More

Social Media

Light
Dark

হিংসা নেই, রক্ত নেই, আছে শুধু ক্রিকেট

শীতকালে কাকভোরের অন্ধকার কাটতে সময় লাগে। সাইকেলে কিরিং কিরিং করতে করতে পাইপিট যেত ছেলেমেয়েরা।চায়ের দোকানগুলোতে কুণ্ডলী পাকিয়ে উড়ে যেত ধোঁয়া। ভোর ছয়টায় আলো একটু সদৃশ হলে আকাশবাণীর সাইরেন বাজতো কোনো কোনো বাড়িতে।

তারপর শুরু হতো বন্দেমাতরম, একে একে আসতো সংবাদ, চাষীদের খবর,ছায়াছবির গান। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ছেলেমেয়েরা পাইপিট থেকে ফিরে আসতো।গুড়-মুড়ি কিংবা ফ্যানভাত খেয়ে এখুনি বেরিয়ে যাবে ইস্কুলে।আমার ইস্কুল নেই।

পৌষের জলখাবার বেলায় কানে ভেসে আসতো ধানঝাড়ার মেশিনের শব্দ। একটানা মেশিনের শব্দ ভেদ করে কোথা থেকে কিছু ভেসে আসা কথা কান গড়িয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে — ‘বল হাতে দৌড়ে আসছেন মোহাম্মদ সামি।স্ট্রাইক নিচ্ছেন শেবাগ,নন স্ট্রাইকে দ্রাবিড়।’

ads

আমার দৌড়ে যাবার পালা শুরু হতো তখন। যে বাড়িতে সাদাকালো কেবলওলা টিভিতে খেলা দেখতে যাবার কথা, সেই বাড়ির সন্টুকাকু এখনও ব্যস্ত, ধানের গাদা তৈরী করছে। ধুসস্, আর কি তর সয়! দেরি হয়ে গেলে শেবাগ যদি আউট হয়ে যায়! আফ্রিদি আশি বলে একশো করে গেছে, তাও টেস্ট ম্যাচে।

পাকিস্তানের ছয়শোর উপর রান। কি জানি কি হয়! অবশেষে খেলা জোড়া হতো টিভিতে। ঝিলিঝিল করা টিভিতে জ্যাক গোঁজা হলে ছবি আসতো। চ্যানেল ঘোরাবার স্ক্রু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসা হতো ন্যাশানাল চ্যানেলে। আর তারপর -আমার কিশোর দুনিয়ার সব স্বপ্ন রঙীন হয়ে নেমে আসতো সাদাকালো চ্যানেলে।

মনে হতো যেন বসে আছি লাহোর কিংবা পেশোয়ারের স্টেডিয়ামে। চোখের সামনে ঘুরে বেরাচ্ছে লম্বা দাড়ির ইনজামাম, লম্বা চুলের শোয়েব, ক্লিন সেভের ইউনুস খান। ভারতের গোল ব্যাজ হেলমেটে জ্বলজ্বল করছে দ্রাবিড়-শেবাগের। পেপসির লাল-নীল লোগো পাকিস্তানের হলুদ তারাওলা সাদা জার্সিতে খেলছে বেশ!

তবে সাহারার তিরঙ্গা আঁকা সাদা জার্সির কাছে সেটা ম্রিয়মানই। আমার জলখাবার খাওয়া হতোনা। ঠাম্মি ডাকতে আসতো,কিন্তু আমার কোনো খোঁজই নেই। বুঁদ হয়ে বসে বসে দেখছি শোয়েবের দৌড়ে ছোঁড়া গোলা গুলো দ্রাবিড়ের ব্রিটানিয়া ব্যাটের মাঝখানে লেগে কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে, দানিশ কানেরিয়ার মচকানো রিস্ট স্পিনকে শেবাগ এগিয়ে এসে পার করিয়ে দিচ্ছে লাহোরের স্টেডিয়ামে।

এতক্ষণে ঠাম্মি আমার খোঁজ পেয়ে গেছে হয়তো। জলখাবার না খেয়ে উপায় নেই এবার। নাকেমুখে গুঁজতাম মুড়ি-আলুভাজা। খেতে খেতেই চট করে উল্টে দেখে নিতাম রোদে শুকোতে দেওয়া তেঁতুল-বট-নিম গাছের পাতাগুলো; ইস্কুলছুটি শেষ হলেই সেগুলো খাতায় চিটিয়ে জমা দিতে হবে কিনা, পাশে লাইন টেনে লিখে ফেলতে হবে মৌলিক পত্র,যৌগিক পত্র….ধুসস্ ওসব পরে হবে খন্।

শেবাগ এতক্ষণে বোধহয় আউট। দৌড়ে যেতাম আবার। কই শেবাগ আউট হয়নিতো। সারাদিন পিটিয়ে গেল। মাঝে মাঝে লাহোরের আকাশে ঘনিয়ে ওঠা মেঘ খেলা বন্ধ করে দিতো। তারপর মেঘ কাটলে আবার খেলা শুরু। সারাদিনে শেবাগ আউট হলোনা, দ্রাবিড়ও না। ভারত চারশো দশ অবলিক শূন্য। ক্লান্ত মোহাম্মদ সামি, ক্লান্ত শোয়েব আখতার, ক্লান্ত দানিশ, ইনজি, সবাই।

শুধু ক্লান্ত নই দ্রাবিড়, শেবাগ…..আর আমি। একটা শীতকাল গেলে আরেকটা শীতকালের অপেক্ষা। ভারত খেলতে যেত পাকিস্তানে। কুয়াশার ছায়ায় রঙিন সোয়েটার পরা কচিকাঁচারা ব্যাগ কাঁধে আবছা হয়ে যেত সাইকেল চালাতে চালাতে। আমি অপেক্ষা করতাম সকাল সাড়ে নয়টার। সাদা জামার ভারত-পাকিস্তান খেলতে নামবে। হিংসা নেই, রক্ত নেই, আছে শুধু ক্রিকেট।

এখনও শীতকাল আসে। এখন আর পাকিস্তান আমাদের বল করেনা, আমরাও আর পাকিস্তানকে ব্যাট করিনা। এখন গুলি চলে, পুলওয়ামা হয়, উরি হয়। শীতকাল আসে। চায়ের দোকানের কুণ্ডলীকৃত ধোঁয়া, আকাশবাণীর সাইরেন, কলকাতা ‘ক’,ছশো আটচল্লিশ কিলোহার্জ, সংবাদ, চাষীদের খবর, ধানঝাড়ার শব্দ হয়ে….তারপর?

সেই শব্দটা, সেই কথাগুলো আর আসেনাতো। সাদা জামার দ্রাবিড়, ইনজামাম, সামি, জহির, শেবাগ, আফ্রিদিরা শীতের কুয়াশার মতো কোথায় যেন উবে গেলো। সেই হিমহিম করা চিন্তা-অপেক্ষা-উত্তেজনাগুলো, সাদা জামার ভারত-পাক ডুয়েলগুলো, সন্টুকাকুর বাড়িতে হন্যে হয়ে পড়ে থাকাগুলো, খেতে ডাকার সময় আমাকে খুঁজে না পাওয়াগুলো…..কই আর হয়না তো!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link