More

Social Media

Light
Dark

মদ-মাদ্রাজ-জীবনানন্দ ও ফক্সি ফাওলার

১৯৮৩-৮৪ মৌসুম। অকল্যান্ড। অরেঞ্জ টাকিলা আর জিন খেয়ে তিনি টালমাতাল হয়ে হাঁটছিলেন, পড়ে যাচ্ছিলেন। পড়তে পড়তে পড়লেন একটা কফি টেবিলের ওপর। কাঁচ ভেঙেচুড়ে বিচ্ছিরি এক অবস্থা। ওয়েটাররা পরিস্কারে নেমে গেলেন। দূর থেকে বসে কাণ্ডকারখানা দেখছিলেন সেই পার্টির আয়োজক এলটন জন ও তাঁর সেই সময়কার স্ত্রী রেনাটে।

কয়েক বছর পর পার্থের হোয়াইট হর্স ইয়ট ক্লাবে আবারো দেখা দু’জনের। সেদিনের সেই মাতাল ‘ভদ্রলোক’কে এলটন জন বললেন, ‘আমি ভাবতাম ক্রিকেটাররা একেবারেই বিরক্তিকর। তবে, এরপর অকল্যান্ডে তোমার সাথে আমার দেখা হয়। তোমার মত এন্টারটেইনার আর দেখিনি।’

এই এন্টারটেইনারটি হলেন গ্রায়েম ফাওলার। তিনি প্রথম দিকটায় একদমই ফুর্তিবাজ মদ্যপ ছিলেন না। কিন্তু, তাঁর জীবনে এসেছিলন ইয়ান বোথাম। ‘হেডলক’ অবস্থায় হুইস্কির প্রস্তাব দেন। হেডলক ব্যাপারটার সাথে এখানে পরিচয় করিয়ে দেওয়া দরকার। রেসলিংয়ে যেমন দেখা যায়, হাত দিয়ে শক্ত করে গলা জাপটে ধরে নিশ্বাস বন্ধ করে দেওয়াকে ‘হেডলক’ বলে।

ads

যাই হোক, ২০ মিনিট ধরে হেডলক অবস্থায় বোথামের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে যান ফাওলার। বোথাম ক্ষেপে যান। ফ্লাওয়ারে মাথায় হুইস্কি ঢেলে দেন।

তবে, মদ্যপ হন বা নাই হন, ফ্লাওয়ার ব্যাট করতে জানতেন। সেটা ল্যাঙ্কাশায়ারের সব ভক্তই জানেন। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়লেও কাউন্টি দল ল্যাঙ্কাশায়ারের জন্য তিনি ছিলেন ‘সলিড ফোর্স’। ১৬ হাজারের ওপর রান করেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। ক্যারিয়ার শেষ করার আগে বাঁ-হাতি এই ব্যাটসম্যানের নামের পাশে ছিল ৩৬ টি সেঞ্চুরি আর ৮৫ টি হাফ সেঞ্চুরি। তবে, বেশি জনপ্রিয়তা পান রেডিওতে ধারাভাষ্যকার হিসেবে।

এই ল্যাঙ্কাশায়ার থেকে তাঁর জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার ঘটনাটা এখানে না বললেই নয়। ল্যাঙ্কাশায়ারের ড্রেসিংরুমে বসেছিলেন তিনি। টিম বয় রন স্প্রিঙ্গস এসে বললেন, ‘ফোন এসেছে।’

‘কে?’ নির্বিকার ফাওলার।

‘বব উইলিস!’

‘অ্যাই, আমার সাথে মজা করছো! এসব আমার পছন্দ না।’

না, বিষয়টা ঠাট্টা ছিল না। ফোন ধরলেন ফাওলার।

‘হ্যালো!’

অপর প্রান্তে উইলিস, ‘আমরা চাই আগামী সপ্তাহে হেডিংলিতে (পাকিস্তানের বিপক্ষে) তুমি খেলো।’

‘কেন?’ – ইংলিশ অধিনায়ক এই প্রশ্নের জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলেন না।

‘ধুরু… আমরা চাই তুমি ওপেন করো!’

‘ওহ, হ্যা তাইতো। ঠিক আছে।’

এই উইলিস তাঁর নাম দিয়েছিলেন ফক্সি, ফক্সি ফাওলার। দলের সবাই তাঁকে ফক্সিই ডাকতো। এক উইলিসই ‘গ্রায়েম’ বলে ডাকতেন।

কাট টু ১৯৮৫ সাল। মাদ্রাজ টেস্ট। মুখোমুখি ভারত ও ইংল্যান্ড। চিপকের সেই গরমে ইংল্যান্ড জিতেছিল নয় উইকেটের বিরাট ব্যবধানে। ইতিহাস ও ঐতিহাসিকরা সেই টেস্ট নিয়ে কম কাব্য করেননি।

ম্যাচের অনেক নায়কই ছিলেন। দুই ইনিংসে ১১ উইকেট নিয়েছিলেন নিল ফস্টার, ডান হাতি ফাস্ট বোলার। মাইক গ্যাটিং ২০৭ রানের ইনিংস খেলেন। শুধু গ্যাটিং নয়, টপ অর্ডারে আরেক ইংলিশ সেবার ডাবল সেঞ্চুরি করেন। তিনি হলেন সেই গ্রায়েম ফ্লাওয়ার। তাঁর ব্যাট থেকে আসে ২০১ রান।

কিন্তু, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। সেটাই তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট সিরিজ। মাত্র ২৭ বছর বয়সেই নি:শেষ হয় তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ার। পরের টেস্টটা হয় কানপুরে। সেখানেও যে একটা ইনিংস ব্যাট করার সুযোগ পান সেখানে ৬৯ রান করেন গ্রায়েম ‘ফক্সি’ ফাওলার।

তবে, এরপর আর তাঁকে টেস্ট দলের জন্য বিবেচনাই করেনি ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি)। করার সুযোগই ছিল না, কারণ পরের গ্রীস্মেই ফিরে আসেন গ্রাহাম গুচ, গুচকে জায়গা দিতে গিয়ে হারিয়ে যান ফক্সি।

ফক্সিকে দুর্ভাগা বলা যায়। যদিও, কেউ কেউ তাঁকে সৌভাগ্যবান বলেও মনে করেন। কারণ, ব্যাক ফুটে ভাল খেলা বাদে ফাওলারের বড় কোনো গুণ ছিল না। বেশ আপত্তিকর ও বিরক্তিকর কায়দায় টানা বল ‘লিভ করে যেতে ওস্তাদ ছিলেন। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার তিনি কখনোই এক নম্বর পছন্দ ছিলেন না। তবে, কভারে তিনি বিশ্বমানের ফিল্ডার ছিলেন।

আশির দশকের ওই ইংলিশ সেট আপে তিনি আসেন ‍হুট করেই। বব উইলিসের ফোন পাওয়াটা আসলে ফাওলারের জন্য অপ্রত্যাশিত ছিল। ১৯৮১-৮২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় সারা বিশ্ব থেকে নামকরা বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার যান বিদ্রোহী সফরে। সেখানে ইংল্যান্ডের কয়েকজন ওপেনারও ছিলেন। সবাই নিষিদ্ধ হন।

সেই সময় কপাল খুলে ফক্সের। সেই সুযোগে তিনি ২১ টা টেস্ট খেলে ফেলেন। ফলে তাঁকে ভাগ্যবান বলাই যায়। আর ক্যারিয়ারের শেষ সফরেই সবচেয়ে স্মরণীয় সময় কাটান। ক্যারিয়ারটাকে সাদামাটাই বলা যায়।

৩৫-এর ওপর গড় নিয়ে ১৩০০’র ওপর রান করেন টেস্টে। তিনটি সেঞ্চুরি ও আটটি হাফ সেঞ্চুরি করেন। ওয়ানডেও খেলেছিলেন। ২৬ ওয়ানডেতে ৩১ গড়ে ব্যাট করে করেছিলেন চারটি হাফ সেঞ্চুরি।

ড্রেসিংরুমে জোকার ছিলেন। সবাই তাই ভাবতেন এই ছোকড়ার ‘টপ ফ্লোর’ খালি। কিন্তু, যখন তিনি সানডে টেলিগ্রাফের হয়ে কলাম কিংবা বিবিসির ‘টেস্ট ম্যাচ স্পেশাল’-এ কাজ করা শুরু করেন – তখন তাঁর সব ‘দুর্নাম’ ঘুচে যায়।

তাঁর আত্মজীবনী ফক্স অন দ্য রান খুব বিখ্যাত। সেখানে ১৯৮৪-৮৫ সালে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ (৪-১ ব্যবধানে জিতে ইংল্যান্ড) প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘(রবি) শাস্ত্রীর জন্য ওরা সিরিজটা হেরেছে। হয়তো সে সিরিজ সেরা হয়েছিল, কিন্তু সে জন্যই আমরা সিরিজ জিতি।’

যদিও, আমুদে এই জীবনে অন্ধকার নেমে আসে ২০০৪ সালের পর এসে। মানসিক অবসাদে ভোগা শুরু করেন। এর আগে কাউন্টি দল ল্যাঙ্কাশায়ারে ছিলেন নানা পদে। তবে, এরপর থেকে সবই বন্ধ। ফক্সি এখনও বেঁচে আছেন। তবে, তাঁর খবর কেউ রাখে না।

তবে, এর মধ্যেও নিশ্চয়ই যেটা সবচেয়ে ভাল পারেন সেটা করছেন। জীবনকে ভালবাসছেন ফ্লাওয়ার। তাই তো বিষন্নতা কাটিয়ে আবার ফিরতে পেরেছেন।

মজার একটা তথ্য দিয়ে শেষ করে। ৮৪-৮৫’র বিখ্যাত সেই ভারত সফরের বিশ্রামের দিনগুলোতে ফাওলার কি করতেন জানেন? ‘ক্রিকেট রাইটার্স’ নামের একটা বুক শপে সময় কাটাতেন। সেখান থেকে উইলবার স্মিথ ও পিজি ওডহাউজের বইও কিনে আনেন!

আজকালকার ক্রিকেটারদের মধ্যে কাউকে এরকম করতে দেখা যায় কি!

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link