More

Social Media

Light
Dark

যে উৎসবে কাঁপলো বাংলাদেশের ফুটবল

গত এক দশকে পুরুষ ফুটবল দল যতটা পিছিয়েছে, তার দ্বিগুণ গতিতে সামনে এগিয়েছে নারী ফুটবল। তারই ধারাবাহিকতায় সাফ চ্যাম্পিয়নশীপে ভারতের একক আধিপত্য ভেঙে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। ছেলেরা যেখানে গ্রুপপর্বই পেরোতে পারছে না, মেয়েরা সেখানে প্রতিপক্ষকে গোলবন্যায় ভাসিয়ে দেশের জন্য বয়ে এনেছে সম্মান। দেশের মানুষও দারুণ উল্লসিত তাদের এ সাফল্যে, দেশে ফেরা মাত্র খোলা বাসে শহর প্রদক্ষিণে তাদের অভিবাদন জানিয়েছে হাজারো মানুষ।

ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষকে আজ একাত্না করেছেন মেয়েরা। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার বর্গকিলোমিটারের বাংলাদেশ আজ খুশি। মেয়েরা দেশের মাটিতে পা রাখা মাত্রই পুরো বিমানবন্দর বাংলাদেশ, বাংলাদেশ স্লোগানে ফেটে পড়ে। এক দশক আগে যারা মেয়েদের ফুটবলে বিরোধীতা করেছিলেন, তারাও আজ উল্লাসের সামিল হয়েছেন।

মেয়েদের এই সাফল্যে প্রশংসার দাবিদার বাফুফে কিংবা ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ও, একদিনের নোটিশে তারা ঠিকই মেয়েদের এনে দিতে দিতে পেরেছে ছাদখোলা বাস। দুপুরের জীর্ণ ঢাকা আজ যেন ফিরে পেয়েছিল প্রাণ, যেন ফিরে গিয়েছিল উৎসবমুখর মাদ্রিদ, মিলান কিংবা বার্সেলোনায়। আমাদের মেয়েরাও মেসি, রোনালদোদের চেয়ে কম কিসে!

ads

বাংলার এই মেয়েদের সাফল্য তো আদতে জনমানুষের সাফল্যই। দেশের আনাচে-কানাচে থেকে এই মেয়েদের তুলে এনেছেন কিছু ফুটবলপ্রেমী মানুষরাই। ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রামের মফিজ স্যার, ঠাকুরগাঁও এর তাজুল স্যার, সাতক্ষীরার আকবর স্যারসহ দেশের ক্রীড়াপ্রেমী শিক্ষকরা জহুরির চোখ দিয়ে খুঁজে বের করেছেন দেশসেরা সব প্রতিভা।

কোনো বাঁধাকেই বাঁধা মনে করতে দেননি মেয়েদের, একজন রাজিব ভাই দূর করেছিলেন ইন্টারনেটের বাঁধা। কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন তো একজন অতিমানব, নিজের মেয়েদের মতো করে আপন হাতে আগলে রেখেছেন মেয়েদের। তার বাড়ির দরজা মেয়েদের জন্য ছিল সবসময়ই খোলা, মেয়েরা যেন ছিল তার পরিবারেরই অংশ। মেয়েদের এই সাফল্য তো তাই বাংলার গণমানুষেরই।

বাফুফেও অবশ্য মেয়েদের এই সাফল্যে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে। ক্লাবগুলোর উদাসীনতায় মেয়েদের দল যখন প্রায় ভেঙে গিয়েছিল, ঠিক তখন আবির্ভাব বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন এবং মহিলা উইংয়ের প্রধান মাহফুজা আক্তার কিরণ। মেয়েদের ফুটবলে কোনো স্পন্সর না থাকা সত্ত্বেও ক্যাম্পে কখনো বাঁধা পড়েনি। সেই অনুর্ধ্ব-১৬ দল থেকে জাতীয় দল, পুরোটা সময় মেয়েদের ‘গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল’ রূপে ছিলেন কাজী সালাউদ্দিন।

ব্যর্থতায় সাহস জুগিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন ভবিষ্যতের জন্য। ক্রীড়াপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ধন্যবাদ পাবেন মেয়েদের সাফল্যে, প্রতিবার শিরোপা জেতার পর মেয়েদের গণভবনে ডেকে তিনি পুরষ্কৃত করেছেন। নজর রেখেছেন মেয়েরা যাতে হারিয়ে না যায়। যেকোনো সমস্যায় এই মেয়েদের দিকে বাড়িয়েছেন সাহায্যের হাত। কলসিন্দুর গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছানো কিংবা আঁখি খাতুনের বাড়ির জন্য জমি প্রদান, সবকিছুই তিনি করেছেন মেয়েদের জন্যে। 

মেয়েরা আমাদের স্বপ্ন দেখার পরিধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সাফ পেরিয়ে আমাদের লক্ষ্যটা এখন ধাপে ধাপে এশিয়া ছাড়িয়ে বিশ্বমঞ্চে আলো ছড়ানোর। এজন্য দরকার আরো বেশি অনুশীলনের, সুযোগ-সুবিধা, নিয়মিত ম্যাচ খেলা, স্পন্সরদের এগিয়ে আসা। গ্রুপপর্বে ভারতকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে বাংলার মেয়েরা। ভারত যেখানে নিয়মিত লিগ আয়োজনের পাশাপাশি বছরে দুই-তিনটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করে।

সেখানে বাংলাদেশে এখনো মেয়েদের নিয়মিত লিগ আয়োজন হয় না, অংশগ্রহণকারী দলগুলো দায়সারাভাবে অংশ নেয়। ক্লাবগুলোর স্থায়ী মাঠ নেই, মেয়েদের রাখা হয় নিম্নমানের হোটেলে। এই জায়গাটায় আলাদা করে ধন্যবাদ পাবে বসুন্ধরা কিংস। তারা মেয়েদের আর্থিক স্বচ্ছলতা এনে দিয়েছে, দিয়েছে বিশ্বমানের মাঠ, ট্রেনিং, সুযোগ-সুবিধা। বাংলার মেয়েদের সাফল্যের যাত্রাটা যেন সাফেই সীমাবদ্ধ না থাকে সেদিকেই সবার নজরটা থাকা উচিত।

তবে সাবিনা, কৃষ্ণা, সানজিদাদের মূল কৃতিত্বটা কেবল শিরোপা জেতাতে সীমাবদ্ধ নয়। শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে তাদের এ জয়টা যে অনুপ্রেরণা জোগাবে দেশের হাজারো মেয়েদের। মেসি, রোনালদো ছাপিয়ে বাচ্চারা সাবিনা-কৃষ্ণা হতে চাইবে সে দিনটা বোধহয় খুব বেশি দূরে নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link