More

Social Media

Light
Dark

সত্যিই এক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা

হিলি না গিলি এই প্রশ্নে সে সময়ে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট মহল দু’ভাগ। দু’জনেই দারুণ উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হলে কী হয়, হিলি কিপিংয়ে দুরন্ত, অন্যদিকে গিলি ব্যাটিংয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্ধর্ষ সব ইনিংস খেলে চলেছেন।

সেবারে শেফিল্ড শিল্ড ফাইনালে দুরন্ত ১৮৯ করেও কিন্তু শিকে ছিঁড়লো না গিলি মানে গিলক্রিস্টের, হিলি ও তো পাশাপাশি দারুণ খেলছেন। কিন্তু বছর ঘুরতেই অস্ট্রেলিয় নির্বাচকরা বুঝতে পারলেন অন্তত ওয়ান ডে ক্রিকেটে এ ছেলেকে সুযোগ না দিলেই নয়, ততদিনে ঘরোয়া ক্রিকেটে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ব্যাট হাতে ঝড় তোলায় বেশ নাম ডাক হয়েছে গিলির।

একদিনের ক্রিকেটে সুযোগ এলেও নিচের দিকে ব্যাট করার ফলে সেভাবে গিলির প্রতিভা বিকশিত হওয়ার সুযোগ হচ্ছিলো না, এদিকে মার্ক টেলরের তখন অফ ফর্ম, অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচকরা আর ওয়ান ডে তে চাইছেন না টেলরকে, ঘরের মাঠে ক্যার্লটন এন্ড ইউনাইটেড সিরিজের ফাইনালেও উঠতে পারেনি অজিরা।

ads

ওয়ানডে ব্যাটিংয়ে নতুন ডাইমেনশান যোগ করতেই মার্ক ওয়ার সাথে ওপেনিংয়ে জুড়ে দেওয়া হলো এবার গিলক্রিস্টকে। প্রথম দিকে তেমন সফল হচ্ছিল না নতুন ওপেনিং জুটি, কিন্তু ত্রিদেশীয় সিরিজের সিডনির দ্বিতীয় ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং কে ছিন্ন ভিন্ন করে এসে গেল কাঙ্খিত প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরিটা, নাহ আর ফিরে তাকাতে হয়নি, ওয়ান ডে ক্রিকেটে অন্তত হিলি না গিলি বিতর্কের অবসান হলো আর এক তারকার জন্ম ও হলো ঐ সিডনির বাইশগজ থেকেই।

টেস্টে কিন্তু সুযোগ এলো আরো বছর দুয়েক বাদে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উলুন গ্যাবায়, হিলি তখন ফর্ম হারিয়েছেন। আর গিলি এদিকে ততদিনে অবশ্য বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য হয়ে গেছেন লর্ডসে পাকিস্তানকেই হারিয়ে। যাক সে কথা, টেস্টে গিলির উদয় আর স্টিভের অস্ট্রেলিয়ার জয়ধব্জা ওড়ার সূচনা কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ’৯৯ এর সেই সিরিজ।

সিরিজের শেষ টেস্টে হোবার্টে এবার টেস্ট ক্রিকেটেও নিজের জাত চিনিয়ে গেলেন গিলক্রিস্ট। পাকিস্তানের দেওয়া ৩৬৯ তাড়া করতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া যখন ১২৬ রানে ৫ উইকেট খুইয়ে ধুঁকছে, সেখান থেকেই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া পার্টনারশিপ এলো গিলি আর জাস্টিন ল্যাঙ্গারের ব্যাট থেকে। ২৩৮ রানের সে পার্টনারশিপে আর গিলক্রিস্টের মহাকাব্যিক ১৪৯ রানের ইনিংসের সৌজন্যে সেই যে অস্ট্রেলিয়ার জয়যাত্রা শুরু হলো যার ভাঙ্গন ইডেনের সেই ঐতিহাসিক টেস্টে।

আর কাকতালীয় ভাবে সেই ইডেন টেস্টেই গিলক্রিস্ট করেছিলেন ‘গোল্ডেন ডাক’। যদিও তার আগের মুম্বাই টেস্টের কথা এ প্রসঙ্গে বলতেই হয়। স্টিভের অস্ট্রেলিয়ার টানা ১৬ টেস্ট জয়ের নজির সেই মুম্বাই টেস্টে ভারতকে পরাস্ত করেই।

সেই মুম্বাই টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার জয় মোটেও হয়তো সহজে আসতো না যদি না গিলক্রিস্টের উইলো থেকে ঠিকরে বেরোতো ১১২ বলে ১২২ রানের এক মোড় ঘোরানো ইনিংস। যাই হোক স্টিভ ওয়ার অস্ট্রেলিয়া দলে টেস্ট আর ওয়ান ডে দুই ফরম্যাটেই গিলক্রিস্ট তখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন।

অস্ট্রেলিয়ার সাথে অন্য দেশের ওয়ান দের সময় গিলক্রিস্ট – হেডেন ওপেনিং জুটি ছিল বিপক্ষ অধিনায়ক আর বোলারদের এক বিরাট মাথা ব্যাথার কারণ। একদিনের ক্রিকেটে প্রথম ওভার থেকেই যে ধুম ধাড়াক্কা ভয়ডরহীন ব্যাটিংয়ের নতুন সংজ্ঞা শ্রীলঙ্কা থেকে জয়সুরিয়া বা নিউজিল্যান্ড থেকে গ্রেটব্যাচরা আরম্ভ করছিলেন, গিলি ছিলেন সেই দলেরই পথিক।

একদিনের ক্রিকেটে দুর্ধর্ষ মহাকাব্যিক বহু ইনিংস ক্রিকেটপ্রেমী উপহার পেয়েছে গিলক্রিস্টের ব্যাট থেকে। মারাত্মক শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়া ব্যাটিং লাইন আপের সৌজন্যে গিলক্রিস্টের টেস্টে ব্যাটিং পজিশন ছিল সাত নম্বরে! সেই সাতে নেমেই টেস্ট ক্রিকেটে অসাধারণ সব ইনিংস উপহার দিয়ে গেছেন।

মনে পড়ে জোহানেসবার্গে দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্ধর্ষ বোলিং আক্রমণের বিরুদ্ধে অসামান্য ডাবল সেঞ্চুরি কিংবা ক্যান্ডিতে মুরলীর বিষ দাঁত সামলে করা ১৪৪ বা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ফাতুল্লা টেস্টে ৯৩ রানে ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর দুর্দান্ত আরেকটা ১৪৪? আবার এই গিলি ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পার্থে শতরান করেছিলেন মাত্র ৫৭ বলে!

হ্যাঁ, টেস্ট ক্রিকেটে মাত্র ৫৭ বলে সেঞ্চুরি এসব গিলির পক্ষেই বোধহয় সম্ভব ছিল, অন্তত সেসময়ের ক্রিকেটের বিচারে, মনে রাখতে হবে তখন মানে ২০০৬ সালে ফ্রাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের দুনিয়াটা তৈরীই হয়নি। ব্যাকফুটে দারুন শক্তিশালী হওয়ার জন্য কাট আর পুল মারায় সিদ্ধহস্ত গিলক্রিস্ট কিন্তু ফ্রন্টফুটে বোলারদের ড্রাইভ মারতে বা স্কয়ার অব দ্য উইকেটেও ব্যাটিং করতেন সমান মুন্সীয়নায়।

গিলক্রিস্টের ব্যাটিং টেকনিক ছিল হাই গ্রিপ বা লং হ্যান্ডেল, ব্যাট গ্রিপ করতেন হাতলের একদম শেষের দিকে, যা একপ্রকার ব্যতিক্রম বলেই ধরা হয়। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ১০০টা ছক্কা মারা গিলক্রিস্টের শক্তির একটা বড় জায়গা ছিল খুব দ্রুত বলের লেংথ বোঝার ক্ষমতা আর তার সাথে হ্যান্ড আই কোঅর্ডিনেশন। এসবের মিশ্রনে গিলক্রিস্ট ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে যান বড়ো ম্যাচের খেলোয়াড় হিসেবে, যা একজন গ্রেট ক্রিকেটারের সবচেয়ে বড়ো গুন।

উইকেটকিপিং দক্ষতায় দুর্দান্ত বললেও হয়তো কম বলা হয় গিলক্রিস্টকে, ওয়ার্ন বা ম্যাকগিলের এর মতো স্পিনারকে উইকেটের পেছন থেকে অসম্ভব সুন্দর ভাবে সামলানোতে, কিংবা ব্রেট লি, গ্লেন ম্যাকগ্রা, গিলেস্পিদের মতো ফাস্ট বোলারদের বোলিংয়ে উইকেটের পেছনে বাজপাখির মতো ক্যাচ তালুবন্দি করতেও গিলির জুড়ি মেলা ভার ছিল অস্ট্রেলিয় ক্রিকেটে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রায় ৮০০ টা ক্যাচ আর ১০০’র মতো স্টাম্পিংই এর প্রমাণ।

২০০৭-০৮  সালে ভারতের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে টেস্ট সিরিজের পরেই আচমকা অবসর ঘোষনা করে দেন টেস্ট ক্রিকেট থেকে, কিনা হাত থেকে তাঁর সহজ ক্যাচ গলেছে। উইকেটের পেছনে রিফ্লেক্স কমে গেছে এ কথা নিজে বোঝার পর আর অপেক্ষা করেননি, যতই সামনে ১০০ টেস্ট খেলার হাতছানি থাক।

এ জন্যই বোধহয় গিলক্রিস্ট সবার থেকে আলাদা, তিনিই পারেন ৯৬ টেস্ট খেলার পরে হঠাৎ অবসর নিতে, আবার তিনিই পারেন বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মতো মহা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে অরবিন্দ ডি সিলভার বলে সুইপ করতে গিয়ে ক্যাচ উঠেছে এবং ফিল্ডার তা ধরেছে দেখে আম্পায়ার আউট দেওয়ার অপেক্ষা না করেই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে।

আবার মুত্তিয়া মুরালিধরণের বিষাক্ত স্পিন ছোবল সামলে বিশ্বকাপ ফাইনালে অসাধারণ ১৪৯ রানের ইনিংস ও যখন তাঁর ব্যাট থেকে বেরোয় তখন মনে হয় এই গিলক্রিস্ট যেন এক বিস্ময়কর ক্রিকেট সত্ত্বা।

যেখানে ব্যাট হাতে দুর্দমনীয়তার সাথে স্ট্যাম্প এর পেছনে ঐ ভরসার দুটো হাত আর মনের মধ্যে সততার ধারা একই সাথে প্রাণ প্রায় এক অ্যাডাম গিলক্রিস্ট নামক সত্ত্বার কাছে। কোনো এক জাদুবলে বছরের পর বছর আপামোর ক্রিকেট প্রেমিকে যেন আকৃষ্ট করে রেখে গিয়েছেন অস্ট্রেলিয় ক্রিকেটের আদরের ‘গিলি’। কালের যাত্রায় গিলি যেন সত্যিই এক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link