More

Social Media

Light
Dark

নতুন আলো ঘরে আসবে

ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ টি-টোয়েন্টির খেলা চলছে তখন।

আবাহনীর হয়ে খেলা মুনিম শাহরিয়ার তখন মহা চিন্তায়। কেননা চার ম্যাচ পর তাকে একাদশ থেকেই বাদ দিয়ে দিয়েছে আবাহনী। তবে আবাহনীকেও কিন্তু দোষ দেওয়া যায়না। চার ম্যাচে মাত্র ৬৯ রান করা কাউকে একটা দল কেন রাখবে। আর তিনি তো খ্যাতিমান কেউও নন!

মুনিম শাহরিয়ারের অখ্যাত ক্যারিয়ারে এই বাদ পড়া কিন্তু ছোটখাট একটা ব্যাপার ছিল না। এটার পরিধি ছিল অনেক বড়। এমনিতেই তিনি নামী কোন ক্রিকেটার নন, তার ওপর প্রিমিয়ার লিগের দল থেকে বাদ পড়লে তার চলবে কিভাবে!

ads

মুনিম শাহরিয়ার চিন্তায় পড়ে গেলেন। তবে মুনিমকে এই চিন্তা থেকে উদ্ধার করলেন আবাহনীর কোচ খালেদ মাহমুদ সুজন। অনুশীলনের সময় একদিন তিনি মুনিমকে আলাদা করে ডেকে নিলেন। সুজন সম্ভবত বুঝতে পারছিলেন, তরুণ এই ক্রিকেটারকে গোটা একটা মৌসুমের জন্যে বাদ দেওয়ার মত যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হয়নি।

তিনি মুনিমকে তাই আরো সুযোগ দিতে চাচ্ছিলেন। তিনি মুনিমকে জানালেন, মুনিমের সেভাবেই ব্যাট করা উচিত যেটা প্রকৃতিগতভাবে তার মধ্যে আছে। খুব আহামরি কোন টোটকা নয়, তবুও মুনিম বুঝলেন এই ছোট্ট একটা উপদেশের মধ্যেই আছে তার জন্যে অনেক বড় বার্তা।

ইএসপিএন ক্রিকইনফোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেই তিনি যেমনটা বলেছেন, ‘আমি যখন পরপর দুই ম্যাচেই বাদ পড়ে গেলাম, সুজন স্যার আমাকে বললেন, ‘তুমি এত চিন্তা করছ কেন? স্রেফ নিজের মত খেলে যাও।’ ওনার কথাগুলি আসলেই আমার ওপর ইমপ্যাক্ট ফেলেছিল। পরের ম্যাচেই আমি প্রাইম ব্যাংকের সাথে ৫০ বলে ৯২ রান করেছিলাম, এর পরের ম্যাচে করেছিলাম ৪০ বলে ৭৪। লিগের ঐ মৌসুম আমি শেষ করেছিলাম ১৪৩ স্ট্রাইক রেটে ৩৫৫ রান করে।’

মুনিমের সাথে কোচ খালেদ মাহমুদ সুজনের পরিচয়ের ঘটনা কিন্তু সোজাসুজিভাবে হয়নি। সেটা ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ২০১৯-২০ আসরের ঘটনা । নিজের দল আবাহনীর জন্যে সুজন তখন একজন ওপেনার খুঁজছিলেন। পঞ্চাশ ওভারের ঐ টুর্নামেন্টের জন্যে মুনিমকে প্রথম রিকমেন্ড করেন মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত।

সৈকতের সাথে মুনিমের পরিচয় আবার ময়মনসিংহের সূত্র ধরে। মুনিম আর সৈকত দুজনের হোমটাউনই যে এই জেলাতেই। তবে সৈকতের সাথে সাথে শান্তও সুজনকে বলেছিলেন মুনিমের কথা। মুনিমকে শান্ত অবশ্য আগে থেকেই চিনতেন। অনূর্ধ্ব ১৯ দলে দুজন ছিলেন টিমমেট!

সে যা হোক, সুজন আর মুনিমের আলাপে ফিরে আসা যাক। সুজনের বলা ঐ নিজের মত ক্রিকেট খেলার টোটকাই বদলে দেয় মুনিমের ক্যারিয়ার। তিনি ঐ প্রিমিয়ার লিগে টি-টোয়েন্টিতে জাত ব্যাটসম্যানের মত রান করতে থাকেন। কোচ খালেদ মাহমুদ সুজনও মুনিমে এতটাই মুগ্ধ হন যে এবারের বিপিএলে নিজের দল ফরচুন বরিশালেও টেনে নেন মুনিমকে। অবশ্যি এখানে খানিকটা বিতর্ক থেকে যায়।

কেননা ড্রাফটের শুরুতেই মুনিমকে দলে নেয়নি বরিশাল। অবশ্য বরিশাল কেন, দুর্দান্ত এক ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ টি-টোয়েন্টির আসর কাটানোর পরও মুনিমের প্রতি আগ্রহ দেখায়নি কোন ফ্রাঞ্চাইজিই। শেষ অব্দি ড্রাফটের পর যখন বরিশাল দলে টেনে নেয় মুনিমকে, খুব সম্ভবত নিজেদের এই সিদ্ধান্তের জন্যে তারা পুরো আসরজুড়েই নিজেদের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করেছে। কেননা শুরুতে দল না পাওয়া ছেলেটাই গোটা টুর্নামেন্টে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের দেখিয়েছে টি-টোয়েন্টিটা কিভাবে খেলতে হয়। কারণ?

ন্যূনতম ১০০ রান করা বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে মুনিমের চাইতে বেশি স্ট্রাইক রেট নেই আর কোন ব্যাটসম্যানের!

মুনিমের মধ্যে আধুনিক ক্রিকেটের ব্যাটসম্যান হওয়ার মত সব রসদ আছে। জায়গায় দাঁড়িয়ে বলকে জোরে মারতে পারা, মুনিমের এই গুণটাই আধুনিক ক্রিকেটের সাথে খুব ভালভাবেই যায়। মিড অফের ওপর দিয়ে বিপিএলে তিনি যে কয়টা শট খেলেছেন, সেগুলিই প্রমাণ করে তিনি এসেছেনই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের চাহিদা মেটাতে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের সেই ম্যাচটার কথা মনে আছে? মিড উইকেটের ওপর দিয়ে মুস্তাফিজকে উড়িয়ে মারা সেই ছক্কাটা?

কুমিল্লা শিবিরেই যেন নেমে এসেছিল পিনপতন নীরবতা। শটটার মধ্যে কিন্তু আহামরি কিছুই ছিল না। নিতান্ত গোবেচারা দেখতে একটা পুল শট। কিন্তু তিনি সেই শটটাকেই যেভাবে শেষ মুহুর্তে বাহুর মোচড়ে আয়েশি ভঙ্গিতে উড়িয়ে মারলেন, সেটাই ছিল কুমিল্লার নীরবতার কারণ। কেননা, মুস্তাফিজকেও কিনা এভাবে ছয় মারতে পারে কোন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান!

মুনিমকে নিয়ে আলোচনার শুরু ছিল ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ টি-টোয়েন্টি। সেটার গল্প তো আগেই বলেছি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মুনিমকে নিয়ে এত আলোচনার কারণ সদ্য শেষ হওয়া বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ(বিপিএল)। টুর্নামেন্টটিতে তিনি পাঁচ ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে করেছেন ১৭৮ রান, স্ট্রাইক রেট ছিল ১৬১.৮১!

আর আপনি যদি গত সাত মাসে বাংলাদেশ ক্রিকেটের টি-টোয়েন্টি ম্যাচগুলি দেখে থাকেন, তাহলে আপনার অনুমান করতে কষ্ট হবার কথা নয় কেন মুনিমকে ঘিরে আশায় খেলাঘর বাঁধছেন বাংলাদেশিরা! ইতোমধ্যেই তিনি আফগানিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দলে ডাক পেয়েছেন। সব ঠিকঠাক থাকলে হয়তো অভিষেকের ক্যাপও পরে ফেলবেন মার্চের শুরুতেই!

তবে ২৩ বছর বয়সের মুনিম অবশ্য এখনি অতদূর ভাবছেন না। মাত্রই তিনি বিপিএল ফাইনাল খেলেছেন, মস্তিষ্কে এখনও ওটার রেশ রয়ে গেছে। ইএসপিএন ক্রিকইনফোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘বিপিএলের প্রথম কয়েক ম্যাচ আমার কোভিডের কারণে মিস হয়ে গেছিল।

আমার এরপর বিপিএলের জন্যে প্রস্তুত হতে বেশ কিছু সময়ের প্রয়োজন ছিল। দলও বেশ কিছু ওপেনিং জুটি দিয়ে ট্রাই করছিল। একসময় লিনটট আর ব্রেভো গেইলের সাথে ওপেন করে। কিন্তু আমার প্রথম ম্যাচের আগে, সুজন স্যার আমাকে আলাদা করে ডেকে নেন। তিনি আমাকে বলেন, আমি আগামী চার ম্যাচ দলে সুযোগ পাচ্ছি আর আমাকে দল থেকে নিজের মত খেলার স্বাধীনতা দেওয়া হবে।’

তবে মুনিম কিন্তু নিজের বিপদও বেশ ভালভাবেই জানেন। বিশেষ করে তার খেলার যে নিজস্ব ধরণ, সেটা বাংলাদেশি পিচের সাথে একদমই যায়না। কিন্তু মুনিম এসব একদমই ভাবতে নারাজ। ইএসপিএন ক্রিকইনফোকেই তিনি বলেছেন, ‘আমি মাত্র দুটো টুর্নামেন্ট খেলেছি। এখনও অনেক পথ যাওয়া বাকি। আমি জানি আমি কিভাবে ব্যাট করি। আর আমি এভাবেই দীর্ঘদিন ব্যাট করতে চাই। যারা আমাকে চেনে তারা খুব ভালভাবেই জানে আমি আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান। আমি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করি আর নিজের পরিকল্পনাতেই আটকে থাকতে চাই। আমি নতুন বলেই ব্যাট করতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করি আর শুরুতেই বৃত্তের সুবিধা নিতে পছন্দ করি। আমি স্কুল ক্রিকেট থেকেই এভাবে ব্যাট করি, এমনকি তিন দিনের ম্যাচগুলিতেও আমি এভাবেই ব্যাট করেছি। আমার কোচ, প্রয়াত হায়াতুল ইসলাম হান্নানই আমাকে এভাবে ব্যাট করার অনুশীলন করিয়েছেন।’

তবে মুনিমকেও মাথায় রাখতে হবে, বাংলাদেশ ক্রিকেটে এভাবে টিকে থাকতে হলে তার সামনে বাধার অভাব হবেনা। মুনিমের মতই বিপিএলকে পুঁজি করে দলে আসা ব্যাটসম্যানের তো আর অভাব ছিল না দেশের ক্রিকেটে। ২০১৩ সালের সেই বিপিএলটার কথা মনে আছে? ছয় ফিটিতেই শামসুর রহমান সোজা দলে ঢুকে গেছিলেন।

আবার ১৯-২০ আসরে মাহেদী হাসানও ভাল খেলার পুরস্কার পেয়েছেন, দলে এখন তিনি নিয়মিত সদস্য। সাব্বির রহমান অবশ্য বিপিএলের হটকেক পারফরম্যান্সকে জাতীয় দলে রূপান্তরিত করতে সময় নিয়েছিলেন, তবুও তারও জাতীয় দলে আসার রাস্তা ছিল বিপিএল। আবার বিপরীত উদাহরণও কিন্তু কম নেই। বিপিএল মাতানো মেহেদি মারুফ জাতীয় দলের দরজাই খুলতে পারেননি।

এদের মধ্যে আবার শুভ আর সাব্বির বিপিএলের সম্ভাবনা ফুল হয়ে ফোটাতে পারেননি। মুনিমের ক্ষেত্রে কি হবে সেটা অবশ্য এখনই বলা যাবেনা। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত করে বলা যাবে, মুনিমের খেলার যে ধরণ, এমন কিছুই দীর্ঘদিন ধরে সাদা বলের ক্রিকেটে খুঁজে ফিরেছে বাংলাদেশ। মুনিম শাহরিয়ারের সামনে সময় আছে অনেক, সুযোগও হয়তো মিলবে প্রচুর। তিনি যদি বিপিএলের পারফরম্যান্স ধরে রাখতে পারেন, তাহলে তিনিই পারেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের টি-টোয়েন্টির মাইন্ডসেটকে পরিবর্তন করে দিতে!

আর সেজন্যেই মিনহাজুল আবেদীন নান্নু যখন বলেন তারা মুনিমের ওপর হাইপারফরম্যান্স দলের সময় থেকেই নজর রাখছিলেন। এখন দেখার সময় মুনিম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কেমন পারফরম্যান্স করেন, তখন নান্নুর সাথে আশার খেলাঘর বেঁধে ফেলে গোটা একটা ক্রিকেট জাতিও!

আর সেই খেলাঘর সাজবে না ভাঙবে সেটা অবশ্য ঠিক করবেন মুনিম শাহরিয়ার নিজে!

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link