More

Social Media

Light
Dark

দুর্গম পথের সতর্ক পথিক

ক্রমেই এগিয়ে আসছে কাতারে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ফুটবল বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ সবসময়ই বিশ্বের সেরা সেরা দেশগুলো আর সেসব দলের সেরা সেরা খেলোয়াড়দের এক মিলনমেলা। কিন্তু কেমন হবে যদি এমন এক ফুটবলযজ্ঞে দেখা না মিলে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে? ক্যারিয়ারের অপরাহ্নে পৌঁছে যাওয়া এই গ্রেট ফুটবলারের এটাই হয়তো হতে যাচ্ছে জাঁকজমকপূর্ণ এক ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ। কিন্তু ভাগ্যের অসহযোগিতায় তার বিশ্বকাপ যাত্রাই এখন অনিশ্চিত।

প্রায় এক বছর আগের ঘটনা। সেদিন ছিল ২৮ মার্চ। পর্তুগাল বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারের ম্যাচ খেলতে মাঠে নেমেছিল সার্বিয়া’র বিপক্ষে; সার্বিয়ার তুলনায় ধারেভারে এগিয়ে থাকা পর্তুগাল দুই গোলের লিডও নিয়েছিল প্রথমার্ধেই। লিভারপুল উইঙ্গার দিয়েগো জোতা’র ১১ এবং ৩৬ মিনিটের গোলে এগিয়ে থেকেই প্রথমার্ধের বিরতিতে গিয়েছিল পর্তুগাল। তবে বিরতি থেকে ফিরে আসার পরেই দেখা পাওয়া গেল অন্য সার্বিয়াকে। ৪৬ এবং ৬০ মিনিটের মাথায় দুই গোল করে দলকে সমতায় নিয়ে আসেন আলেক্সান্দার মিত্রোভিচ এবং ফিলিপ কস্টিচ।

শেষ পর্যন্ত তিন পয়েন্টের আশায় লড়তে থাকা পর্তুগাল ম্যাচের একেবারে অন্তিম মূহুর্তে পেয়েছিল গোল করার এক সুবর্ন সুযোগ। লেফট উইং থেকে সতীর্থের লম্বা এক ক্রস পেয়েছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। গোলপোস্ট ছেড়ে সামনে অনেকটাই বেরিয়ে আসা গোলরক্ষক মার্কো দিমিত্রোভিচকে এড়িয়ে জালের দিকে বলটিকে আলতো করে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এক সার্বিয়ান ডিফেন্ডার বলটি গোললাইন থেকে ক্লিয়ার করলেও পর্তুগালের সবাই ধরে নিয়েছিল বলটি ইতোমধ্যে গোললাইন অতিক্রম করেছে। কিন্তু লাইন্সম্যান তখন গোলের সিদ্ধান্ত না দেয়ায় সে ম্যাচে জয় বঞ্চিত হয় পর্তুগাল।

ads

একটু পরে টিভি রিপ্লেতে অবশ্য পরিষ্কারই বোঝা গিয়েছিল বলটি গোললাইন অতিক্রম করে আরও কয়েক সেন্টিমিটার পার হয়ে গিয়েছিল। ভার (ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি) বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ার ম্যাচে না থাকায় সেদিন রোনালদো’র করা গোলটি বাতিল হয়ে যায়। ভার এর অনুপস্থিতিতে যে দায়িত্বশীল আচরন করা উচিত ছিল রেফারির, সেটা করেননি তিনি। বরং গোলের জন্য আবেদন করায় পর্তুগিজ ক্যাপ্টেন রোনালদোকে হলুদ কার্ড দিয়ে যেন পর্তুগাল সমর্থকদের সঙ্গে প্রহসন করেছিলেন।

রাগে, ক্ষোভে মাঠের মধ্যেই সেসময় আর্মব্যান্ড ছুড়ে ফেলেছিলেন রোনালদো। তাঁর এমন প্রতিক্রিয়ার গুরুত্ব বোঝা গিয়েছিল বেশ কয়েকমাস পরে যখন একটি মাত্র জয়ের জন্য পর্তুগাল বিশ্বকাপে সরাসরি কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ হয়। সার্বিয়ার বিপক্ষে সে ম্যাচ জিততে পারলে হয়তো এতদিনে বিশ্বকাপ যাত্রার ব্যাগ গুছিয়ে রাখতে পারতো পর্তুগাল দল

অতীত সবসময়ই অতীত। যা ঘটে গিয়েছে তা নিয়ে ভেবে আর বদলানো যায় না কিছুই। পর্তুগালের বিশ্বকাপ খেলার সম্ভাবনা এখনো একেবারে শেষ হয়ে যায় নি অবশ্য। প্লে-অফের কঠিন পথ ডিঙ্গিয়ে এখন কাতার বিশ্বকাপের টিকিট কাটতে হবে ফিফা র‍্যাংকিংয়ে আট নম্বরে থাকা দলটিকে।

কাতার বিশ্বকাপের প্লে-অফ রাউন্ড হবে নক আউট পর্বের মত। প্লে-অফে জায়গা পাওয়া বারোটি দলকে ভাগ করা হয়েছে তিনটি গ্রুপে। দলগুলো হল পোলান্ড, ওয়ালশ, রাশিয়া, স্কটল্যান্ড, ইউক্রেন, চেক রিপাবলিক, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, তুর্কি, ইতালি, নর্থ মেসিডোনিয়া এবং পর্তুগাল। প্রত্যেক গ্রুপের চারটি দল সেমিফাইনাল এবং ফাইনালের ধরনে দুইটি করে ম্যাচ খেলবে। ফাইনালের জয়ী দল সুযোগ পাবে কাতারের বিমান ধরার। অর্থাৎ তিন গ্রপের তিন চ্যাম্পিয়ন দল সুযোগ পাবে বিশ্বকাপ খেলার।

ভাগ্যের জেরে ফেঁসে যাওয়া পর্তুগালের ভাগ্য প্লে-অফ লটারি’তেও সুপ্রসন্ন হয়নি। ইতালি’র মত শক্তিশালী ভারসাম্যপূর্ন একটি দল যেমন রয়েছে পর্তুগালের গ্রুপে তেমনি তুর্কি’র মত আন্ডারডগ দলও রয়েছে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল নর্থ মেসিডোনিয়া সেমিফাইনাল রাউন্ডে মুখোমুখি হবে ইতালি’র অন্যদিকে পর্তুগালের প্রথম চ্যালেঞ্জ তুর্কি বাধা টপকানো।

তুরস্কের বিরুদ্ধে ২৫ মার্চ বাংলাদেশ সময় রাত পৌনে দুইটায় মিনিটে প্লে-অফ মিশন শুরু করবে পর্তুগাল। যদি তুর্কি প্রতিরোধ ভেঙে এগিয়ে যেতে পারে পর্তুগাল তবে সামনে পাবে নর্থ মেসিডোনিয়া বনাম ইতালি ম্যাচের জয়ী দলকে। কাগজে-কলমে পরিষ্কার ফেভারিট ইতালি’কেই হয়তো ৩০ মার্চ মিশনের শেষ ধাপে প্রতিপক্ষ হিসেবে পাবে পর্তুগাল। সেদিন যে দল জিতবে সে দল খেলতে পারবে স্বপ্নের বিশ্বকাপে। তবে অঘোষিত এই ফাইনাল খেলার জন্য পর্তুগালকে আগে জিততে হবে তুর্কিদের বিপক্ষে।

দুর্ভাগ্য ফুটবল ভক্তদের, টুর্নামেন্টের বাইলজ অনুযায়ী যেকোনো একটি দল সুযোগ পাবে বিশ্বকাপে। তাই কাতারে হয়তো ইতালির খেলা দেখা যাবে নয়তো রোনালদো তার শেষ ঝলক দেখানোর সুযোগ পাবেন। পর্তুগাল, ইতালি দুইদলের মাঝে একজনকে অবশ্যই বিদায় নিতে হবে। অথবা নব্বই মিনিটের এই খেলায় অঘটনের শিকার হয়ে হেরে গিয়ে বাদ যেতে পারে দুই দলই।

বিশ্বকাপ প্লে-অফ কে সামনে রেখে ইতোমধ্যে ২৫ সদস্যের দল ঘোষনা করেছেন পর্তুগালের কোচ সান্তোস। ইনজুরিতে থাকা রুবেন দিয়াসকে রাখা হয়নি দলে, ডিফেন্সে এমন একজন সেনানীকে অবশ্যই মিস করবে পর্তুগাল। তবে অভিজ্ঞ পেপের উপর ভরসা করতেই পারে পর্তুগাল। মিডফিল্ডে জোয়াও মৌতিনহো, ডানিলো, ব্রুনো ফার্নান্দেজ,বার্নান্দো সিলভা এর মত পরিচিত মুখ রয়েছে। আক্রমনের দায়িত্বে আছে জোয়াও ফেলিক্স, আন্দ্রে সিলভা, দিয়েগো জোতা, রোনালদোরা। পুরো দলের পাশাপাশি আক্রমণভাগেরও নেতৃত্বে থাকবেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এর অভিষেকের আগে অর্থাৎ ১৯৩৪ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত মাত্র তিনবার বিশ্বকাপ খেলতে সক্ষম হয়েছিল পর্তুগাল।অথচ ২০০৩ সালে ক্রিশ্চিয়ানো’র অভিষেকের পর থেকে খেলেছে টানা চার বিশ্বকাপ। অর্থাৎ রোনালদো দলে থাকা অবস্থায় কখনোই বিশ্ব আসর মিস করেনি পর্তুগাল দল।

২০১৪ সালের কথা মনে পড়ে? সেবারের বিশ্বকাপেও প্রায় একই পরিস্থতিতে ছিল পর্তুগাল। প্লে-অফ ম্যাচ খেলতে হয়েছিল স্বঘোষিত সুপারস্টার ইব্রাহিমোভিচের সুইডেনের বিপক্ষে। সে ম্যাচে ইব্রাহিমোভিচের এর জোড়া গোলের বিপরীতে গোলের হ্যাটট্রিক করে পর্তুগালকে একাই ব্রাজিল বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ করে দিয়েছিল রোনালদো।

এখন অবশ্য সময় বদলেছে, সেদিনের তরুণ রোনালদো আর নেই। তবু তিনি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, যিনি প্রচণ্ড ইচ্ছেশক্তির জোরেই ইতিহাসের সেরাদের তালিকায় নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন। তিনি কতবারই তো অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন, ক্যারিয়ার জুড়ে বারবার দলকে বাঁচিয়েছেন অতিমানবীয় পারফরম করে। এখন আরো একবার বিপদে তার দল। এবারও কি ত্রাণকর্তা হয়ে আবির্ভূত হবেন রোনালদো? ২০২২ এসে কি ২০১৪ এর পুনরাবৃত্তি করতে পারবেন পর্তুগিজ যুবরাজ? নাকি ইতালি কিংবা তুর্কির বিপক্ষে থেমে যাবে পর্তুগালের বিশ্বকাপ যাত্রা পথ। উত্তর তোলা থাকুক সময়ের জন্য, আর মাত্র তো কয়েকটা দিন বাকি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link