More

Social Media

Light
Dark

সাকিবও মানুষ!

সাকিব আল হাসান টেস্ট ম্যাচ খেলবে না, এই নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলছেন। বেশিরভাগই যেহেতু গালাগালি করছেন, আমি ভাবলাম, এই চান্সে আমিও নিজের দুই কথা বলে ফেলি।

মূল সমস্যাটা আসলে ‘জেনারেশন গ্যাপ’-এ। যেমন, আমরা যে সময়ে বড় হয়েছি, তখন দেশের জার্সি গায়ে ক্রিকেট ফুটবল খেলতে নামাকে অন্যরকম সম্মান হিসেবে বিবেচনা করা হতো। আমরা দেখেছি বিশ্বকাপের মাঝে টেন্ডুলকারের বাবা মারা যাওয়ায় তাঁকে দেশে ছুটে যেতে।

পিতাকে চিতার আগুনে পুড়িয়ে পরের ফ্লাইটেই আবার বিশ্বকাপে ফেরত এসে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে জাঁদরেলি কায়দায় সেঞ্চুরি করে বাবাকে স্মরণ করতে। ‘দেশের জন্য’ খেলতে নামা টেন্ডুলকারের কাছে ‘পিতৃহারা শোক’ও তখন ক্ষুদ্র হয়ে গিয়েছিল।

ads

উদাহরণ টানলে এমন অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। আমরা বড় হয়েছি তাঁদের দেখে দেখে।

কিন্তু তখনকার সময়েও ক্রিকেটাররা পুরোদস্তুর পেশাদার ছিলেন। বড় দলের খেলোয়াড়রাতো অবশ্যই।

তাঁদের আগের জেনারেশন, মানে ধরেন ডন ব্রেডম্যানদের সময়ে দৃশ্য ছিল ভিন্ন। যতদূর জানি, কোন সিরিজে খেলতে হলে তাঁদের অফিস থেকে ছুটি নিয়ে খেলতে যেতে হতো। এখনকার যুগে ছোট দল, যেমন নেদারল্যান্ড, ক্যানাডা, অ্যামেরিকা, হংকংয়ের দলগুলোর খেলোয়াড়দের হয়ে থাকে। গাভাস্কারদের সময়েই ইন্ডিয়া একবার চারদিনে টেস্ট ম্যাচ জিতে গিয়েছিল বলে তাঁদের মাত্র চারদিনের জন্য বেতন দেয়া হয়েছিল, ‘পঞ্চমদিন তো খেলতেই নামোনি, বেতন চাইছো কেন?’

ব্র্যাডম্যান বলতেন, ‘খেলাকে কখনই পেশা হিসেবে নিও না, তাহলে মজা পাবে না।’

শুধু মজায় তো পেট ভরে না। তাই তাঁর পরবর্তী যুগের খেলোয়াড়রা পেশাদার হয়েছেন। কিন্তু একই সাথে খেলার প্রতি ভালবাসা/আবেগ ইত্যাদি ধরে রেখেছেন।

এখন চলছে টি-টোয়েন্টি যুগ। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের রমরমা যুগ। দুই মাসের লীগ খেলুন, কোটি টাকা ব্যাংকে জমা করুন। ইমরান খান একবার তাঁর ইন্টারভিউতে বলেছিলেন যে তিনি তাঁর একুশ বছরের ক্যারিয়ারে যত না টাকা কামিয়েছেন, আইপিএলের এক মৌসুমে এক সাধারণ খেলোয়াড় তাঁর চেয়ে বেশি টাকা কামায়। টেন্ডুলকার বা এই জাতীয় মহারথীদের কথা তিনি ধরেনইনি। এত টাকার ঝনঝনানি উপেক্ষা করা কি সহজ কথা? ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়রা শুধুমাত্র এই কারণেই বোর্ডের সাথে স্থায়ী চুক্তি করেননা। বিশ্বজুড়ে তাঁরাই টি-টোয়েন্টির ফেরিওয়ালা।

বিনোদন জগতের কথাও ধরা যাক। সদ্য প্রয়াত কিংবদন্তি এটিএম শামসুজ্জামান একবার পুরস্কার প্রাপ্তি প্রতিক্রিয়ায় আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, তিনি পেটের জ্বালা মেটাতেই সারাজীবন অভিনয় করে গেছেন। তাঁর খুব বাসনা ছিল বেছে বেছে শুধু সাহিত্য নির্ভর সিনেমায় অভিনয় করার, কিন্তু পেটের ক্ষুধা ও সংসারে টাকার অভাব তাঁকে সেই শৌখিনতা পালন করতে দেয়নি।

আরেক কিংবদন্তি হুমায়ূন ফরীদিকেও নেয়া যাক। তিনি যখন মঞ্চে অভিনয় করতেন, তখন তিনি রিকশায় যাতায়াত করতেন। যখন টেলিভিশনে এলেন, তিনি বেবি ট্যাক্সিতে চলাফেরা করার সক্ষমতা অর্জন করেন। ফিল্মে যাওয়ার পরেই তাঁর গাড়ি কেনার সামর্থ্য এলো। তিনি বলেছিলেন, তাঁকে যথেষ্ট টাকা দেয়া হোক, তিনি মঞ্চ ছাড়া আর কোথাও অভিনয় করবেন না।

এই যে বলিউড কিংবদন্তি শাহরুখ খান এত অসাধারন অভিনয় ক্ষমতা থাকার পরেও আলতু ফালতু সিনেমা করে গেলেন, মানুষের বিয়ে বাড়িতে নাচানাচি করে টাকা উপার্জন করলেন, বা অমিতাভ বচ্চনের মতন অভিনেতা তেল বিক্রির বিজ্ঞাপনের মডেল হন, তখন আমার কখনই কটু বাক্য বলার ইচ্ছা জাগে না। শাহরুখ যখন পার্কের বেঞ্চিতে ঘুমাতেন, কিংবা অমিতাভ বচ্চন দেউলিয়া হতে বসেছিলেন, তখন আমি এক পয়সা নিয়ে তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসিনি। কাজেই, তাঁরা কিভাবে টাকা উপার্জন করবেন সেটা তাঁদের ব্যাপার।

এখন সাকিব প্রসঙ্গে আসা যাক।

টেস্ট ক্রিকেট হচ্ছে অভিনয় জগতের ‘মঞ্চ নাটক’ বা ‘আর্ট ফিল্ম’। এখানে যে ভাল করবে, সে অমরত্বের খাতায় নাম লেখাবে। আর টোয়েন্টি টোয়েন্টি হচ্ছে আইটেম গান সহ ধুমধাড়াক্কা কমার্শিয়াল সিনেমা। কয়েক বছর মানুষকে বিনোদন দিবেন, তারপরে আপনার জায়গায় অন্য কেউ চলে আসবে, আপনাকে বিদায় বলে দেয়া হবে। দর্শকও আপনাকে ভুলে যাবে।

কথা হচ্ছে, আপনি কি অমর হবার জন্য খেলবেন, নাকি টাকা কামানোর জন্য?

অনেকেই বলে টাকা পয়সা বড় ব্যাপার না, পয়সা অতি তুচ্ছ।

আমি বলবো এইসব অতি ফালতু কথা, এবং এইসব কথাবার্তা কানে তোলার কোন মানে হয়না। জীবনে সুখ, স্বাচ্ছন্দ আনতে হলে অবশ্যই টাকার প্রয়োজন আছে। টাকা পকেটে থাকলেই কেবল আপনি এমন অনেক শখ পূরণ করতে পারবেন যা একজন ভিখিরি এমনকি সাধারণ মধ্যবিত্তের দ্বারা কখনই সম্ভব হয়না। মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধুর নাম টাকা।

টাকা থাকলে অনেক সময়েই অনেক মহাবিপদের হাত থেকে আপনি উদ্ধার পেতে পারেন। ব্যাংকে টাকা থাকলে খরচের জন্য আপনার বা আপনার প্রিয়জনের চিকিৎসা আটকে থাকবে না। টাকা থাকলে পেটের সন্তানকে আধবেলা খাইয়ে ঘুমাতে পাঠাতে হয়না। এর পরেও বলবেন টাকা পয়সা তুচ্ছ?

হ্যা, শুধু এইটা মাথায় রাখতে হবে, টাকা কামানোর ধান্দায় আমরা যেন ইমব্যালেন্সড না হয়ে যাই। পরিবারকে যথেষ্ট সময় দেই। আগেই একটা টার্গেট সেট করতে হবে, যেমন মাসে এক লাখ টাকা আমাকে কামাতে হবে, তাহলেই আমি এবং আমার পরিবারে ইন শা আল্লাহ, কোন অর্থাভাব থাকবে না। তারপরে সেই অনুযায়ী পড়াশোনা, চাকরি/ব্যবসা ইত্যাদি করতে হবে।

রিকশা চালিয়েও আমি মাসে এক লাখ টাকা হয়তো উপার্জন করতে পারবো, কিন্তু সেক্ষেত্রে হয়তো দিন রাত চব্বিশ ঘন্টাই আমাকে রিকশা টানতে হবে। আর ঘুষ খেয়ে কোটি টাকা কামাতে পারি, কিন্তু সেটা চুরি। ছিচকা চোর আর ঘুষখোর আমলার মাঝে বাস্তবে কোন পার্থক্য নেই। দুইটাকেই গণধোলাই দেয়া প্রয়োজন। বুঝাতে পেরেছি?

সাকিব আল হাসানেরও নিশ্চই তেমনই কোন টার্গেট সেট করা আছে। তিনি রিটায়ারমেন্টের আগে ব্যাংক একাউন্টে এত কোটি টাকা দেখতে চান। তাঁর টার্গেট অবশ্যই আমার আপনার টার্গেটের চেয়ে ভিন্ন হবে। আমি যদি নিজের বিবেচনা তাঁর উপর আরোপ করার চেষ্টা করি, তাহলে সেটি হবে অন্যায়। প্রথমত, এটা তাঁর জীবন, তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তাঁর পরিবারের কোন বিল আমি পরিশোধ করিনা।

কাজেই আমার মতের কোন অধিকারই থাকেনা। আর দ্বিতীয়ত, তিনি একজন ক্রিকেটার। খুব বেশি হলে আর চার পাঁচ বছরের মধ্যে তাঁকে রিটায়ার করতে হবে। এরপরে তাঁর আয় এইরকম থাকবে না। কমেন্ট্রি করে অথবা কোচিং করিয়ে আয় করতে হবে। কাজেই, তিনি যদি সিদ্ধান্ত নেন বাকি জীবন তিনি টেস্ট ম্যাচ খেলার পরিবর্তে টি-টোয়েন্টি লিগ খেলবেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আমার আপনার আবেগে কিছু যায় আসেনা। মাশরাফির সাথে ওকে মিলাতে যাওয়াটাও ভুল হবে। দুইজনের দুই আলাদা প্রায়োরিটি থাকতেই পারে, এবং সেটা স্বাভাবিক।

আর ক্রিকেটারদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে গুলিয়ে ফেলাটাতো সবচেয়ে বড় আহাম্মকি!  সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, সাকিব ‘অন্যায়’ বা ‘অপরাধ’ জাতীয় কিছু করছেন?  উত্তর হচ্ছে, অবশ্যই না।

কারন, আপনার মানতে যতই আপত্তি থাকুক, বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট একটি বিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রি, ক্রিকেটাররা এর কর্মী, আমরা কাস্টমার; এবং এই সিদ্ধান্ত ক্রিকেটারের যে সে এর কোন শাখায় চাকরি করবে বা শ্রম দিবে। আমি আপনি আমরা সবাই কি দেশের সেনা/নৌ/বিমানবাহিনীতে নাম লেখাই? আমি একজন একাউন্ট্যান্ট, যে আমাকে বেশি বেতন ও সুবিধা দিবে, তাঁর চাকরিইতো আমার করার কথা, নাকি?

আপনি যদি দ্বিগুন বেতনে কোন ভাল মাল্টিন্যাশনালে চাকরির সুযোগ পান, তাহলে কি আপনি বর্তমান চাকরি ছেড়ে সেই সুযোগ নিবেন না? নাকি এই আবেগেই বসে থাকবেন যে ‘এই কোম্পানি আমাকে বেকারত্বের হাত থেকে রক্ষা করেছিল; আমি আজীবন এর গোলাম হয়ে থাকবো।’ যে কোম্পানির জন্য আপনি এত বড় কোরবানি দিতে প্রস্তুত, সেই কোম্পানির ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট একটু উল্টাপাল্টা হলে কর্মী ছাঁটাই শুরু হবে, এবং সেই তালিকায় আপনিও থাকতে পারেন। এটাই বাস্তবতা।

এক বাঙালি বেকুব ইউটিউবার লাইক ও ভিউ কামানোর ধান্দায় এমনই কিছু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারের নাম দিয়ে শিরোনাম করেছিল, ‘এই সমস্ত বেঈমানরা নিজের দেশ বাদ দিয়ে অন্য দেশের হয়ে খেলে।’

অথচ বাস্তবতা হচ্ছে এই ক্রিকেটাররা নিজের দেশে সুযোগ পায়নি বলেই ভিন্নদেশের জার্সি গায়ে চড়িয়েছে। ক্রিকেট তাঁদের পেশা, এবং সময় খুবই সীমিত। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার আশায় কি সমস্ত জীবন অপেক্ষা করে যাবে? সেটা বরং মূর্খামি। বরং নিজের প্রাইম টাইম থাকতে যত বেশি সম্ভব অর্থ উপার্জন করে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ।

জীবনে বহু মঞ্চাভিনেতাকে চিনি যারা প্রতিভা থাকার পরেও টিভি/সিনেমায় চেষ্টা করেননি। বেশ কিছু গায়ককে চিনি যারা মঞ্চ ছাড়া আর কোথাও সুযোগ খুঁজেননি। এটা তাঁদের ভাষায় ‘শিল্পের সেবা।’ এটাই নাকি ‘শিল্পীর আরাধনা।’ তাঁদের সমস্ত জীবন কেটেছে অভাবে, অর্থ কষ্টে। তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁদের পরিবারকে অথৈ সাগরে ভাসতে নিজের চোখে দেখেছি। সাকিবের অর্থলালসাকে আমার খারাপ লাগেনা, কারণ সাবেক ক্রিকেটার সৈয়দ রাসেলের থান কাপড়ের দোকানদারি করার খবর পত্রিকায় আমি পড়েছি। বৃদ্ধ বয়সে সাকিবকে দুস্থ শিল্পীর মতন ভক্তদের কাছে হাত পাততে, প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের আশায় তাকিয়ে থাকতে দেখতে আমি চাইনা।

আবেগ কমান। ক্রিকেটারদের ক্রিকেটার হিসেবে ভাবতে শিখুন, দেবতা বানাবেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link