More

Social Media

Light
Dark

আঁধার কাটিয়ে মিলেছেন আঁধারেই

১২ জুন, ১৯৭৬। আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ের এক হাসপাতালে নির্ধারিত সময়ের প্রায় দুই মাস আগেই ভূমিষ্ঠ হলো এক শিশু। আর এতেই বাঁধে বিপত্তি! কঠিন দুরারোগ্য ব্যাধি ‘মেনিনজাইটিস’ নামক রোগ ধরা পড়ে ছোট্ট শিশুটির। যার কারণে নবজাতক শিশুটি জন্মগত ভাবেই ছিল শ্রবণশক্তিহীন। প্রথমে ধরতে না পারলেও পরবর্তীতে পরিবারের সবাই এ ব্যাপারে জানতে পারেন।

ডাক্তাররাও শিশুটির বাঁচার আশা দেখছিলেন না। এত অল্প বয়সে এই দুরারোগ্য রোগের সাথে লড়াই করে কত সময় বাঁঁচবে সেটাই যেন  সবার ভাবনা। তবে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে শিশুটি এভাবেই বেঁচে ছিলেন চার বছর। শ্রবণশক্তিহীন হিসেবে মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছিলেন চার বছর। এরপর ডাক্তারদের পরামর্শে শিশুটির কানে জটিল এক অস্ত্রোপচার করা হলো। স্রষ্ঠার কৃপায় শিশুটি বেঁচে ফিরল! চার বছর পর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শ্রবণশক্তি ফিরে পেল শিশুটি।

সবার আশঙ্কা ছাপিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন ওই ছোট্ট শিশু। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা সেই ছোট্ট শিশুটি পরবর্তীতে বনে যান জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। জন্মের পর চার বছর বধির থাকা সেই শিশুটিই জিম্বাবুয়ের তারকা স্পিনার রেমন্ড প্রাইস। জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে জয়ী হওয়া প্রাইস নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জিম্বাবুয়ের ইতিহাসে অন্যতম সেরা স্পিনার হিসেবে!

ads

জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে – অতিসম্ভাবনাময়ী এই দলটি এখন ধ্বংসের দুয়ারে। ফ্লাওয়ার্স ভাইদ্বয়, পল স্ট্র‍্যাঙ, হেনরি ওলোঙ্গা, মারে গুডউইন, নিল জনসনদের বিদায়ের পর মুখ থুবড়ে পড়ে দেশটির ক্রিকেট। এখন যেন স্রেফ নামেই টিকে আছে দেশটির ক্রিকেট বোর্ড। দায়ের চাপে ক্রিকেটারদের বেতন দেওয়ার সামর্থ্যটুকও নেই বললেই চলে! একসময় বড় বড় দেশগুলোকে চোখ রাঙানি দেওয়া জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট এখন খর্বশক্তির এক দল। বর্ণবাদ আর রাজনৈতিক কারণেই জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের এই করুণ দশা।

কালো অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়া জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট যাদের ঘাড়ে চেপে খুড়িয়ে খুড়িয়ে আজ এতোদূর এসেছেন তাঁদের একজন হলেন  রে প্রাইস।

বাড়ির আঙ্গিনায় খেলেই ক্রিকেটে পথচলা। ছোটবেলার সেই দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে শারীরিক সমস্যা ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। কানে ঠিক মতো শুনতে পেলেও বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা বয়ে বেড়িয়েছেন পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই যার কারণে শিক্ষা জীবন শুরু করতেও সময় লেগেছিল বেশ।

ক্যারিয়ারের শুরুটা একজন পেসার হিসেবেই! স্কুল ক্রিকেটে পেসার হলেও কলেজ জীবনে নিজেকে আবিষ্কার করেন একজন স্পিনার হিসেবে। সেখান থেকেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন একজন বাঁ-হাতি অর্থডক্স স্পিনার হিসেবে। স্কুল দলের হয়ে অন্যতম সেরা খেলোয়াড়ও ছিলেন প্রাইস!

ক্রিকেটের পাশাপাশি প্রাইস বেশ ভালো গলফারও! প্রাইসের চাচা নিক প্রাইস ছিলেন একজন প্রোফেশনাল গলফার। ১৯৯৪ ব্রিটিশ ওপেনে তিনি গলফ চ্যাম্পিয়নও হন!

১৯৯৫ সালে ম্যাশোনাল্যান্ড কাউন্ট্রি জোনের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। ক্যারিয়ারের শুরুর সময়টাই ফ্রিজ ও এসি মেরামতের কাজও শিখেছিলেন। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে তখন স্পিনার হিসেবে বেশ খ্যাতি ছিল পল স্ট্র‍্যাঙ, অ্যাডাম হাকলদের। তবে ইনজুরির কারণে ভাগ্য খুলে যায় প্রাইসের। ১৯৯৯ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে স্কোয়াডে জায়গা পান প্রাইস। ওই সিরিজের তৃতীয় টেস্টে সাদা পোশাকে অভিষিক্ত হন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলার শুরুটা এখানেই।

বছর খানেকের মাথায় বুলাওয়েতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম পাঁচ উইকেট শিকার করেন তিনি। তবে বাকিদের ভিড়ে দলে নিয়মিত হতে পারেননি এই স্পিনার। ক্যারিয়ারের প্রথম কয়েক বছরে দলে আসা যাওয়ার মধ্যেই ছিলেন তিনি। প্রাইসের ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ২০০১ ও ২০০২ সালে!

ওই মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতের বিপক্ষে টানা দুই ম্যাচে নেন ফাইফর। ভার‍তের বিপক্ষে দুই টেস্টে টানা তিন ইনিংসে শচীন টেন্ডুলকারকে আউট করেন এই স্পিনার! এরপর ২০০৩ সালের ইংল্যান্ড সফরে আবারও নিজেকে প্রমাণ করেন তিনি। সেখানে তাঁর দুর্দান্ত বোলিং দেখে অনেকেই ইংলিশ স্পিনার অ্যাশলে গিলসের চেয়েও উপরে রেখেছিলেন প্রাইসকে। ততদিনে ওয়ানডে দলেও অনেকটাই নিয়মিত মুখ তিনি!

পরবর্তীতে ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সিডনিতে ৬ উইকেট শিকার করে নিজের সামর্থ্যের সেরাটা দিয়ে জানান দেন প্রাইস। পরের সিরিজেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মাত্র ২ টেস্টে শিকার করেন ১৯ উইকেট! সাদা পোশাকে নিজের ক্যারিয়ার সেরা মৌসুমের পরেও দীর্ঘ হয়নি প্রাইসের টেস্ট ক্যারিয়ার! ২০০৩ সালে মাত্র ৬ টেস্টে ২৭ উইকেট শিকার করেন; যার মাঝে তিনবার পাঁচ উইকেট শিকার করেন এই স্পিনার।

২০০৪ সালে ২ টেস্টে ৮ উইকেট শিকারের পর কাউন্টি দল উস্টারশায়ারের ডাকে প্রাইস পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে! মূলত হিথ স্ট্রিকের নেতৃত্বে বিভিন্ন দাবিতে বোর্ডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করায় বাদ পড়েন তিনি। এরপর পাড়ি জমান কাউন্টি খেলতে, অবশ্য লক্ষ্য ছিল ইংল্যান্ড ক্রিকেটের হয়ে খেলা! তবে সেটি পারেননি। প্রায় ২ বছর পর আবার ফিরে আসেন জিম্বাবুয়েতে।

ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরলেও ২০০৭ বিশ্বকাপের দলে জায়গা হয়নি প্রাইসের। ওই সময় উস্টারশায়ার নতুন করে এক বছরের চুক্তি করতে চাইলেও প্রাইস সেটিতে কর্ণপাত করেননি। ওই মৌসুমে প্রায় তিন বছর পর আবার জাতীয় দলে ফিরেন এই স্পিনার। আবার বনে যান দলের নিয়মিত মুখ। ওয়ানডেতে নিয়মিত সুযোগ পেলেও সাদা পোশাকে আর ফিরতে পারছিলেন না তিনি। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের অবস্থাও তখন করুন!

ওয়ানডেতে প্রাইসের ইকোনমিও ছিল নজরকাড়া! ২৭ ম্যাচে ৪৫ উইকেট শিকার করে দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন করেন এই স্পিনার। দ্রুতই বিশ্বসেরা ওয়ানডে বোলিং র‍্যাঙ্কিংয়ের তিনে উঠে আসেন এই তারকা! ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের হয়ে সবক’টি ওয়ানডেতে সুযোগ পান প্রাইস।

২০১১ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) নিলামে বিক্রি না হলেও পরবর্তীতে ড্রাফট থেকে প্রাইসকে দলে ভেড়ায় মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স। টাটেন্ডা টাইবুর পর দ্বিতীয় জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটার হিসেবে আইপিএলে সুযোগ পান প্রাইস। মাত্র এক ম্যাচে সুযোগ পেলেও ৩ ওভারে ৩৩ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকেন তিনি। ওই বছরই বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট খেলার সুযোগ পান এই স্পিনার। ক্যারিয়ারের শেষটাও এখানেই! ২০১৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান প্রাইস।

ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সেরা মূহুর্তের ব্যাপারে একবার এক সাক্ষাৎকারে ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে প্রাইস বলেছিলেন, ‘একবার ভারত সফরে যাওয়ার পর দ্বিতীয় টেস্টের পর দিল্লীর চিড়িয়াখানায় ঘুরতে গিয়েছিলাম। সেখানে একজন স্টাফ এসে আমাকে বলেছিল তাঁর ছেলে আমার অনেক বড় ভক্ত আর সেও একজন বাঁ-হাতি স্পিনার।’

২২ টেস্টে শিকার করেছেন ৮০ উইকেট, ৫ বার ফাইফার ও একবার নিয়েছেন দশ উইকেট।। এছাড়া ১০২ ওয়ানডেতে মাত্র ৩.৯৯ ইকোনমিতে নিয়েছেন ১০০ উইকেট। মাত্র ১৬ টি-টোয়েন্টি খেললেও এই ফরম্যাটে ৬.১৪ ইকোনমিতে নিয়েছেন ১৩ উইকেট। এছাড়া ঘরোয়া ক্রিকেটে ৪১৭ ম্যাচে ৭১১ উইকেট আছে প্রাইসের নামের পাশে।

হিথ স্ট্রিকের পর টেস্টে তিনি জিম্বাবুয়ের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি! এছাড়া ওয়ানডেতে ১০০ উইকেট শিকার করা চার জিম্বাবুইয়ান বোলারের একজন হলেন প্রাইস!

ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় বাংলাদেশের জন্য তিনি ছিলেন আতঙ্ক। বাংলাদেশের বিপক্ষে ২৫ ওয়ানডেতে খেলেছেন এই স্পিনার। এই ২৫ ম্যাচে ১৯ মেইডেন দিয়ে ৩.৮১ ইকোনমিতে নিয়েছেন ৩৫ উইকেট। পুরো ক্যারিয়ারেই বাংলাদেশের বিপক্ষে তিনি ছিলেন ভয়ংকর ফর্মে!

নিখুঁত লাইন-লেন্থ আর টাইট বোলিংয়ে বরাবরই প্রতিপক্ষের রান আটকে রাখতেন প্রাইস। সেই সাথে উইকেট শিকারের পর প্রাইসের ইউনিক উদযাপনটাও ছিল বেশ দৃষ্টিনন্দন। জীবন যুদ্ধে জয়ী প্রাইস নিজের সীমাবদ্ধতাকে শক্তিতে রূপ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন তাঁর সময়ের অন্যতম সেরা স্পিনার হিসেবে।

এক সময় আইপিএল খেলেছেন। অথচ, সেই রেমন্ড প্রাইস মাঠের ক্রিকেট ছাড়ার পরই চলে গেছেন আড়ালে। আয়ও আগের মত নেই। ক্রিকেট সরঞ্জামের ব্যবসায় গিয়েছিলেন, কিন্তু টিকতে পারেননি। এখন এসি-ফ্রিজ মেরামতের কাজ করেন। হ্যাঁ, আজো আঙুলই তাঁর পরিচয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link