More

Social Media

Light
Dark

সেই মোহনার ধারে

আকাশের অনেকটা উঁচু দিয়ে উড়ে যায় পাখির ঝাঁক। তাদের সার বেঁধে উড়ে যাওয়া এঁকে দেয় আকাশের সীমানা। সেই সীমানার নিচে আমাদের ছোটো ছোটো পাখিদের ঘরবাড়ি সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের মাঝে বেঁচে থাকে একটু একটু করে। এই প্রাণের কলরবে হয়ত সকলে ভুলে যায় ওই পাখির সীমানার ওপরে রয়ে গেছে একটা আকাশ, একটা খোলা আকাশ, যার রঙ নীল।

বেন স্টোকসের ছুঁড়ে দেওয়া ব্যাটটায় লেগে যখন বলটা দিক পাল্টে রকেটের মতো ছুঁটে গেল বাউন্ডারিতে, তখন সেই নীল আকাশের কোথাও যেন মেঘ করল একটু। ভারী হয়ে এল একটা জমাট নিম্নচাপ। দুরন্ত বেন স্টোকস জানতেন আজ বিগ বেনের প্রতিটা কম্পন ব্রিটিশ আভিজাত্যের ওজন বুঝিয়ে দিচ্ছে।

শেষ বলে রান আউট হবার পর যখন ম্যাচ সুপার ওভারে তখন কেন উইলয়ামসনের মুখটা দেখা গেল একবার, তিনি জানেন ঐ নীল আকাশের নীচে পাখিদের এঁকে দেওয়া সীমানাটা। এর ভেতর তাঁকে লড়তে হবে, লড়াই-এর দুটো ফলাফল, দুটো স্থির বিন্দু। জয় আর পরাজয়। এখানেই আকাশের সীমাবদ্ধতা।

ads

মার্টিন গাপটিল দ্বিতীয় রানের দৌড়টা শুরু করার আগে জানতেন মার্টিন ক্রো’র স্বপ্ন আর কেন উইলিয়ামসনের বাস্তবের মাঝে দূরত্ব স্রেফ বাইশটা গজ। মার্টিন গাপটিল জানতেন তাঁর পায়ের পাতায় মাত্র একটা আঙুল নিয়ে ক্রিকেটার হয়ে ওঠার রূপকথা আর সেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হবার দূরত্ব মাত্র বাইশ গজ।

গাপটিল জানতেন কালো টুপির ওপর মন খারাপ করা রূপোলি ফার্ণ পাতার সজীব হয়ে ওঠার থেকে তাঁর দূরত্ব সেই বাইশ গজ। তবু ফিনিশিং লাইনের আগেই শেষ হয়ে গেল লড়াইটা।

সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত, জোয়ার থেকে ভাঁটা,সময়ের ঘষা লেগে পাল্টে যাওয়া ঋতু- সবকিছু যে অমোঘ সত্যের নিয়মে চলে তাঁকে অস্বীকার করলে হেরে যেতে হয়। তাকে মেনে নিতে পারলেই জীবনের সবুজ মাঠে আমাদের জিতে যাওয়া। এই বাউন্ডারি সংখ্যার নিয়ম প্রথম থেকেই লাগু ছিল, তাই এ নিয়ম যতই অপ্রিয় হোক তবুও সত্য।

তাই হয়ত ম্যাচ শেষ হবার পর লর্ডস গালিচায় ব্রিটিশ সেলিব্রেশনের সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়েছিলেন কেন উইলিয়ামসন। তিনি সৌরভ গাঙ্গুলি হলে হয়ত ওই বাই-৪ রানের পর আগুনে ঔদ্ধত্যে চ্যালেঞ্জ জানাতেন আম্পায়ারকে। তিনি বিশ্বের অন্য কোনো দেশ হলে হয়তো সরাসরি তোপ দাগতেন আইসিসি’র বিরুদ্ধে, যেমন আমরা দেগেছিলাম সেদিন।

কিন্তু, কিউই অধিনায়ক জানেন তিনি এমন একটা ধর্মযুদ্ধে সেনাপতি হয়ে নেমেছেন যাকে সারা বিশ্ব চেনে ‘দ্য জেন্টলম্যানস গেম’ বলে। তিনি তাই ম্যাচ শেষ হাসি মুখে জানান দিয়ে যান নিজের অস্তিত্ব, তিনি পৃথিবীর সমস্ত ভাগ্যের কাছে হেরে যাওয়া মানুষদের পিঠে হাত রেখে বলেন আবার কাল নতুন দিন শুরুর কথ।

নিয়মের অদৃশ্য সুতো আসলে এক সত্য। এই সত্যকে যত্ন করে বুকে স্থান দিতে হয়। একে অস্বীকার করতে নেই, বরং নিজের জীবন দিয়ে লালন করতে পারলেই একজন কেন উইলিয়ামসন হওয়া যায়।

ক্রিকেটের ইতিহাসে লেখা হয়ে গেল ব্রিটিশ লড়াই-এর নাম, চ্যাম্পিয়নদের খেতাব গেল লন্ডনে কিন্তু সে তো ঐ পাখিদের এঁকে দেওয়া আকাশটার নিচে।

ওর ওপরে যে থেকে যায় ২০১৪-এর লিওনেল মেসির মারাকানায় একলা দাঁড়িয়ে থাকা। থেকে যায় রবার্তো বাজ্জিও-র পেনাল্টি মিসের পর অসহায় দুটো চোখ। থেকে যায় রেনাস মিশেল-ইয়োহান ক্রুইফের ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন। থেকে যায় এবি ডি ভিলিয়ার্সের কান্না আর তাঁর সাথে কাল থেকে থেকে যাবেন হাসিমুখের ক্রিকেটের কর্ণ কেন উইলিয়ামসন!

এই নীল আকাশে কোনো নিয়ম নেই, কোনো বাঁধন নেই- এখানে বিছানো থাকে ভালবাসা। বিছানো থাকে হাজার হাজার ভাঙা মনের নরম একটা গালিচা- সেখানে নতুন কোনো স্বপ্ন নিয়ে নামেন মেসি-ক্রুইফ-বাজ্জিও-কেনরা। এখানেই কাল অকল্যান্ডের সবুজের ভেতর আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে রূপোলি ফার্ণ পাতাটা, সাদা পাখির দেশে সমস্ত গান সিম্ফনি হয়ে বাজবে, সেই মোহনার ধারে ক্রিকেট ঈশ্বরের সাথে দেখা হবে এক শান্ত, সোনালি দাড়ির ক্রিকেট প্রেমিকের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link