More

Social Media

Light
Dark

অজি গরিমার আরেক প্রতীক

২০০৪ সাল, ব্যাঙ্গালুরু; ভারতের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে এক ছেলের অভিষেক টেস্ট। অভিষেক টেস্টেই ভারতের মাটিতে ১৫১ রানের ইনিংস।

ওই অভিষেক দিয়েই যেন বুঝিয়ে ফেললেন, তিনি থাকতে এসেছেন। শুধু কোনোক্রমে থাকেননি। নিজের নামের জানান দিয়েই টিকে ছিলেন লম্বা একটা সময়। তিনি ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের আরেক প্রতীক-মাইকেল ক্লার্ক।

নিজের সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন মাইকেল ক্লার্ক। অস্ট্রেলিয়ার মিডল অর্ডারের অন্যতম ভরসার নাম ছিলেন ক্লার্ক। দীর্ঘদিন অস্ট্রেলিয়া দলে ছিলেন রিকি পন্টিংয়ের সহকারী হিসেবে এবং রিকি পন্টিংয়ের সহকারী থেকে যখন অধিনায়ক হিসেবে পদোন্নতি পান তখন আরো ক্ষুরধার হয়ে উঠেন মাইকেল ক্লার্ক।

ads

মাইকেল ক্লার্কের নিউ সাউথ ওয়েলস দলের হয়ে অভিষেক মাত্র ১৮ বছর বয়সে। নিউ সাউথ ওয়েলেসে হয়ে ভালো পারফর্ম করার স্বীকৃতি স্বরূপ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট একাডেমি থেকে বৃত্তি পান। সাথে অস্ট্রেলিয়া যুব দলের অধিনায়ক হিসেবে যুব বিশ্বকাপ খেলেন মাইকেল ক্লার্ক।

২০০২ সালে নিউ সাউথ ওয়েলেসের হয়ে দুর্দান্ত পারফর্ম করার পুরস্কার স্বরূপ তিনি সুযোগ পান অস্ট্রেলিয়া ‘এ’ দলের হয়ে। অস্ট্রেলিয়া ‘এ’ দলের হয়ে ইংল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ভালো পারফর্ম করে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট অঙ্গনে বেশ ঝড় তোলেন।

২০০৩ বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে অস্ট্রেলিয়া দলে বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিল। এই সময়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষেক হয় মাইকেল ক্লার্কের। অভিষেক ম্যাচেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৯ রানে অপরাজিত থেকে অস্ট্রেলিয়াকে ম্যাচ জেতান তিনি।

নিজের অভিষেক ম্যাচে নিজের ক্রিকেট স্কিলের প্রমাণ দেন। এছাড়াও প্রথম ম্যাচেই তাঁর পারফর্মেন্স বুঝিয়ে দেয় তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বেশ উপভোগ করেছেন। জাতীয় দলে নিয়মিত না হওয়া একজন ক্রিকেটারের জন্য এইভাবে নিজেকে প্রমান করা ছিল বেশ আশ্চর্যজনক ঘটনা। ওয়ানডে দলে নিজের অবস্থান পাকা করার পর ২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্ট অঙ্গনে পা রাখেন মাইকেল ক্লার্ক।

মাইকেল ক্লার্ক যখন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ভারতের বিপক্ষে নিজের প্রথম টেস্ট খেলতে নামেন তখন তাঁর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ব্যাটিং গড় ছিল ৪০-এর কম। যা অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট সংস্কৃতির ভিত্তিতে বেশ কম। এরপরেও অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল মাইকেল ক্লার্কের। অভিষেক ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ১৫১ রানের ইনিংস খেলে নিজের টেস্ট খেলার সামর্থ্যে প্রমাণ বেশ ভালো ভাবেই দেন তিনি। ভারতের মাটিতে ৩০ বছরের মধ্যে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি।

নিজের এই স্বপ্ন যাত্রার দুর্দান্ত শুরু পর ব্রিসবেনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আবারো সেঞ্চুরি হাঁকান তিনি। ২০০৪ সালে ভালো করার স্বীকৃতি স্বরুপ ২০০৫ সালে অ্যালান বোর্ডার মেডেল অর্জন করেন তিনি।

স্বপ্নের মত শুরু পর ২০০৫ সালেই খারাপ ফর্মের দেখা পান মাইকেল ক্লার্ক। বিশেষ করে ২০০৫ সালে অ্যাশেজ সিরিজে কোনো সেঞ্চুরি করতে পারেন নি তিনি। আর পুরো ২০০৫ সালেই খারাপ ফর্মের সাথে লড়াই করে গেছেন তিনি। এর ফলে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েন ক্লার্ক। দল থেকে বাদ পড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন নি তিনি। ঘরোয়া ক্রিকেট এবং ওয়ানডেতে আবারো রান বন্যা শুরু করেন। এর ফলে আবারো টেস্ট দলে ডাক পান তিনি।

২০০৬ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ এবং অ্যাশেজে বেশ ভালো পারফর্ম করেন তিনি। অ্যাশেজের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় টেস্টে সেঞ্চুরি করেন তিনি। এই সেঞ্চুরির মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া টেস্ট দলে নিজের অবস্থান পাকা করে নেন ক্লার্ক।

এরপর আর ফর্মের কারণে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েন নি তিনি। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের অস্ট্রেলিয়া দল টানা তৃতীয় বারের মত বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তোলে। এই দলের বেশ গুরুত্বপূর্ন সদস্য ছিলেন তিনি।

মাইকেল ক্লার্ক শুধু একজন ব্যাটসম্যান ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দুর্দান্ত ফিল্ডার এবং কার্যকর একজন স্পিন বোলার। দলের প্রয়োজনে মাঝে মাঝে বল করতেন মাইকেল ক্লার্ক।

ক্লার্কের দুর্দান্ত পারফর্মেন্স তাকে জাতীয় দলের সহঅধিনায়কের দায়িত্ব এনে দেয়। ২০০৮ সালে অ্যাডাম গিলক্রিস্টের বিদায়ের পর রিকি পন্টিংয়ের সহকারীর দায়িত্ব নেন ক্লার্ক। ২০১১ সালে টানা চতুর্থ বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন নিয়ে উপমহাদেশের মাটিতে বিশ্বকাপ খেলতে আসে অস্ট্রেলিয়া।

কিন্তু, অস্ট্রেলিয়া দলের আর বিশ্বকাপ জেতা হয়ে ওঠেনি। কোয়াটার ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে বিদায় নেয় অস্ট্রেলিয়া। আর এর পরেই অস্ট্রেলিয়ার দলের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান মাইকেল ক্লার্ক।  অধিনায়কের দায়িত্ব নিয়েই টেস্ট এবং ওয়ানডে ক্রিকেটকে সময় দেওয়ার জন্য টি-টোয়েন্টিকে বিদায় জানান তিনি।

মাইকেল ক্লার্কের ক্যারিয়ারের সেরা সময় ছিল ২০১২ সাল। এই বছরে ১০৬.৩৩ গড়ে তিনি করেছিলেন ১৫৯৫ রান। এই বছরের শুরু করেছিলেন সিডনিতে ভারতের বিপক্ষে ৩২৯ রানের অপরাজিত এক ইনিংস খেলে। এরপর অ্যাডিলেডে খেলেন ২১০ রানের এক ইনিংস। ওয়ালি হ্যামমন্ড এবং স্যার ডন ব্রডম্যানের পর একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে একই সিরিজে ত্রিপল সেঞ্চুরি এবং ডাবল সেঞ্চুরি করার রেকর্ড গড়েন তিনি।

২০১২ সালেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ব্রিসবেন এবং অ্যাডিলেডের টানা দুই টেস্টে দুইটি ডাবল সেঞ্চুরি করেন তিনি। এর মাধ্যেমে তিনি টেস্ট ইতিহাসের একমাত্র ক্রিকেটার একই বছরে চারটি ডাবল সেঞ্চুরি করার রেকর্ড গড়েন।

২০১৩ সালে বেশ অস্থিরতার মধ্যে কাটান মাইকেল ক্লার্ক। ২০১৩ সালে ভার‍ত সফরে অস্ট্রেলিয়ার কোচ মিকি আর্থার চারজন ক্রিকেটারকে নিষিদ্ধ করেন। এর ফলে ভারতের মাটিতে ৪-০ ব্যবধানে সিরিজ হেরে যায়। একই বছরে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত অ্যাশেজ সিরিজেও হোয়াইটওয়াশ হয় অস্ট্রেলিয়া।

২০১৩ সালে অধিনায়কত্বের খারাপ সময় কাটানোর পর আবারো ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করে অস্ট্রেলিয়া। ২০১৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কেপ টাউনে টেস্টে প্রোটিয়া পেসার মরনে মরকেলে বলে কাধে ইনজুরি প্রাপ্ত হবার পরও সেঞ্চুরি করে দলকে জেতান তিনি।

এই বছরই শন অ্যাবটের বাউন্সারে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে ওপারে পাড়ি জমান ফিলিপ হিউজ। বন্ধুর মৃত্যুর শোককে শক্তিতে পরিণত করে ভারতের বিপক্ষে দুর্দান্ত পারফর্ম করেন।

এরপর ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ জিতে নেন অধিনায়ক হিসেবে। এই বিশ্বকাপের পর আবারো ইংল্যান্ডের মাটিতে অ্যাশেজ সিরিজ হারে মাইকেল ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়া। এই সিরিজের পর স্টিভেন স্মিথের হাতে দায়িত্ব দিয়ে সব ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি।

মাইকেল ক্লার্কের ক্রিকেটীয় দক্ষতা কিংবা ক্রিকেটের প্রতি তাঁর ডেডিকেশন নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠবে না। এছাড়াও জাতীয় দলের হয়ে তাঁর পারফর্মেন্স কখনো ভোলার মত নয়। অধিনায়ক হিসেবে তাঁর কীর্তি এবং দুর্দান্ত সব পারফর্মেন্স এবং ক্রিকেটারদেরকে সাহস যোগানোর কাজ বেশ ভালো ভাবেই করেছেন মাইকেল ক্লার্ক।

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link