More

Social Media

Light
Dark

উইলো কাঠের নি:স্বার্থ প্রেমিক

টেস্ট কিংবা ওয়ানডে, যখনই ক্রিকেট নামক খেলাটার শ্রেষ্ঠ একাদশ বাছাই করতে বসেছেন তাবড় ক্রিকেট লিখিয়েদের তখন বারে বারে নানা প্লেয়ারকে নিয়ে দ্বন্দ্ব বেঁধেছে, ব্যক্তিগত পছন্দের কাছে নত হয়েছেন সবাই। কিন্তু ১০০ জন ক্রিকেট বিশ্লেষকের ৯০ জনের নোটবুকেই যদি একটা নাম স্থির, ধ্রুবক থেকে যায় সে নামটা নির্দ্বিধায় কুমার সাঙ্গাকারা।

হার্শা ভোগলে যার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেছিলেন বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাস কুমারকে ছাড়া লেখা যেতে পারে না!

ট্রিনিটি কলেজের নামে কলেজ থাকলেও আদতে মাটালে অঞ্চলের কাছে একটি বাচ্চাদের স্কুল। সেই স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান চলছে। মঞ্চের সামনে বসে আছেন শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এই স্কুলবাড়িতেই যার শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল। মঞ্চে ডেকে নেওয়া হল তাঁকে। সম্মানিত করার প্রাথমিক নিয়ম মেনে উত্তরীয়, ফুল দেবার পর তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হল মাইক্রোফোন।

ads

বাঁ-হাতে মাইকটা নিয়ে হালকা হাসলেন তিনি। একে একে শিক্ষকদের নাম বলতে থাকলেন সে সময়ের, নিজের ক্যারিয়ার স্ট্যাটের চেয়েও বেশি স্পষ্ট নামগুলো, নিজের বাবা মা শিক্ষকদের ধন্যবাদ দেবার পর নাম ধরে ডাক দিলেন স্কুলের অশিক্ষক কর্মচারীদের, সকলে অবাক, নিজের ক্যারিয়ারে যে মানুষটা টাইমিং ভুল করেননি কখনো জীবনের সময়কে মিডব্যাট করতেও যে তিনি সমান দক্ষ!

বক্তৃতার পর শয়ে শয়ে ছাত্রের ভিড় একবার হাত মেলানোর জন্য তাঁদের মহাতারকার সাথে। কুমার নামলেন মঞ্চ থেকে। শিক্ষকদের থেকে আশীর্বাদ নেবার পর সটান চলে গেলেন সেই অশিক্ষক কর্মচারীদের কাছে, যাঁদের সিংহলী সমাজ কয়েক বছর আগেও অস্পৃশ্য বলত সেই মানুষগুলোকে জড়িয়ে ধরলেন শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের পোস্টার বয়। চোখ থেকে তখন জল পড়ছে গোটা অডিটোরিয়ামের, তারপর মিশে গেলেন আগামীর তারকাদের ভিড়ে।

এমসিসির স্পিরিট অব ক্রিকেট কাওড্রে লেকচারে সর্বকনিষ্ঠ লেকচারারের নাম কুমার সাঙ্গাকারা এবং তিনিই একমাত্র যিনি সক্রিয় খেলোয়াড় থাকাকালীন এই বিরল সম্মানের অধিকারী হন, স্পিরিট নামের বানানের মধ্যেই কি কোথাও সাঙ্গাকারা নেই? ক্রিকেটের গডফাদার ডব্লু জি গ্রেস খেলাটার জন্ম দিয়ে যদি মহাভারত লিখন শুরুই করে থাকেন তবে সে মহাকাব্যের যে অধ্যায়ে গিয়ে সমস্ত ভালবাসার রাজপথ একসাথে মিশে যায় তার নাম কুমার সাঙ্গাকারা, আইসিসি যাকে পিপলস চয়েস অ্যাওয়ার্ড দিয়েছে বিনা দ্বিধায়, যার ক্রিকেটীয় রেকর্ডবুকের ধূসর দস্তাবেজে সামনে শুধু ক্রিকেট ঈশ্বর টেন্ডুলকার ছাড়া আর কেউ নেই, যাকে আইসিসি দিয়েছে বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের খেতাব – একবার না একাধিকবার।

সাদা কিংবা লাল বল- ওয়াংখেড়ে-কলম্বো কিংবা মেলবোর্ন- যার সামনে ওয়ার্ন থেকে ওয়াসিম আকরাম-গ্লেন ম্যাকগ্রা-ডেল স্টেইন যেই এসেছেন গোলা বারুদ হাতে তিনিই তো সেই ক্রিকেট মহাভারতের সবচেয়ে আশ্চর্য চরিত্র হয়ে উঠেছেন যিনি প্রতিটা গোলা বারুদের সামনে আগ্রাসন নয়, ভালবাসার কব্জির মোচরে গোলাপের পাপড়ি করে ঠেলে দিয়েছেন কভার আর এক্সট্রা কভারের মাঝখান দিয়ে, সে সিল্ক ড্রাইভের দুপাশে হাততালি একযুগ ধরে হয়েছে ক্রিকেটের আনন্দগান!

কুমার হাসছেন, সমস্ত ক্রিকেট রূপকথার মধ্যে নিজের নাম খোদাই করার পরেও যিনি মহেন্দ্র সিং ধোনির বিশাল ছক্কার পাশে দাঁড়িয়ে ভালবেসে উইকেটগুলো তুলে নিতে জানেন, পন্টিং-এর উচ্ছ্বাসের পাশে যত্ন করে নিজের কিপিং গ্লাভসটা নিয়ে সমস্ত জৌলুস থেকে নিঃশব্দে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটে ডি সিলভা-রানাতুঙ্গা একটা বিশ্বকাপ হয়ত দিতে পেরেছেন কিন্তু ২০০৭-২০১১ অবধি লঙ্কান ক্রিকেটের একটা দুরন্ত সময়ের ব্যাটন বয়েছেন কুমার আর জয়, সেখানে দুটো ফাইনাল হারের হতাশার পরেও কুমার অবলীলায় ক্রিকেটের স্পিরিটকে ছড়িয়েছেন পৃথিবীতে, ২০১৪ তে জিতলেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, যার মূল্য হয়ত কুমারের হাজার ওয়াটের হাসির পাশে সামান্য, তুচ্ছ!

যদিও ১৮ বছর পর লঙ্কা পেয়েছিল তাঁদের আইসিসি ট্রফি।

কুমার জানেন কোথায় চুমু দিলে লালচেরী বলটা মিডব্যাট হয়ে ছুটে যাবে ক্রিকেটের শেষ সীমানায়, যেখানে শেষ হচ্ছে বাইশগজের লড়াই আর তার বাইরে তিনি আম্পায়ারের ডিসিশনের তোয়াক্কা না করে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন ডাম্বুলার মাঠে, তিনি তাঁর শিক্ষকের একটা টেলিফোনে কেটে ফেলছেন তাঁর শখের লম্বাচুল কারণ লঙ্কান তরুনরা তাঁকে আইকন মানে, সে চুল তার মানায় না-এই ছিল তাঁর গুরুর আদেশ, শিরোধার্য করলেন কর্ণ, তিনি হাসতে হাসতে চলে গেলেন বাইশগজ ছেড়ে আর যাবার আগে অস্ট্রেলিয়ার দুর্ভেদ্য মাটিতে বিশ্বকাপে করে গেলেন টানা চারটি সেঞ্চুরি, ক্রিকেটের কর্ণ তাঁর সমস্ত অস্ত্র ঈশ্বরের পায়ে জমা দেবার আগে শেষবার ঝলসে উঠলেন, তারপর থেমে গেল জেন্টলম্যানস গেমের সবচেয়ে বর্ণময় একটা অধ্যায়!

তবুও শতবর্ষ পরে কেউ যখন ক্রিকেটের পাতা উল্টাবে সেখানে মহেন্দ্র সিং ধােনির আসমুদ্রহিমাচল ডানা মেলে দেওয়া বিশাল ছক্কার পাশে ক্লান্ত একটা মুখ দেখে চমকে উঠবে কেউ, তাতে পরপর দুবার ফাইনাল হারের যন্ত্রণা মিলে মিশে এঁকে দিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে ব্যথা লেগে থাকা একটা হাসি, এ হাসি ট্রফির পরােয়া করে না, কলম্বাের স্কোরবাের্ড নেমে যাবে, নিথর স্ট্যাটিস্টিক্সের মাঝখান দিয়ে কব্জির মােচর দেবেন ক্রিকেটের কর্ণ, আবার একটা প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যাবে উইলো কাঠের সবচেয়ে নিঃস্বার্থ প্রেমিকের গল্প।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link