More

Social Media

Light
Dark

ভারতীয় ক্রিকেট আফগান রক্ত, ওরফে প্রিন্স সেলিম

তাঁর খেলার সময়ে একদিনের ক্রিকেটের জন্ম হয়নি। যদি হতো, আমার বিশ্বাস, তাঁর আগ্রাসী ক্রিকেট ভালবাসার আগুন জ্বালিয়ে দিত সেখানেও। এবং বিশ্বকাপ ক্রিকেটের পরিসংখ্যানের ইতিহাসে একটা বড় পরিচ্ছদ তাঁর নামেই লেখা হতো। দেরী না করে আসুন, আমরা ঢুকে পড়ি সিংহদরজা টপকে তাঁর বর্ণময় ক্যারিয়ারের রাজপ্রাসাদে।

সদ্য ৮৬ বসন্ত পেরিয়ে আসা সেই ক্রিকেটারই ভারতীয় ক্রিকেটের একমাত্র নক্ষত্র, যিনি কার্যত বিদেশি হয়েও ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এবং তিনিই প্রথম ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটার, যিনি কোনও চলচ্চিত্রে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তাঁর জন্ম ১৯৩৪ সালের ১১ ডিসেম্বরে আফগানিস্তানের কাবুলে। এর ঠিক ২৬ বছর পরে, ১৯৬০ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ( ক্যাপ নম্বর ৯৫ ) ক্রিকেট অভিষেক হয় এই আফগান ক্রিকেটারের। যিনি পরিচিত ছিলেন ‘প্রিন্স সেলিম’ নামে। তাঁর নাম ছিল সেলিম আজিজ দুরানি।

সেটাই ছিল শুরু। এরপর টানা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় টেস্ট দলের নির্ভরশীল অলরাউন্ডারের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। একটা সময় ভারতীয় ক্রিকেটে তাঁর জনপ্রিয়তা এমন উচ্চতায় পৌঁছায় যে, দল থেকে তাঁকে বাদ দেওয়ায় প্রতিবাদে কার্যত কানপুরের মাঠে বিক্ষোভ দেখান দর্শকরা। ১৯৭৩ সালে কানপুর টেস্ট থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হলে বিক্ষোভ দেখান ক্রিকেটপ্রেমীরা। ‘নো দুরানি, নো টেস্ট’ প্ল্যাকার্ড, স্লোগানে রীতিমতো উত্তাল হয় ভারতীয় ক্রিকেট। ওই বছরই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে শেষ টেস্ট খেলে অবসর নেন তিনি।

ads

বাঁ হাতের ভেলকিতে ব্রিটিশ বধ করেছিলেন দুরানি। তাঁর স্পিন জাদুতে ঘায়েল হয়েছেন ক্লাইভ লয়েড, গ্যারি সোবার্সের মতো কিংবদন্তী ক্রিকেটাররাও। ২৯ টেস্টে ৫০ টি ইনিংস খেলে একটি মাত্রই শতরান রয়েছে তাঁর। সেটিও ক্লাইভ লয়েডের ভয়ঙ্কর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ১২০২ রান এবং ৭৫ উইকেটের মালিক এই আফগান প্রতিভা প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে অর্জুন পুরস্কারে পুরস্কৃত হন।

২০১১ সালে জীবন স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে সিকে নাইডু পুরস্কারে ভূষিত করে বিসিসিআই। ইডেনে ১৯৬২-র ঐতিহাসিক ইংল্যান্ড টেস্টে একাই আট উইকেট নিয়েছিলেন দুরানি৷ টেড ডেক্সটারের বিরুদ্ধে খেলতে নামা ইডেনে সেরা স্মৃতি দুরানির৷ স্কুল ক্রিকেট টিমের হয়ে, সেলিম দুরানি যে দিন মুম্বই থেকে প্রথম ইডেনে পা রেখেছিলেন, সে দিন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৫৷ সালটা ১৯৪৯৷

‘প্রিন্স সেলিম’ নামে পরিচিত এই অলরাউন্ডার ছিলেন প্রথম ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটার, যিনি কোনও চলচ্চিত্রে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ১৯৭০-এর দশকের প্রথম দিকে সেলিম আজিজ দুরানি মুম্বাইয়ের খার এলাকায় থাকতেন এবং সিনেমায় নামার আগে থেকেই দেব আনন্দ, বলরাজ সাহনি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো তৎকালীন বলিউডের বেশ কিছু স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল।

সিনেমার শ্যুটিংয়ে, পারভিন ববি ও দুরানি

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং নায়ক মনোজ কুমার তাঁর প্রতিবেশী ছিলেন। দুরানির এক আত্মীয় তখন কলকাতা পুলিশের উচ্চপদস্থ অফিসার ছিলেন এবং তাঁর সুবাদে দুরানির সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গেও যথেষ্ট পরিচয় ছিল। ওদের সঙ্গে দুরানির নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ হত। কিন্তু তখনও তিনি ফিল্মে নামার কথা ভাবেননি। দেব আনন্দের খুব কাছের লোক ছিলেন পরিচালক বাবুরাম ইশারা, যিনি ইন্ডাস্ট্রিতে বি আর ইশারা নামে পরিচিত ছিলেন। এই ইশারাই একদিন দুরানিকে নায়কের ভূমিকায় অফার দেন।

দুরানির কাছে বলিউডে অভিনয় করার অফারটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল এবং ক্রিকেট ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে সিনেমার পর্দায় আসার ব্যাপারে তিনি প্রথমে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। পরে একদিন দেব আনন্দের বাড়িতে তাঁর ডাক পরে এবং ‘দেব সাহাব’-এর উৎসাহেই দুরানির চলচ্চিত্র জগতে পদার্পণ।

ইশারা পরিচালিত ‘চরিত্র’ ছবিতে এক তরুণ প্লে-বয় শিল্পপতির চরিত্রে পাবলিক ডিমান্ডে ছক্কা মারার জন্যে জনপ্রিয় ‘সিক্সার দুরানির’ অভিষেক। নায়িকা-র ভূমিকায় পরিচালক ইশারা নবাগতা পারভিন ববিকে সুযোগ দেন। গুজরাতের জামনগরের বাসিন্দা দুরানি আগে থেকেই জুনাগড়ের পাঠান পরিবারের ববিকে চিনতেন এবং তাঁর নিজের কথায়, ‘পারভিন আমাকে সেই সময়ে প্রচুর সাহায্য করেছিল আর আমার অনভিজ্ঞতাকে ও ওর অসাধারণ অভিনয় প্রতিভা দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল।’

সেই সময় দুরানি পারিশ্রমিক বাবদ ৮০ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। যদিও বক্স অফিসে তাঁর প্রথম ছবি সাফল্য লাভ করেনি। পরে ‘শর্মিলি’ ছবিতে অফার পেয়েও তিনি তা মিস করেন ইংল্যান্ডে খেলতে চলে যাবার কারণে। রাখির বিপরীতে তাঁর করার কথা রোলটি করেছিলেন শশী কাপুর। এ ছাড়া দুরানি ‘আখরি দিন, প্যাহলি রাত’ নামক আর একটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু মীনা কুমারীর লেখা গল্প অবলম্বনে নির্মীয়মাণ ছবিটি মাত্র কয়েকদিন শ্যুটিংয়ের পরেই বন্ধ হয়ে যায় এবং তার ফলস্বরূপ দুরানির চলচ্চিত্র জীবন মাত্র একটি সিনেমাতেই সীমাবদ্ধ থাকে।

দুরানির গানের গলা ভাল ছিল বলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁকে বেশ কয়েকবার সিনেমায় গান গাওয়ার জন্যে উৎসাহিত করেন। কিন্তু দুরানির ক্রিকেট কেরিয়ার তখন প্রায় শেষের দিকে এবং ভারতীয় দলে সুযোগ পাবার জন্য তিনি যথেষ্ট চাপের মধ্যে ছিলেন। সেই কারণে দুরানি নিজেকে গ্ল্যামার জগত থেকে নিজেকে চিরকালের মতো সরিয়ে নিয়েছিলেন। ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পরেও দুরানির কাছে বেশ কিছু ফিল্ম আর মডেলিং-এর অফার এসেছিল। কিন্তু তিনি আর কখনও গ্ল্যামার জগতের দিকে ফিরে তাকাননি।

আফগানিস্তান টেস্ট খেলিয়ে দেশের সম্মান অর্জন করবে- এই স্বপ্নের প্রথম বুনিয়াদ যিনি করেছিলেন, তিনি হলেন সেলিম আজিজ দুরানি। এই স্বপ্ন সত্যি হয় ২০১৮’র জুন মাসে। সে দিনও মাঠে ঘণ্টা তিনেক ছিলেন চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে। মলিন পোশাক, গালে অন্তত চার দিনের না–কামানো দাড়ি, কলার তোলাই ছিল, যথারীতি।

গ্যালারিতে বসে খেলা দেখেন কিছুক্ষণ। তারই ফাঁকে স্মৃতিচারণে বলেন, ‘যখন ৩ বছর বয়স, তখন আফগানিস্তান থেকে চলে এসেছিলাম। কাবুল দেখা হয়নি এখনও পর্যন্ত।’ এ কথা জানার পর আফগানিস্তান দলের পক্ষ থেকে প্রিন্স সেলিমকে কাবুলে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। যা জেনে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই অতিথি দলের কর্তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

আফগান অধিনায়কের হাতে স্মারক তুলে দেওয়ার সময় তিনি তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কী যেন বললেন। পরে জানালেন, ‘শুধু বেস্ট অফ লাক বলেছি। এটা তো সব ম্যাচে বিপক্ষকে বলে এসেছি। এর বেশি কিছু নয়। কেন বলব? আমি তো আর চাইব না, আমার দেশ ভারতবর্ষ হেরে যাক।’

ভারতের সেরা না হলেও স্মরণীয় অলরাউন্ডারদের অন্যতম সেলিম আজিজ দুরানি মাঠে এলেই দর্শকরা দাবি করতেন ছক্কা মারার। এ সব স্মৃতি কখনও পুরনো হবে না দুরানিকে ঘিরে। আজ দ্বাদশ বিশ্বকাপ শুরুর মুখে কেন যেন বারবার মনে হয় যে ওয়ান-ডে যুগে সুযোগ পেলে বিশ্বকাপে ভারতকে উপভোগ্য ক্রিকেট উপহার দেওয়া ক্রিকেটারদের সামনের সারিতে থাকা এক ক্রিকেটারেরই নাম হত ‘প্রিন্স সেলিম’ ওরফে ‘সেলিম আজিজ দুরানি’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link