More

Social Media

Light
Dark

মুস্তাফিজুর রহমান ও পরশপাথরের হাতছানি

১.

২০১৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলতে যাবার আগে মুস্তাফিজুর রহমান ছিলেন সারা বিশ্বের ক্রিকেটবোদ্ধাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। যারা তাঁকে আগে দেখেননি তারা ভেবেছিলেন তিনি হয়তো হবেন একজন স্পিনার যিনি কিনা বল ঘুরাতে পারেন বেশ ভালোই। তাঁদের ধারণা একেবারেই অমূলক ছিল নাহ কারণ বাংলাদেশ থেকে  অনেকবছর যাবত বিশ্বমানের কোনো পেস বোলার আসেনি। মুস্তাফিজুর রহমান বলটা ঘুরাতে পারতেন স্পিনারদের মতোই কেবল তিনি সেটা করতেন ঘণ্টায় ১৩০ কি.মি. গতিতে।

তার অভিষেকের পর বাংলাদেশ পেয়েছিল তাদের ইতিহাসের সেরা পেস বোলিং ইউনিট যার নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। ২০১৫ সালে আইসিসির বর্ষসেরা ওয়ানডে দলে জায়গা পান তিনি। ভারতের বিপক্ষে তিন ম্যাচ সিরিজে ১৩ উইকেট নিয়ে একাই ভারতের বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপকে ধসিয়ে দেন। তারই ফলশ্রুতিতে ২০১৬ সালের আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ তাঁকে দলে ভেড়ায় দুই লাখ ডলারের বিনিময়ে।

ads

টেস্টে ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে তিনি রীতিমতো ‘আনপ্লেয়েবল’ হয়ে উঠেছিলেন। ক্রিকেটবিশ্ব বহুদিন এরকম বোলার দেখেনি। কিন্তু সেই মুস্তাফিজ আগের সেই ধার হারিয়ে ফেলেছেন অনেকদিন হলো। মূলত কাঁধের ইনজুরির পর থেকেই তাকে আর পূর্বের ন্যায় কার্যকরী দেখা যায়নি।

২.

২০১৬ সালের মুস্তাফিজুর রহমান ছিলেন অনবদ্য। ১৯৯০ দশকে ক্রিস হ্যারিস কাটার ডেলিভারি করতে পারতেন মিডিয়াম পেস বোলিংয়ে। কিন্তু কখনোই বিশ্বসেরা হবার পর্যায়ে যেতে পারেননি। বব অ্যাপেলইয়ার্ড সর্বশেষ বোলার যাকে কিনা অনেকটা মুস্তাফিজুর রহমানের মতো বলা যায়।

কিন্তু ফুসফুসের সমস্যা আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা সময়ের অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়।প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার যাত্রা শুরু হয় ২৬ বছর বয়সে! যদিও ক্যারিয়ার শেষ করেন ১৫.৪৮ গড়ে ৭০৮ উইকেট নিয়ে।

অ্যাপেলইয়ার্ড স্পিন-পেস দুরকম বলই করতে পারতেন। তিনি ম্যাচের শুরুতে নতুন বলে যেমন আউটসুইং করাতে পারতেন তেমনি ম্যাচের মধ্যভাগে হয়ে যেতেন পুরোদস্তুর অফ স্পিনার। সিডনি বার্নস এবং স্যার গ্যারি সোবার্সও স্পিন-পেস দুটোর সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ব্যাটসম্যানদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিরোধ্য।

মুস্তাফিজুর রহমান তার সতীর্থ উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান আনামুল হকের কথায় প্রথম কাটার দেবার চেষ্টা করেন।তার প্ল্যান ছিল যত বেশি সম্ভব স্পিডে বল স্পিন করানো। এই সাধারণ প্ল্যানই তাঁকে অতি অল্প সময়ের মাঝে বিধ্বংসী এক বোলারে পরিণত করে। ইনজুরির আগে মুস্তাফিজুর কেবলমাত্র একটি টেস্ট খেলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অভিষেক টেস্টেই করেন দুর্দান্ত এক স্পেল। চার বলের মাঝে তুলে নেন হাশিম আমলা, জেপি ডুমিনি আর কুইন্টন ডি ককের মতো ব্যাটসম্যানদের।

প্রথম ইনজুরির আগে ১৫টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে তার গড় ছিল ১৮.৩৮।

৩.

মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স প্রতিবছরের নিলামে বাঁহাতি পেসার দলে নেওয়াকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে। ২০১৮ সালে তাঁরা দলে ভেড়ায় মুস্তাফিজুর রহমানকে যিনি কিনা তখন ইনজুরির পর থেকে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন।মুস্তাফিজকে তার আগের ফর্মে ফিরিয়ে নিতে মুম্বাই দোভাষী হিসেবে নাফিস ইকবাল আর মেন্টর হিসেবে কিংবদন্তী লাসিথ মালিঙ্গাকে নিযুক্ত করে।

মালিঙ্গার ভাষ্যমতে, ‘যখন সে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসে তখন সে ছিল অসাধারণ। কিন্তু এখন তাকে বোলিংয়ে নতুন অস্ত্র যোগ করতে হবে। সে তিন-চার রকমের বল করতে পারে,তবে তাকে গেমপ্ল্যানে আরো মনোযোগ দিতে হবে যাতে সে বলে ভ্যারিয়েশন আনতে পারে। আশা করি আমি তাকে আরো শানিত করতে পারবো।’

মুস্তাফিজের মুম্বাই অভিজ্ঞতা ছিল তিক্ত। মুম্বাইয়ের হয়ে খেলে সাত ম্যাচে তার গড় ছিল ৩২.৮৫! তাঁকে নিয়ে মুম্বাইয়ের হতাশা বুঝতে পারা যায় যখন মুম্বাইয়ের কোচ মাহেলা জয়াবর্ধনে তার ইংরেজি না জানা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন এবং অতিদ্রুত তাঁকে ইংরেজি শেখার পরামর্শ দেন। ২০১৯ সালে মুম্বাই মুস্তাফিজকে ছেড়ে দেয়।

কিন্তু আইপিএল এখনো তাঁর ২০১৬ সালের অতিমানবীয় পারফরম্যান্স ভুলতে পারেনি। ২০১৬ সালে তিনি বেশিরভাগ সময় ডেথ ওভারে বল করেও ইকোনমি রেট রাখেন মাত্র ৬.৯০। মুস্তাফিজ ফিরে আসবেন এই ভরসায় রাজস্থান তাকে এবারের আসরে দলে ভেড়ায়। মুস্তাফিজ হয়তো ইতিহাসের সেরা মৌসুম উপহার দিতে পারেননি কিন্তু ২০১৬ সালে তিনি ডেথ ওভারে ছিলেন অপ্রতিরোধ্য।

৪.

সাসেক্সের হয়ে কাউন্টি খেলতে গিয়ে মুস্তাফিজ কাঁধের ইনজুরিতে পড়েন। তার কাঁধের সুপেরিয়র ল্যাব্রাম পেশি ছিঁড়ে যায়।বব অ্যাপেলইয়ার্ডেরও কাঁধে ইনজুরি সমস্যা ছিল। এতে ধারণা করা যায় যে পূর্ণ গতিতে কাটার বল করা বোলারদের মাঝে এই সমস্যা সচরাচর দেখা যায়।

অনুমান করা হয় মুস্তাফিজুরের ইনজুরিতে পড়বার পেছনে অন্যতম কারণ হলো টানা ম্যাচ খেলা। ২০১৬ সালে মুস্তাফিজ সব ধরনের ক্রিকেট মিলিয়ে কেবল ১২০ ওভার বল করেন যা কিনা একজন পেস বোলারের তুলনায় বেশ কম।

৫.

২০২০ সালে রাজস্থানের হয়ে ৭ ম্যাচে ফিজের ইকোনমি ছিল ৮.৩০। মুম্বাইয়ের বিপক্ষে ম্যাচে ১৯তম ওভারে বোলিংয়ে আসেন ফিজ,যখন মুম্বাইয়ের দরকার ছিল নয় রান। একটা সময় মুস্তাফিজ এই রানকেই করে ফেলতেন প্রতিপক্ষের জন্য পাহাড়সম। কিন্তু এখন পোলার্ড আর ডি কক মিলে তিন বলে খেলা শেষ করে ফেলেন।

ইংল্যান্ডের জোফরা আর্চার যদি ফিট থাকতেন তবে হয়তো কেবলমাত্র অগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচেই সুযোগ পেতেন মুস্তাফিজ। তবে, এটা ঠিক যে তিনি নিয়মিত উইকেট পেয়েছেন।

৬.

মুস্তাফিজের নতুন এই অবস্থানটাকে তাঁর রূপান্তর ধরলে, এই রূপান্তরের নায়ক হলেন ওটিস গিবসন – বাংলাদেশের স্পিন বোলিং কোচ। তিনি বাংলাদেশে এসেই বুঝে যান যে নতুন বলে তাঁর মূল ভরসা এই মুস্তাফিজ। ফলে তিনি এই বাঁ-হাতি পেসার অস্ত্রশালায় গুরুত্বপূর্ণ একটা অস্ত্র যোগ করেন – ইনস্যুইঙ্গার।

যদিও, ২০২১-এর আইপিএলে মুস্তাফিজ মূল কারিশমা দেখিয়েছেন স্লোয়ার ডেলিভারিতে। স্লোয়ার আগেও তাঁর ছিল। এটা শুরু থেকেই তাঁর অন্যতম বড় অস্ত্র, তবে এবার সেই অস্ত্রটায় একটা বিপ্লব এসেছে।  তিনি এই বলটা এখন করেন মুত্তিয়া মুরালিধরণের অফস্পিনের মত।

এখনো পর্যন্ত মুস্তাফিজ ফিরে আসার গল্প লিখতে পারেননি। একদা তিনি যে পরশপাথর পেয়েছিলেন, সেটা হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। তিনি এখন আর ১০ জন আন্তর্জাতিক বোলারের মতই একজন। তবে, লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন তাঁর মধ্যে আগের মত রহস্যটা হয়তো নেই, তবে কার্যকারিতা আছে। শুধু লড়াইটা অব্যাহত রাখতে হবে।

মুস্তাফিজের মতো প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিভা নিয়ে খুব কম ক্রিকেটারই জন্মান। যত তাড়াতাড়ি ধ্বংসস্তুপ থেকে ফিনিক্স পাখির ন্যায় ঘুরে দাঁড়ানোর রূপকথার গল্প লিখবেন তিনি, ততই মঙ্গল তাঁর নিজের এবং বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য। আমরা বরং না হয় সেই দিনেরই অপেক্ষা করি।

– ইএসপিএন ক্রিকইনফোর ছায়া অবলম্বনে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link