More

Social Media

Light
Dark

রঞ্জির উত্তরাধিকার ও লেগ গ্ল্যান্সের রাজকীয়তা

শের শাহ ঘোড়ার ডাক প্রচলন করেছিলেন, তার আগে ঘোড়া ডাকত না। রঞ্জিত সিংজি লেগগ্ল্যান্সের প্রচলন করেছিলেন, তার আগে পায়ের দিকে তাকানোর চল ছিল না – এইরে এটা লিখলেই লক্ষ্মণ পেটাবেন। ভাঙ্গিপুরুপ্পু ভেঙ্কটসাই নন, রামানুজ, অজ্জিনাল। তিনি যে চোদ্দ বছর কাটিয়ে দিলেন বৌদির পায়ের দিকে তাকিয়ে, তার বেলা?

ইয়ার্কি থাক, আসল কথায় আসি, রঞ্জিৎ সিংজি বা রঞ্জিৎ সিংজি জাদেজা বা রঞ্জির আগে কেউ কি লেগ গ্ল্যান্স করেননি? আর তিনি আবিষ্কার করলেনই বা কী করে? মানে গল্পটা কী! গল্প বলে ইংল্যন্ডে পড়তে গিয়ে ক্রিকেট আবিষ্কার করেন আর খেলতে গিয়ে আবিষ্কার করেন যে পেস বোলিং-এ তিনি স্কোয়ার লেগের দিকে ছোটেন।

মানে স্কোয়ার লেগের দিকে তিনি ছোটেন না, কিন্তু পা বাঁচাতে গিয়ে পিছনের পাটা চলে চলে যায়, আর তারপর উইকেটের নাম ভাঙা ক্যানেস্তারা! তখন তাঁর কোচ ড্যানিয়েল হাওয়ার্ড করলেন কী, ডান পাটাকে পিচের সঙ্গে আটকে দিলেন। যাতে নিজে থেকেই পালিয়ে না যায়। এবারে হতে আরম্ভ করল অন্য কেস। তার বাঁ পা বশে রইল না।

ads

সে আবার পিছনের দিকে না গিয়ে পয়েন্টের দিকে যায়, আর অদ্ভুত ভাবে অফস্টাম্পের বলও তিনি মারতে শুরু করেন লেগ সাইডে। ব্যাট দুলিয়ে নামছে, সোজা বল আসছে, কিন্তু চাঁটা মারার সময় পিছনের পা আটকে থাকার কারণে এবং সামনের পা ফোর্থ স্টাম্পের দিকে যাবার কারণে ব্যাটের মুখটা বন্ধ হচ্ছে ঠিক সময়ে আর ফলে মিড অনের দিকে বল না গিয়ে বল যাচ্ছে স্কোয়ারলেগ বা ফাইন লেগে।

ঘটনা হল, রঞ্জির সঙ্গে সঙ্গে যে লোকগাথা শুরু হল তার কারণ তাঁর নমনীয় কব্জি। বস্তুতঃ দক্ষিণ এশীয়দের কব্জিই ইউরোপীয় বা বাকি মানুষদের থেকে অনেক বেশি নমনীয় হয়। সাধে কি আর হাতের মুদ্রায় ভরতনাট্যম, আর গিলি গিলি গে হয় তাদের?

তারপর জল অনেক দূর গড়াল, টেমসের পার থেকে লেগ গ্ল্যান্স এদিক ওদিক সেদিক করে স্থায়ী আস্তানা গাড়ল কাবেরী নদীর পারে আর হুসেনসাগরের ধারে। কে নয়? গুণ্ডাপ্পা রঙ্গনাথ বিশ্বনাথ, এমএল জয়সীমা হয়ে আজহার, লক্ষ্মণ। প্রত্যেকের বিশেষ বিশেষ স্টাইল। ভিশি বলটাকে সাইড অন ফেস করতেন, ফলে অফ মিডের বল স্কোয়ার লেগ কোনও ব্যাপারই ছিল না, সঙ্গে ছিল ভগবানদত্ত টাইমিং সেন্স।

আজহাউদ্দীন আবার অফের বাইরের বলও কব্জির মোচড়ে ফাইন লেগে পাঠাতে শুরু করলেন, আজহারের গ্রিপের দায়িত্ব এখানে অনেকটাই ছিল, উপরের হাত ব্যাটের পিছনের দিকে আর নিচের হাত সঠিক সময়ে চাঁটানোর জন্য প্রস্তুত।

কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছিল, ব্যাটের মুখ সময়ের আগেই বন্ধ হয়ে গিয়ে ব্যাট প্যাডের গ্যাপ বা ব্যাটের মুখ বলের গতিপথ হড়কাচ্ছিল। ঠিক করে দিলেন আরেক কব্জির কারিগর, ইতিহাস তাঁকে এশীয় ব্র্যাডম্যান হিসাবে জানে। উপরের হাতটা শক্ত করে দিলেন ব্যাটের বাইরের দিকের এজ এবং পিছনের ভি-এর মাঝে। সব বল হয়তো ফাইন লেগ খুঁজতে অক্ষম হল, কিন্তু অলরাউন্ড খেলা বাড়ল আজহারের।

লক্ষ্মণ আবার এই শটটাকে অনেক ক্ল্যাসিকাল করে দিলেন। উপরের হাতের কনুইটা ঠিক বলের উপরে থাকার জন্য মাথা অফ স্টাম্পের উপর ঝুঁকে পড়ে না। ফলে ব্যাটে বলে ঠিক নাকের নিচেই হয়। আর শটের সৌন্দর্য? সে তো কব্জির মোচড়ে স্টাইলে প্রস্ফুটিত। ব্যাট পায়ের বাঁ দিকে খেলার পরে স্থান নিতে শুরু করে ডান বুকের উপর। আর এই যখন যুবরাজ সিং-এর বামহাতি নন্দনকাব্যে লেখা হয়, তখন হাই ব্যাকলিফট আর বাঁ কনুইয়ের ঝটকার পর পিছনের পা নটরাজি স্টাইলে ভেঙে যায় হাঁটু থেকে, ব্যাট আশ্রয় নেয় বাঁ কাঁধের অসি চালনার মুদ্রায়।

কব্জির সৌন্দর্য যখন সাগর পাড়ি দেয় তখন তা রূপ পায় ভিভের শক্তিতে অথবা সোবার্সের উত্তোলিত ব্যাটের ডগায়। লারায় এসে আবার এই শট অন্য মাত্রা পায়, লারা তাঁর নিজস্ব স্টাইলে লেগ গ্ল্যান্স ও পুলের মাঝামাঝি শটে বলের সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে উঠে যখন হাই ব্যাকলিফট বেয়ে বলের উপর শক্তি প্রয়োগ করেন আর তারপর বাম কাঁধের স্টাইলের জায়গায় ডান কাঁধের এক নিজস্ব স্টাইলে শট শেষ করেন তখন বল আর গড়িয়ে গড়িয়ে বাউন্ডারির বাইরে যায় না, পিছনে পাগলা ষাঁড় পড়লে যেভাবে ছুটতে ছুটতে যায়, সেভাবে বিলবোর্ডে ধাক্কা খায়।

একই শট যখন গ্রেগ চ্যাপেল বা মার্ক ওয় খেলেন, তখন আবার সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা অন্য কোণে পৌঁছে যায়, মাথা সোজা, পিঠ সোজা শরীর সোজা, শুধু পিছনের পা উঠে বলের উপর ব্যাট নেমে এসে মাথার উপরে উঠে যায়। বল তখন চলে গেছে লংলেগের আশ্রয়ে।

শচীন টেন্ডুলকার আবার এই শটটাকে এক প্রজন্ম বদলানো শটে পরিণত করেন। ভারী ব্যাট, মারার পর মাথার উপর তলোয়ার চালনের মতো ঘোরানো অসম্ভব। তাই সঠিক সময়ে ব্যাটের মুখ ঘুরিয়ে বলের গতিপথ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাট আশ্রয় নেয় কোমরের কাছাকাছি বাঁ দিকে ঝুঁকে। দ্রাবিড় তো বিশ্বনাথ পন্থী, শট মারার পর ব্যাট ধরা দুই হাত এক অদ্ভুত রম্বস তৈরি করে বুকের চারপাশ জুড়ে।

পরবর্তীকালে কেভিন পিটারসন বা বিরাট কোহলি একই শটকে নিজস্ব কেতা দেন। কেতা, এই শব্দটা যেন লেগগ্ল্যান্সের এক বিশাল বিরাসতকে বর্ণনা করে দেয়। লেগের বাইরের বল কোনও মতে ব্যাট ছুঁইয়ে দেওয়া অথবা ব্যাট বলের উপর নামিয়ে মাথার উপর এক পাক ঘুরিয়ে নেওয়ার মধ্যে যে কেতা থাকে সেই কেতাতেই মন্ত্রমুগ্ধ বল লেগ সাইডে বাউন্ডারির বাইরে চলে যায় গটগটিয়ে। আর আমাদের মতো সাধারণ নশ্বর দর্শক? হাত তালি দেওয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারি কি?

কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link