশীলনে পরিশ্রম করবার দিকনির্দেশনা থেকে শুরু করে তাদের জন্যে ঢাকায় ক্লাব ক্রিকেটে ক্লাব ব্যবস্থা করে দেয়া-এমন অনেক কিছুই করেছেন ভাইসাব। নাসিরুল আলম নাহিদ এবং সৈয়দ পারভেজ আহমদ মিলে একটা ক্রিকেট কোচিং অ্যাকাডেমিও করেছিলেন। ক্রিকেটার হবার স্বপ্ন বুকে লালন করা শিশু-কিশোরদের জন্যে তারা নিজেদের সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন।

সিলেটের সেই জমজমাট ক্রিকেট আবহে হঠাৎ করেই যেন বিরহের সুর। গত প্রায় ৮-১০ বছর ধরে স্টেডিয়াম পাড়ায় ক্রিকেট নিয়ে উৎসাহ, উদ্দীপনা কিংবা উত্তেজনার পারদে যেন ভাটার টান। সিলেট লিগ হচ্ছে, কিন্তু, স্টেডিয়ামের পরিবেশে তার কোনো প্রভাবই নাই। সিলেট লিগ নিয়ে স্থানীয় কাগজেও বিশেষ কোনো সংবাদ পরিবেশন ব্যবস্থা কিংবা উদীয়মান ক্রিকেটারদের নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন আজ আর চোখে পড়ে না বললেই চলে। খেলার সংক্ষিপ্ত স্কোর বিবরণী দিয়েই সংবাদমাধ্যম দায় সারছে।

হারিয়ে যাচ্ছে ড্রেসিং রুমের সামনে ক্লাব কর্তাদের অস্থির পায়চারির দৃশ্য। ক্ষণে ক্ষণে ম্যাচের রঙ বদলানো, ক্লাব কর্মকর্তাদের মধ্যকার চাপা উত্তেজনা, কখনো কখনো গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ক্যাচ মিস কিংবা ফিল্ডিং মিস করায় উত্তেজিত হয়ে বাক্যালাপ আজ আর নেই বললেই চলে। ক্রিকেট কোচদের মধ্যেও এক সময় অদৃশ্য লড়াই চলতো নিজের দল কে সফল করে তোলার জন্যে। আজ সেসবেও ধূলো জমতে জমতে মলিন হয়ে পড়েছে।

বৃষ্টির মৌসুমে লিগ আয়োজন, দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে লিগ খেলা-গত কয়েক বছর এমন অনেকবারই হয়েছে। কার্টেল ওভার ম্যাচ খেলে উদীয়মান ক্রিকেটারদের পারফর্ম করার জায়গা সংকুচিত হয়েছে। এছাড়া এখন যখন সাদা বল রঙিন জার্সিতে ক্রিকেট ম্যাচ হওয়াটা খুব সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানেও সিলেট লিগ লাল বল, সাদা পোষাকে অনুষ্ঠিত হয়েছে। লিগের জৌলুস কমে যাওয়ায় স্পন্সরশিপও পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে।

জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক খেলার সূচীর চাপে এখন জেলা স্টেডিয়ামেও স্থানীয় লিগের জন্যে ভেন্যু করতে বেগ পেতে হচ্ছে। দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগ নিয়মিত আয়োজন করা যাচ্ছে না। স্কুল ক্রিকেট নিয়মিত আয়োজন হচ্ছে, স্টেডিয়ামের বাইরের ভেন্যুতেই অধিকাংশ খেলা আয়োজন করতে হচ্ছে। গত ১০ বছরে প্রচুর ক্রিকেটার বেড়েছে সিলেটে। বেশ কয়েকটা অ্যাকাডেমি নিয়মিত অনুশীলন পরিচালনা কার্যক্রম পরিচালনা করায় ক্রিকেটাররা বিকল্প ব্যবস্থায় অনুশীলন করার সুযোগ পাচ্ছে, প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্রিকেটার বেরিয়ে আসছে। কিন্তু, ভাবনার বিষয় হচ্ছে, এই যে এত ক্রিকেটার বেরুচ্ছে, তাদের ক্রিকেট প্রতিভা কতখানি বিকশিত হচ্ছে, কতখানি তারা নিজেদের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের জন্যে প্রস্তুত করতে পারছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিলেট লিগ কিংবা ২য় বিভাগ ক্রিকেট লিগে ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিদ্বন্দিতা হচ্ছে না। ক্রিকেটারের সংখ্যা বাড়লেও মান কতটুকু বেড়েছে সেটি নিয়ে ভাবতে হবে।

সেই ৯০ দশকে যখন মাঠে গিয়ে খেলা দেখার শুরু হয়েছিল, আজ প্রায় ২৫ বছর পেরিয়ে যাবার পর ভাবতে হচ্ছে সিলেটের ক্রিকেট কি তার কাংখিত লক্ষ্যের দিকে ছুটতে পারছে? দেশের ক্রিকেটে একটা বিভাগীয় শহরের ক্রিকেট যে উচ্চতায় ওঠার কথা ছিলো তা কি উঠেছে?

দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ক্রিকেটের দিকে তাকালে বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এই শহরেরই চারজন ক্রিকেটার একসঙে লাল-সবুজের স্কোয়াডে ছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় জাতীয় দল, এ দল, অ্যাকাডেমি দল, যুব দল ইত্যাদিতে সিলেটের ক্রিকেটারদের ছড়াছড়ি হবার স্বপ্ন দেখা যুবাদের আজ হতাশায় ঘিরে ধরেছে। নিয়মিত মাঠে এসে ঘাম ঝরিয়ে রাজিন-অলক, তাপস-এনাম হবার স্বপ্নের পালে জোর হাওয়া বইয়ে দেবার কোনো ব্যবস্থার অপেক্ষায় বিনিদ্র রজনী কাটছে কত শত ক্রিকেটারের! সে খবর কে রাখে!

তবুও আশায় বুক বাঁধতে হয়, সামনের দিকে এগুতে হয়। সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার নবনির্বাচিত কমিটি সিলেটের ক্রীড়াঙ্গন এবং বিশেষ করে ক্রিকেটে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনবেন। এই সিলেট থেকে আরো অনেক অলক কাপালি, রাজিন সালেহ, তাপস বৈশ্য, আবু জায়েদ রাহি, জাকির হাসান, খালেদ আহমেদ বেরিয়ে আসবে। সেই আশায় বসতি গড়া ক্রিকেটারদের মাথায় স্থানীয় কর্মকর্তাদের আশ্বাসের হাত যেন থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link