More

Social Media

Light
Dark

ম্যারাডোনার সাথে এক ছবিতেই যিনি একটি ইতিহাস

১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ের পর কাঁধে চেপে বিশ্বকাপ হাতে ম্যারাডোনার সেই আইকনিক মুহূর্তটা মনে আছে নিশ্চয়? সেবারের বিশ্বকাপ দেখেননি, কিন্তু এমন ঐতিহাসিক স্থিরচিত্র গেঁথে আছে কোটি মানুষের মনে। 

কিন্তু জিজ্ঞাসু মনে এমন প্রশ্নও উদয় হয় যে, ম্যারাডোনা যার কাঁধে চেপে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের ফ্রেমে আটকে ছিলেন সেই তিনিটা কে? খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, যিনি ম্যারাডোনাকে কাঁধে নিয়েছিলেন তিনি কোনো পেশাদার ফুটবলার ছিলেন না। একজন ফুটবল ভক্ত ছিলেন বলা চলে। ভদ্রলোকের নাম রবার্তো সিজাস। 

সেবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা যখন ফাইনালে উঠলো তখন সিজাস আর্জেন্টিনায় ছিলেন। কর্মস্থলে হঠাতই একদিন কলিগদের চমকে দিয়ে বলে উঠলেন, আমি মেক্সিকো যাব। আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতলে ম্যারাডোনাকে কাঁধে তুলে স্টেডিয়ামে এ পাশ,  ও পাশ ঘুরে বেড়াব। কলিগরা নিছকই সেটা মজা হিসেবে নিয়ে অট্টহাসিতে মেতে উঠলো। 

ads

কিন্তু সিজাসকে যেন সেই ভাবনাটা প্রবলভাবে ঘিরে ধরলো। মনস্থির করে ফেললেন তিনি ফাইনাল দেখতে মেক্সিকো যাবেন৷ কিন্তু সমস্যা বাঁধলো, এখন টিকিট পাবেন কোথায়। শেষ মুহূর্তে ফাইনালের টিকিট পাওয়া তো রীতিমত অসম্ভব। কিন্তু সিজাস একটা টিকিটের বন্দোবস্ত ঠিকই করে ফেললেন। মেক্সিকোয় থাকা এক মহিলা তাকে একটা টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন। তারপরও রয়েছে অনিশ্চয়তা। কারণ তখনো সিজাস হাতে টিকিট পাননি। তারপরও অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করেই মেক্সিকোতে পাড়ি জমালেন সিজাস।  

কিন্তু মেক্সিকো গিয়েই জানতে পারলেন, সেই মহিলা তাঁর টিকিট আরেকজনের কাছে বেশি দামে বিক্রি করে দিয়েছেন, সিজাস যেখানে সে টিকিটের জন্য ৮০ ডলার দিতে চেয়েছিলেন। মেক্সিকো এসে ভীষণ বিপদে পড়ে গেলে সিজাস। কাছে কোনো টিকিট নেই। তাহলে কি ফাইনাল না দেখেই বাড়ি ফিরে যাবেন তিনি? না। সে সময় সিজাসও যেন তাঁর আগের ইচ্ছাতেই অটুট রইলেন। 

মেক্সিকোর অ্যাজটেকা স্টেডিয়ামে ফাইনাল। ফাইনাল শুরুর আগে স্টেডিয়ামের আশপাশ পায়চারি করতে লাগলেন সিজাস। যদি কোনোভাবে একটা টিকিট ম্যানেজ করা যায় এই ভেবে স্টেডিয়ামে গিয়েছিলেন বেশ কিছুক্ষণ আগেই। কিন্তু লাভ হলো না। টিকিট কোনো ভাবেই যোগাড় করতে পারলেন না৷ এত কাছ থেকে এসে ফিরে যাবেন, সেটা যেন মানতেই পারছিলেন না সিজাস। 

অবশেষে একটা ঝুঁকির আশ্রয় নিলেন তিনি। তিনি দূর থেকে দেখলেন ৫ জনের একটা গ্রুপ স্টেডিয়ামে ঢোকার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সিজাস সেই গ্রুপের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। আর সৌভাগ্যক্রমে টিকিট চেকারের চোখও তিনি ফাঁকি দিয়ে সেদিন স্টেডিয়ামে ঢুকতে  পেরেছিলেন। অ্যাজটেকা স্টেডিয়ামে অবশেষে স্বপ্নের ফাইনাল দেখার সুযোগ পেলেন সিজাস। 

সে নাহয় হলো, কিন্তু সিজাসের ইচ্ছে তো আর শুধু ফাইনাল দেখার মধ্যে আটকে নেই, তাঁর ইচ্ছা- তিনি ম্যারাডোনাকে কাঁধে তুলে উদযাপন করবেন। এখন এজন্য তো আগে আর্জেন্টিনাকে ফাইনাল জিততে হবে। 

রবার্তো সিজাসের ইচ্ছা অনুযায়ী আর্জেন্টিনা ম্যাচটি জিতেও যায়। ৮ বছর বাদে, ম্যারাডোনার হাত ধরে আবারো বিশ্বকাপের স্বাদ নেয় আলবিসেলেস্তারা। আর সেই মুহূর্তকেই ঐতিহাসিকভাবে রূপায়ন করার জন্য সিজাস ম্যারাডোনাকে কাঁধে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এতসব নিরাপত্তাকর্মীদের ডিঙিয়ে ম্যারাডোনার কাছে পৌঁছানো কি এতই সোজা! তবে দুর্দমনীয় ইচ্ছায় এ আর কী প্রতিকূলতা! তাই দুঃসাহসিক একটি কাজ করে বসলেন সিজাস। 

পুলিশদের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্টেডিয়ামে বার টপকে এক দৌড়ে চলে গেলেন ম্যারাডোনার কাছে। আর গিয়েই নিজের কাঁধে চাপিয়ে নেন ম্যারাডোনাকে। এতেই ঐতিহাসিক এক মুহূ্র্তে ফ্রেম বন্দী হয়ে যান সিজাস। ম্যারাডোনার ঐ আইকনিক ছবি যতবার চোখের সামনে আসে ঠিক ততবার সিজাসকেও দেখা যায়। 

ঐতিহাসিক সে ছবির অংশ হওয়াতে গর্বের শেষ নেই রবার্তো সিজাসের। তবে ৩৬ বছর আগের সে দুঃসাহসিক যাত্রা এখনও মনে করে শিউরে ওঠেন তিনি। নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে এমন একটা দুঃসাহসিক কাজ করেছিলেন তা নাকি এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তাঁর।

ম্যারাডোনার ঐ বিশ্বকাপজয়ের পর আর কোনো বিশ্বকাপজয়ের মুহূর্ত দেখেনি আলবিসেলেস্তারা। সেই একই ধারায় সিজাসও দেখেনি। তবে ফ্রান্সের আগে এবারের ফাইনালে আবারও সেই পুরনো বিশ্বাস পেয়েছিলেন সিজাস। তাঁর মনে হয়েছিল, আর্জেন্টিনা এবার বিশ্বকাপ জিতবে। সেই বিশ্বাসকে অবলম্বন করে ৩৬ বছর আগের ঐ কাজটারই পুনরাবৃত্তি তিনি করতে চেয়েছিলেন। এবার তাঁর শখ জেগেছিল, মেসিকে কাঁধে তুলবেন তিনি। 

হ্যাঁ। সিজাসের ভাবনা অনুযায়ী ৩৬ বছর পর আবারো বিশ্বকাপ জিতেছে আর্জেন্টিনা। সেবারের ম্যারাডোনা এবার ফিরেছিলেন মেসি রূপে। কিন্তু সিজাস আর এবার ঐতিহাসিক মুহূর্তের সঙ্গী হতে পারেননি। মেসিকে এবার কাঁধে তুলেছিলেন মেসির সাবেক সতীর্থ সার্জিও আগুয়েরো। কিন্তু তাতে কী, সিজাসের এবারের সাধ না হয় পূরণ হয়নি কিন্তু ৩৬ বছর আগের ঐ ইতিহাসকে অবলম্বন করেই তো আজকের এ বিশ্বকাপ জয়।

আর সিজাস সেই স্থিরচিত্রের ছিলেন এক প্রকার নির্দেশক। সিজাস ভেবেছিলেন বলেই হয়তো অমন একটা আইকনিক ছবির জন্ম হয়েছিল। আর ঐ দৃশ্যের মঞ্চায়ন হয়েছিল বলেই ৩৬ বছর পর এসে মেসিকে নিয়ে সেই একই চিত্রে অনুরূপ রূপায়ন হলো। আর্জেন্টিনার ইতিহাসে তাই রবার্তো সিজাস তাই একটা ব্যতিক্রম ধর্মী একটা চরিত্রের নাম, আগ বাড়িয়ে ইতিহাসের অংশীদারী বললেও ভুল হয় না। 

ফুটবলের সার্থকতা তো এখানেই। কোটি কোটি মানুষের আবেগ মিশে থাকে এই ফুটবল। এমন সব পাগলামির জন্যই তো এই খেলাটা এত নান্দনিক, এত সুন্দর আর সমৃদ্ধ। ফুটবলের পূর্ণতা এনে দেয় দিনশেষে এই পাগলাটে সমর্থকরাই। 

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link