More

Social Media

Light
Dark

অশ্রুসজল আত্মবিশ্বাস

মাঠে ততক্ষণে উদযাপন শেষ। যতই লিগ জিতুক না কেন, একটা না একটা সময় এসে তো ক্লান্ত হতেই হয়। অ্যাটলেটিকোর খেলোয়াড়েরাও হয়েছেন। ক্লান্তি কাটাতে মাঠের একেক প্রান্তে যখন একেকজন নিজেদের মতন করে সময় কাটাচ্ছেন তখন সুয়ারেজ ব্যস্ত হয়ে পরলেন নিজের ফোন নিয়ে।

মাঠে তখন টিভি ক্যামেরা ঘুরে চলছে খেলোয়াড় থেকে খেলোয়াড়ে। প্রত্যেকের আবেগটা দর্শকদের সামনে পোঁছে দেওয়ার চেষ্টা মাত্র। ক্যামেরাটা অনেকক্ষণ ঘুরে লুইস সুয়ারেজের সামনে এসে যেন একটু থমকে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ ঘুরে তার চোখের ভাষা বুঝতে চাইলো যেন। চোখের ভাষা বুঝিয়ে বলার মতন কিছু বাকি ছিল না। তার চোখই কথা বলছিল। জলে ছলছল করছিল তাঁর চোখ।

মৌসুমের শুরুটা সুয়ারেজ কখনও ভুলবেন না। সুয়ারেজের ক্যারিয়ার আজীবনই রোলার কোস্টার রাইড। এখান থেকে সেখানে, এই বিতর্ক থেকে সেই বিতর্কে ঝাপিয়ে পরেছেন। ফুটবল বিশ্বও তাঁকে দেখে সেই চোখেই। কিন্তু সুয়ারেজ জীবনে কখনও এমন ‘অনাকাঙ্খিত’ বোধ করেননি তিনি।

ads

ইউরোপে আগমনের পর থেকে তাকে নিয়ে প্রচুর কন্ট্রোভার্সি হয়েছে ঠিকই কিন্তু তাঁকে দলে নেওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল অনেক দল। বার্সেলোনাও তার জীবনে এসেছিল সেরকম একটা সময়ে।

বিশ্বকাপে জর্জিও চিয়েলিনিকে কামড়ে দিয়ে যখন ইউরোপ থেকে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন, তখন তাঁর দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল বার্সেলোনা। বার্সেলোনার সাথে এক মধুর ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল প্রথমদিন থেকেই। দুই হাত ভরে হাতে নিজেদের করে নিয়েছেন মেসি-নেইমার।

তৈরি করেছেন পৃথিবীর ভয়ানক ‘এমএসএন’ ত্রয়ী। অথচ সেই বার্সেলোনাই তাকে সেই অনুভূতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো। মৌসুমের শুরুতে রোনাল্ড কোম্যান এসে স্রেফ বলে দিলেন, তোমাকে আমার দরকার নেই। ফুটবল ক্যারিয়ারে এই প্রথম নিজেকে এমন অবস্থায় আবিস্কার করলেন সুয়ারেজ।

সুয়ারেজ নিজেকে এমন অবস্থায় আবিষ্কার করেছিল খুব ছোট্ট থাকতে। প্রতিদিন পেটে দেওয়ার মতন খাবারো জুটত না একসময় তার, উরুগুয়ের রাস্তায় তিনি ছিল পরিচ্ছন্নতাকর্মী। পেটের খিদে মেটানোর জন্য রাতে পরিস্কার করতেন রাস্তা আর মনের খিদে মেটানোর জন্য খেলতেন ফুটবল।

এর মাঝেই আবিষ্কার করেছিলেন জীবনের ভালোবাসাকে। সোফিয়া ব্যালবি, সেই শহরের বড়লোক পরিবারের মেয়ে। বাংলা সিনেমার কোনো স্ক্রিপ্ট রাইটার যেন দায়িত্ব নিয়ে লিখছিলেন সুয়ারেজের গল্প। তার অনুপ্রেরণাতেই ফুটবল আকড়ে ধরেছেন, জীবনসঙ্গী হয়েছেন। তাকে পাশে নিয়েই ইউরোপে ছড়ি ঘুরিয়েছেন।

পাশে থাকা সোফি কখনও সুয়ারেজকে আবাঞ্চিত মনে করতে দেননি। সেটাই করেছে বার্সেলোনা। দিনশেষে যখন সোফি নিজে আর সন্তানদের জন্য সুয়ারেজকে অনুরোধ করলেন স্পেনেই থেকে যেতে, ব্যর্থ মনে ক্লাব খুঁজতে বেরোলেন ‘এল পিস্তোলোরো’।

স্পেনেই হাত বাড়িয়ে দিলেন ডিয়েগো সিমিওনে। সিমিওনে খুব ভালোভাবেই জানেন তার কী প্রয়োজন, কোথায় প্রয়োজন, কখন প্রয়োজন। সুয়ারেজ আর অ্যাটলেটিকোর মধ্যে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার বিশাল ওয়েজ বিল। সেটাও বলাতেই কমিয়ে নিলেন তিনি। কথাটা স্ট্রেইট কাট, প্রমাণ করতে চান তিনি। আজ যে বার্সেলোনা তাকে বয়স আর ধার কমার অজুহাত দেখাচ্ছে, সেই বার্সাকে দেখিয়ে দিতে চান তিনি। ‘এল পিস্তোলেরো’ নামটা তাঁকে কেন দেওয়া হয়েছে!

ছবিতে মলিন হাসি, প্রেসে ঠিকই বলছেন, অ্যাটলেটিকোতে আসতে পেরে বেশ খুশি আমি। ভেতরটা তখনও তার কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে যন্ত্রণা। সিমিওনে তার গায়ে তুলে দিলেন ‘৯’ নম্বর জার্সি। বাকি গল্পটা সাজালেন দুই বাতিল মাল নিয়ে।

বার্সা থেকে বাতিল হয়ে অ্যাটলেটিকোতে ভিড়েছিলেন সুয়ারেজ, আর মাদ্রিদ থেকে মার্কোস ইয়োরেন্তে। সিমিওনের জহুরীর চোখ, কয়লার দামে আস্ত হীরে পেয়েছেন। শুধু তাঁদের জ্বালিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা। সিমিওনে বারুদ জ্বালাতে পারেন, প্রমাণটা মৌসুম শুরু হতে না হতেই পাওয়া গেল।

সুয়ারেজকে বের করে দেওয়া হয়েছিল ফুরিয়ে যাওয়া সেনানী হিসেবে। আর ইয়োরেন্তেকে জ্বলে উঠতে পারেন না বলে। এক ফুরিয়ে যাওয়া আর জ্বলে উঠতে না পারা তারকাকে একত্র করলে কী হয় সেটার প্রমাণ দেখিয়ে দিয়েছে অ্যাটলেটিকো। ইয়োরেন্তের ১২ গোল, ১১ অ্যাসিস্ট আর সুয়ারেজের ২১ গোল, ৩ অ্যাসিস্টই তার প্রমাণ।

সুয়ারেজের গল্পটা সুয়ারেজ নিজেই বললেন ম্যাচ শেষে। প্রেসের মাইক যখন সুয়ারেজকে ঘিরে ধরলো, সুয়ারেজ খুব সহজ সুরেই গল্পটা বললেন, ‘বার্সেলোনা আমায় মূল্য দেয়নি, অ্যাটলেটিকো সেই সময় তাদের দরজা খুলে দিয়েছে। আরেকটা সুযোগ দিয়েছে। সেজন্য আমি আজীবন কৃতজ্ঞ তাদের কাছে।’

কৃতজ্ঞতার দাম সুয়ারেজ দিয়েছেন নিজের মতন করে। সিমিওনে আসার পর থেকেই অ্যাটলেটিকো বেশ শক্তিশালি প্রতিপক্ষ, কিন্তু বোটল করার স্বভাবটা অনেক পুরোনো। সামনে থেকেও ট্রফি হাতছাড়া করবার রেকর্ড তাদের বহু। সুয়ারেজ সেখানেই হয়ে এসেছেন ত্রাতা।

তার ২১ গোল থেকে অ্যাটলেটিকো পেয়েছে মোট ২১ পয়েন্ট। এদিক দিয়ে তার ধারে কাছে শুধু বেনজেমা, ১৯ পয়েন্ট নিয়ে। শেষ দুই ম্যাচই তার প্রমাণ। লিগা হারানোর শঙ্কায় যখন অ্যাটলেটিকো, দেবদূত হয়ে নেমে এসেছেন সুয়ারেজ। ওসাসুনার সাথে ৮৮ মিনিটে গোল, ভায়াদোলিদের বিপক্ষে লিগ জেতানো গোল।

কথায় আছে ‘Revenge is the dish best served cold’. পুরো মৌসুমে বার্সেলোনা গোল পেয়েছে প্রচুর, কিন্তু ছোট ছোট দলের সাথে পয়েন্ট হারিয়ে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়োল মেরে বসেছে। আর সেই ছোট ছোট দলের বিপক্ষেই জয়ের তরী বন্দরে ভিড়িয়েছেন সুয়ারেজ।

আলাভেস, এইবারের সাথে ম্যাচ জেতানো গোল, রিয়াল, সেল্টা ভিগোর বিপক্ষে ম্যাচ বাঁচানো গোলই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। সুয়ারেজের প্রতিটা গোল যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বার্সেলোনাকে, ভুল করেছো তোমরা। আর সুয়ারেজ নিজেকে প্রমাণ করেছেন নিজের ভালোবাসার আকাছে, তিনি এখনও পারেন!

লিগ জয়ের আনন্দটা শুধু নিজের মধ্যে রাখেননি, রাস্তায় বেরিয়ে উল্লাস করেছেন সমর্থকদের সাথে, যারা পুরো মৌসুম মাঠে আসতে না পারলেও বিশ্বাস রেখেছিল তার উপর। তাদের মাঝেই বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেকে। পুলিশ টেনেও আলাদা করতে পারেনি তাকে। ‘লা ফুরিয়া রোজা’দের সাথে এতটাই একত্ব হয়ে গিয়েছেন তিনি।

মিনিট দুয়েকের মাথায় মাঠ ঘুরে এসে সুয়ারেজের দিকে আরেকবার ক্যামেরা তাক করতেই দেখা গেল হাস্যোজ্জ্বল সুয়ারেজকে। ভালোবাসার মানুষ দিন পরিবর্তন করে দিতে পারে মুহূর্তেই, তারই প্রমাণ যেন সুয়ারেজ। আর ভালোবাসাকে পাশে নিয়ে লড়ে যাওয়া যুদ্ধে সুয়ারেজ যেন আবার প্রমাণ করলেন, ভালোবাসা থাকলে যেকোনো যুদ্ধজয়ই সম্ভব!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link