More

Social Media

Light
Dark

রান লুইস! রান!

লাতিন আমেরিকান ফুটবল ঘরানার আঁতুড়ঘরে ফুটবলের ঘ্রাণ ফিকে হয়ে এসেছে। উত্তর-পশ্চিম উরুগুয়ের `সাল্টো’ শহরের দেয়াল থেকে ফুটবলের রঙিন নকশা সরিয়ে সেঁটে দেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিক পোস্টার। সকাল থেকে বাসি পাউরুটি আর ভুট্টা সেদ্ধ ছাড়া কিছু জোটেনি ছেলেটার।

নির্বাচনের মুখে স্ট্রিট স্যুইপারদের কাজের চাপ অনেক, হাতে ঝাঁটা নিয়ে চলছে রাস্তা পরিস্কারের কাজ, বিকেল নামতে দেরী আছে। দূরে কোয়ার্টার্সের মাঠে ফুটবল খেলছে কয়েকজন। চোদ্দ বছরের ছেলেটা অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সেদিকে। ওর খেলার সময় নেই।

শিশু শ্রমিক হিসেবে দৈনিক বরাদ্দ কয়েকটা উরুগুয়ান পেসো (উরুগুয়ের মুদ্রা)। রাতে সাত ভাইবোনের পাত পড়বে, মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে কয়েক বছর হল। অসুস্থ মা-এর সম্বল বলতে তিন ভাই-এর স্ট্রিট স্যুইপিং-এর রোজগার, রোদ-ঝড়-জলে ছোট্ট আশ্রয়ের অসহায়তা যেন অনেকটা বড় করে দিয়েছে ছেলেটাকে।

ads

বেলা এগারোটার সূর্যের রোদ এসে পড়েছে ওর মুখে। উঁচু দাঁত, গায়ে ঢোলা ময়লা শার্ট আর হাফপ্যান্ট। সামনের কমপ্লেক্সের ফুটবল ম্যাচটাতেই পড়ে আছে মন; কেউ গোল মিস করলেই হাতের ঝাঁটাটা মাটিতে আছড়ে দিচ্ছে হতাশায়। হঠাৎ সবকিছু যেন কেমন বদলে গেল নিমেষে; চড়া সূর্যের রোদ আড়াল করে দাঁড়াল একটা মেয়ে।

ছেলেটা বুঝেছে ওর লড়াই মিথ্যে হয়নি। নিজের প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল একটা গোলাপফুল, গতকালের বাঁচানো একটা পেসো দিয়ে ওর জন্যই কিনে রেখেছে সে। মেয়েটির সাদা গাউনের সামনে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ছেলেটাকে নিজের দু’হাতে শক্ত করে ধরল মেয়েটা।

হাতের ঝাঁটাটা মাটিতে ফেলে হাতে তুলে দিল একটা বাক্স। ছেলেটা বাক্সটা খুলতে চমকে উঠল! একজোড়া ব্যুট, ঠিক যে বুটজোড়া ও প্রতিদিন দেখে, রাস্তা ঝাড় দিতে দিতে পাশের কাচের শোরুমের ঐ বুটজোড়ার দিকেই তো তাকিয়ে থাকত ও!

মেয়েটা জড়িয়ে ধরল ছেলেটাকে, দুজনেই কাঁদছে, মেয়েটা ইশারায় জুতোজোড়া পরতে বলল ছেলেটাকে, ছেলেটা জুতোজোড়া পরে নিতেই মেয়েটি জোড়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ইউ ক্যান উইন দ্য গেম লুইস! রান!’

ছেলেটা দৌড় শুরু করল, নিজের স্বপ্নের রাস্তা ধরে শুরু হল অবিরাম দৌড়। লাতিন আমেরিকার গণ্ডী টপকে, আধপেটা খাওয়া জীবনের বেড়া টপকে, জীবনের সমস্ত কঠিন ডিফেন্ডারদের কোমরের মোচড়ে শুইয়ে দিয়ে দৌড়ে চলল ছেলেটা। লাতিন আমেরিকা থেকে ইউরোপ হয়ে এক নিরলস দৌড়, হিংস্র দাঁত দুটোকে সামনে রেখে সমস্ত ভাগ্যের কাছে হেরে যাওয়া মানুষের প্রতিনিধি হয়ে লড়তে থাকল ও।

সবুজ অ্যানফিল্ডের মাঠে প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে আবার দৌড়। ক্যাম্প ন্যু-তে সোর্জিও র‍্যামোসের কড়া ট্যাকলের সামনে বুকচিতিয়ে এগিয়ে বলটা রিয়াল মাদ্রিদের জালে জড়িয়ে দিতেই মাঠে দু’হাত তুলে শুয়ে পড়ল উরুগুয়ান স্টার লুইস সুয়ারেজ!

গ্যালারি থেকে কাঁদছে সোফিয়া, ১৫ বছর আগে সাল্টোর রাস্তায় সাদা গাউন পরা মেয়েটার মতো কাঁদছে, হিংস্র উরুগুয়ান স্ট্রাইকার যেন হেরে যাচ্ছে এই নিস্পাপ কান্নার সামনে, জিতে যাচ্ছে সেদিনের একটা বিশ্বাস, ‘ইউ ক্যান উইন দ্য গেম লুইস! রান!’

রাস্তায় অসহায় দাঁড়িয়ে থাকা লুইসের সব হারানোর যন্ত্রণার সাথী সোফিয়া, এমনই সমস্ত কষ্ট চেপে রাখা বুকের হাজার হাজার সুয়ারেজদের জন্য কোনো অচেনা পৃথিবীতে অপেক্ষা করে সোফিয়ারা। সব হারানোর পরেও যাদের বলার ছিল কিছু, একটি মানুষ ধার্য করো তাদের মাথাপিছু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link