More

Social Media

Light
Dark

স্টাইলিশ ক্রিকেটার, অধিনায়ক কিংবা ধর্মীয় নেতা

কেনসিংটন ওভালে সেবার স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তান। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে স্যার এভারটন উইকসের ১৯৭ আর কনরাড হান্টের সেঞ্চুরিতে ৫৭৯ রানের বিশাল সংগ্রহ পায় স্বাগতিকরা। জবাব দিতে নেমে ক্যারিবীয় পেসারদের তোপে পড়ে মাত্র ১০৬ রানে গুটিয়ে যায় পাকিস্তান। সবাই ভেবেছিল পাকিস্তানের ইনিংস ব্যবধানে হার কেবল সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

কিন্তু, হানিফ মোহাম্মদের ৩৩৭ রানের সুবাদে ম্যাচ বাঁচিয়ে ফেলে সফরকারীরা। সবাই ম্যাচটিকে মনে রেখেছে হানিফ মোহাম্মদের ম্যাচ হিসেবেই। ভুল যায় চার নম্বরে নামা অভিষিক্ত এক তরুণের লড়াকু ৬৫ রানের কথা। রয় গিলক্রিস্ট, এরিক অ্যাটকিন্স, আল্ফ ভ্যালেন্টাইনের সামনে বুক চিতিয়ে লড়াই করার কথা। তিনি সাইদ আহমেদ, যার ক্যারিয়ারে পালাবদল এসেছে বারবারই।

সাইদ আহমেদের জন্ম ব্রিটিশ ভারতের জলন্দরে। দেশভাগের পর জলন্দর ভারতের অংশে পড়লেও সাইদের পরিবার চলে আসে পাকিস্তানে। নতুন নিবাস গড়ে কাঁটাতারের ওপারে। পরবর্তীতে পাকিস্তানের হয়েই শুরু করেন নিজের ক্রিকেট জীবন। ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষেকের চার বছর বাদে ডাক পান জাতীয় দলে।

ads

ওয়েস্ট ইন্ডিজে নিজের প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৩ রান করলেও চাপের মুখে দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৫ রান করে জানান দিয়েছিলেন নিজের প্রতিভার।  হানিফ মোহাম্মদের সাথে ১৫৪ রানের জুটি গড়ে দলকে বাঁচিয়েছিলেন লজ্জাজনক এক হারের পরিণতি থেকে। অভিষেক ম্যাচের ফর্মটা সাইদ ধরে রাখেন পরের ম্যাচগুলোতেও। টানা পাঁচ ম্যাচে খেলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের ইনিংস।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেই সফরের পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম তিন অংকের দেখা। চতুর্থ টেস্টে জর্জটাউনে খেলেন ১৫০ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। ফর্মটা ধরে রাখেন পরের ম্যাচেও, পোর্ট অব স্পেনে এবার থামেন সেঞ্চুরি থেকে মাত্র তিন রান দূরে। সবমিলিয়ে নিজের অভিষেক সিরিজে পাঁচ ম্যাচে ৫৬ গড়ে ৫০৮ রান করে বিশ্ববাসীকে আগমণী প্রতিভার জানান দেন সাইদ। 

ক্যারিয়ারের প্রথম চার বছর ব্যাট হাতে দারুণ পারফর্ম করেন তিনি। ক্যারিয়ারের পাঁচ সেঞ্চুরির চারটিই এই সময়ে করা। এরপরই ধীরে ধীরে ফর্ম হারাতে শুরু করে। তাঁর শেষ টেস্ট সেঞ্চুরিটি এসেছিল চতুর্থ সেঞ্চুরির চার বছর পর। তবে তাঁর আগেই অনন্য এক রেকর্ড গড়েন তিনি। তাঁর চেয়ে দ্রুততম সময়ে পাকিস্তানের হয়ে দুই হাজার রান করতে পারেননি কোনো ব্যাটসম্যান।

মাত্র ২০ ইনিংসে দুই হাজার রানের কোটা স্পর্শ করেন তিনি। তাঁর সেই রেকর্ড আজও ভাঙতে পারেননি কোনো পাকিস্তানি ব্যাটার। ছবির মত সুন্দর সব ড্রাইভ শট খেলতেন সাইদ। তাঁর শটে এতোটাই জোর ছিল, ফিল্ডার নড়েচড়ে ওঠার আগেই বল পৌঁছে যেত সীমানা ছাড়িয়ে।

ব্যাটসম্যান হিসেবে রান করার পাশাপাশি সাইদ আহমেদের আরেকটা স্বপ্ন ছিল। অধিনায়ক হিসেবে পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দেয়া। সব সময় নিজেকে পাকিস্তানের অধিনায়ক হিসেবে দেখতে চাইতেন। সেই সুযোগটাও এসে যায় ১৯৬৮ সালে ইংল্যান্ড সফরে। হানিফ মোহাম্মদ সরে দাঁড়ালে তাঁর জায়গায় অধিনায়ক নির্বাচিত হন সাইদ।

তাঁর অধীনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই সিরিজে ০-০ সমতায় শেষ করে পাকিস্তান। কিন্তু সাইদ তাঁর রক্ষণাত্মক মানসিকতার জন্য দারুণভাবে সমালোচিত হন। ফলশ্রুতিতে মাত্র এক সিরিজেই সমাপ্তি ঘটে তাঁর অধিনায়কত্ব ক্যারিয়ারের। তাঁর বদলে নতুন অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয় ইন্তিখাব আলমকে। 

ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত মারাত্নকভাবে আঘাত করেছিল সাইদকে। এই ঘটনায় মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়েন তিনি। পরের সিরিজের দল  থেকে সরিয়ে নেন নিজেকে এবং ইংল্যান্ড চলে যান। বিলেতে গিয়ে জীবনের নতুন এক অধ্যায় উন্মোচন করেন তিনি। মজে যান মদ এবং পার্টিতে। রাতের পর রাত পার্টি করে বেড়াতেন। ১৯৭১ সালে যদিও পুনরায় দলে ফিরে আসেন।

তিন টেস্ট খেলে প্রায় ৪০ গড়ে রানও করছিলেন। কিন্তু এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় শেষ হয়ে যায় তাঁর জাতীয় দলের ক্যারিয়ার। সেবার পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের আগে সবুজ উইকেট বানায় স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া। এতটাই সবুজ ছিল যে পিচ আর আউটফিল্ড আলাদা করা যাচ্ছিল না। ম্যাচের দুই ঘন্টা আগে সাইদ এসে জানান তিনি পিঠের ব্যথার কারণে ম্যাচ খেলতে পারবেন না।

অথচ, সেই ম্যাচে দলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন তিনি। বাধ্য হয়ে তাঁকে বাদ দিয়েই শেষপর্যন্ত দল সাজাতে হয় ম্যানেজমেন্টকে। ঝামেলা বাঁধে ম্যাচশেষে সন্ধ্যায়, যখন সাইদকে স্টেডিয়ামের বাইরে এক বারে পার্টি করতে দেখা যায়।

ধারণা করা হয় বোলিংবান্ধব পিচ আর অধিনায়ক ইন্তিখাব আলমকে বিপদে ফেলতেই সেই ম্যাচে মিথ্যে ইনজুরির ভান করেন সাইদ। পরদিনই তাঁকে দল থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হয় এবং আর কখনোই পাকিস্তানের হয়ে ডাক পাননি তিনি। ফলশ্রুতিতে ৪১ টেস্টেই থেমে যায় তাঁর ক্যারিয়ার।

এরপরই একপ্রকার লোকচক্ষুর আড়ালেই চলে গিয়েছিলেন সাইদ। প্রায় ২৫ বছর পর সাইদকে শারজাহ স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের এক টুর্নামেন্টে গ্যালারিতে দেখা যায়। কিন্তু এ কোন সাইদ! ইংল্যান্ডের নাইটক্লাবের এক সময়ের নিয়মিত মুখ সাইদ ততদিনে বদলে গিয়েছেন। মুখভর্তি দাঁড়ি, মাথায় টুপি পরিহিত মধ্যবয়সী সাইদকে দেখে চেনার কোনো উপায় নেই। পরবর্তীতে জানা যায়, জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পর পাকিস্তানে তাবলীগ জামাতের সাথে যুক্ত হন তিনি।

পরে পাকিস্তানের দলের ক্রিকেটারদের ধর্মীয় বিশ্বাসের মাঝেও তাঁর প্রভাব লক্ষ করা যায়। নব্বইয়ের দশকের তিন জনপ্রিয় ক্রিকেটার সাইদ আনোয়ার, সাকলাইন মুশতাক, মুশতাক আহমেদ হঠাৎ করেই ধর্মীয় দিকে ঝুঁকে পড়েন। ধারণা করা হয় মূলত সাইদ আহমেদই মূল প্রভাবক ছিলেন তাঁদের ধার্মিক হয়ে ওঠার পেছনে। 

বর্ণাঢ্য এক ক্যারিয়ার কাটিয়েছেন। ব্যাট হাতে রানের ফল্গুধারা বইয়ে দিয়েছেন, আবার কখনও ম্যাচের পর ম্যাচ রান করতে পারেননি। শুরুর দিকে ধর্মবিমুখ থাকলেও পরবর্তীতে তিনিই ধর্মের পথে এনেছেন মানুষকে। স্টাইলিশ ক্রিকেটার, অধিনায়ক, ধর্মীয় নেতা – সাইদ আহমেদের জীবনকে আপনি তাই বিশেষায়িত করতে পারেন নানা উপমা দিয়েই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link