More

Social Media

Light
Dark

নাজমুল হোসেন শান্ত, ফ্যাক্ট বনাম ফ্যালাসি

নাজমুল হোসেন শান্ত এমন একজন ক্রিকেটার, যার পেছনে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) বিনিয়োগ প্রচুর। যারা বাংলাদেশের ক্রিকেট গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন খুব নিয়মিত, তারা অনেক আগে থেকেই জানতেন, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে নাজমুল হোসেন শান্ত একদিন বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলবে। বয়সভিত্তিক দলেও তার পারফরম্যান্স ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ কান্ডারী হিসেবে বিসিবিকে আশা দেখিয়েছে।

তাইতো, বয়সভিত্তিক দল পেরোনোর পর পরই তাকে জাতীয় দলের রাডারে নিয়ে আসা হয়, মাত্র ১৯ বছর বয়সেই নিউজিল্যান্ডে দলের সাথে রাখা হয়। শিক্ষামূলক সফর হিসেবে দলের সাথে যুক্ত হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে দলের একাধিক ব্যাটারের ইনজুরির কারণে বাধ্য হয়ে আনকোরা শান্তকে টেস্টে অভিষেক করাতে হয়! নানান সময়ে টিম ম্যানেজমেন্ট ও বিসিবিকে তাঁর প্রতি অগাধ আস্থা রাখতে দেখা গেছে।

ঘরোয়া ক্রিকেট টুর্নামেন্টে বিসিবি ঘোষিত বিভিন্ন দলে তাকে অধিনায়কত্ব দেওয়ার ঘটনাবলি তাঁকে নিয়ে বিসিবির ভবিষ্যতচিন্তারই সুস্পষ্ট প্রতিফলন! কিন্তু ব্যাটার শান্ত আসলেই কি বাংলাদেশের জন্য ‘দ্য বিং থিং’ হওয়ার সামর্থ্য বা যোগ্যতা রাখেন?

ads

শান্ত বাংলাদেশ টেস্ট দলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মোটামুটি স্থায়ী, বিধায় সেটা নিয়ে একটু গভীরে আলোচনা করাই যায়।শান্ত বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে ৩২ ইনিংসে ব্যাট করে ২৬.৭ গড়ে ৮২৮ রান করেন, যেখানে মাত্র চারটি ইনিংসে ৫০ অতিক্রম করেছেন,এবং দু’টি পঞ্চাশোর্ধ ইনিংসকে শতকে রূপান্তরিত করতে পেরেছেন। যা তার বড় ইনিংস খেলার সামর্থ্যকে সমর্থন করলেও ধারাবাহিকতার জায়গায় একটা বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখেই যায়।

ওয়ানডেতে ৮ ম্যাচে ৯৩ রান করা, আর টি-টোয়েন্টিতে জাতীয় দলের হয়ে ৬ ম্যাচে ১০০ স্ট্রাইকরেটে ব্যাট করা শান্তকে নিয়ে বিশদভাবে আলোচনার প্রয়োজন বলে মনে করছি না। আচ্ছা,আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পাশাপাশি শান্ত ঘরোয়া ক্রিকেটে কেমন করেছেন,সেটা চলুন তো একটু সংক্ষিপ্তাকারে দেখে আসি।

  • প্রথম শ্রেণি: ১০২ ইনিংসে ৩৮৮৩ রান গড় ৪০.৪৪, ১০ টি সেঞ্চুরি ও ১৮ টি হাফ সেঞ্চুরি
  • লিস্ট এ: ১০৮ ইনিংসে ৩৪৭৪ রান, গড় ৩৬.৯৫, ৬ টি সেঞ্চুরি ও ১৭ টি হাফ সেঞ্চুরি
  • টি-টোয়েন্টি: ৮৬ ইনিংসে ১৮২৪ রান, গড় ২৩.০৮, ২ টি সেঞ্চুরি ও ৬ টি হাফ সেঞ্চুরি (স্ট্রাইক রেট ১২২.৭৪)

শান্তর ১০২ টি প্রথম শ্রেণির ইনিংসের ১০ টি এবং লিস্টে তে ১০৮ টি ইনিংসের ছয়টি সেঞ্চুরিই প্রমাণ করে বড় ইনিংস খেলার সক্ষমতা থাকলেও ধারাবাহিকতার ঘাটতি তাঁর ক্ষুদ্র ক্রিকেট জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আর বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের মান বিবেচনায় ফার্স্ট ক্লাস ও লিস্ট এ-তে যথাক্রমে ৪০ ও ৩৭ এর মতোন গড় আহামরী কিছু নয়, বরং গড়পরতাই বলা উচিত। তবু কেন এত সুযোগ পান শান্ত?

২০২০ সালের কারোনাকালে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে শান্ত আলোচিত ছিলেন। সেই টুর্নামেন্টে ইনিংসের শুরু থেকেই সপাটে ব্যাট চালাতেন শান্ত। বিশেষত পাওয়ারপ্লেতে স্পিন বোলার আনলে আগ্রাসী ভঙ্গিতে বলকে বারবার পাঠাতেন বাউন্ডারির বাইরে অনায়াসেই।  বাংলাদেশের একজন ব্যাটার আরামসে নিয়মিত এত ছক্কা মারতে পারে! বিষয়টা ছিল অবাক করার মতই, তার ওপর তাঁর আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ছিল সামান্যই। এই চিত্তাকর্ষক ব্যাটিংয়ের জেরটা নিশ্চয়ই নেটেও থাকে। তাই কোচ কিংবা সতীর্থরা শান্তকে আগলে রাখেন।

তাহলে কি শান্ত টেস্ট বা ওয়ানডের চেয়ে টি-টোয়েন্টিতে বেশি কার্যকর? না, একদমই না।

নাজমুল হোসেন শান্তর টেস্ট ক্রিকেটে অধারাবাহিকতার কারণ যতোটা না মানসিক, তার চেয়েও অনেক বেশি টেকনিক্যাল। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সদ্যসমাপ্ত সিরিজেই দেখুন না, দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে ইনসুইং করা বলের বিপক্ষে ড্রাইভ করতে গিয়ে কিভাবে ব্যাট-পায়ের মাঝে এতগাদা ফাঁকা জায়গা রেখে বোল্ড হন। প্রথম টেস্টের মতোই কিভাবে ঘনঘন অফস্ট্যাম্পের বাইরের বলে খোঁচা মেরে বলকে কিপার বা স্লিপের কাছে পাঠিয়ে দেন। আর যে কোন টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে শান্ত স্পিনের বিরুদ্ধে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি আগ্রাসী হতে চেষ্টা করেন।

যার ব্যাখ্যায় একবার বলেছেন, এ ধরনের উইকেটে আক্রমণাত্মক না করে কেবল টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। আমার ধারণা সেটার কারণ, শান্তর নিজের ডিফেন্সিভ টেকনিকে গলদ বা টার্নিং বলে নিজের ডিফেন্সের উপর অনাস্থা। দৃশ্যমান ব্যাটিং টেকনিকের এত দুর্বলতা নিয়ে টেস্ট ম্যাচের তিন নম্বরের মতোন পজিশনে তিনি দীর্ঘসময় জাতীয় দলে টিকে যেতে পারবেন, তা প্রায় অসম্ভবই।

তবে কি সব ফরম্যাটে শান্তর ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় কারণ,সুইং বা টার্নের বিপক্ষে টেকনিক্যাল ইস্যুটাই? না, একদমই নয়।শান্তর উল্লেখিত সমস্যাটা হয়তো নেটে কোচদের সাথে কাজ করে এক সময় মূল ম্যাচে কাটিয়ে উঠবেন, কিন্তু শান্তর আরো সমস্যা আছে।

২০২২ সালের বিপিএলের ফাইনালের ম্যাচের কথা মনে আছে? শেষ তিন ওভারের কথা একটু স্মরণ করি।  ১৭ ওভারের প্রথম বলে ডোয়াইন ব্রাভো আউট হলেন, ফরচুন বরিশালের রান ১৩৪-৬; হাতে তখনো চার উইকেট। দরকার ১৮ বলে ১৭ রান।স্ট্রাইকে আসা নতুন ব্যাটার হৃদয় প্রথম বলে সিঙ্গেল নেওয়ার পর দরকারটা দাঁড়ায়, ১৭ বলে ১৬ রান। আধুনিক টি-টোয়েন্টির প্রেক্ষাপটে যে কোন উইকেটেই সহজসাধ্য ব্যাপারই। তার ওপর প্রতিপক্ষ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের ইমরুল কায়েস সিঙ্গেল নেওয়ার জন্য যথেষ্ট জায়গা রেখেছিলেন। আমার এখনও ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট ওই ওভারটা চোখের সামনে আবছা ভাসে।

শান্ত ওভারের তৃতীয় বল খেললেন, চতুর্থ বল খেললেন। কোনো রান নিতে পারলেন না। নিতে পারলেন না বললে ভুল হবে,তার আসলে নেওয়ার রান কোনো প্রয়াসই ছিল না। উইকেটে শান্ত আহামরি টার্ন করাচ্ছিলেন না নারাইন, অথচ শান্ত যেন বনে গেছিলেন টেইলএন্ডার; যে কোনোভাবে নারাইনের বলে কোনোভাবে ব্যাট ছোঁয়াতে পারলেই খুশি। কার্যত তার ভেতর রান নেওয়ার কোনো তাড়াই ছিল না, বরং ডিফেন্সিভ টেকনিকেই ম্যাচের ১৮ তম ওভারে ব্যাট করলেন তিনি

পরবর্তী বলে নারাইন কোনোভাবে সিঙ্গেল নিতে পারলেন, কিন্তু ব্যাটিং যে খুব কনভিন্সিং ছিল তা নয়, বরং একজন জেনুইন টপ অর্ডার ব্যাটার যেভাবে ব্যাটিং উইকেটে যথেষ্ট ভয় নিয়ে ধুকেধুকে ১৮ তম ওভারে ব্যাট করছিলেন, তা ছিল চরম দৃষ্টকটু।

মনে আছে, সর্বশেষ নিউজিল্যান্ড সিরিজে তৃতীয় টি-টোয়েন্টির কথা? বাংলাদেশের টার্গেট ছিল ১০ ওভারে ১৪২ রান।দীর্ঘদিন পর টি-টোয়েন্টি ম্যাচে সুযোগ পেয়েছিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। ওই ম্যাচে সিরিজে প্রথমবার সুযোগ পাওয়া লেগ স্পিনার নাথান অ্যাস্টল এলেন। শান্তকে করলেন র‍্যাংক হাফ ট্রাকার শর্ট ডেলিভারি। ক্রিজে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শান্তর না ছিল কোন ফিট মুভমেন্ট, না ছিল বলের লাইনে যাওয়ার কোন প্রয়াস।

এত বাজে ডেলিভারি পেয়ে তিনি দ্রুত ব্যাকফুটে গিয়ে পুল করতে গেলেন। কিন্তু যেভাবে বোল্ড হয়ে ফিরে গেলেন তাতে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ছিল, শর্ট বলটা তিনি আশা করেননি এবং বলের লাইনে যেতে যেটুকু সময় নেবেন, তার আগেই বোল্ড।আসলে একজন ব্যাটার যখন এতোটা নেগেটিভ মাইন্ডসেট নিয়ে ব্যাট করেন, তখন তার পা চলবে না, বলের লাইনে সময়মতো যেতে পারবেন না, এটাই তো স্বাভাবিক। এই শান্তকেই কিন্তু আমি বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে স্পিনারদের এসব বলকে অনায়াসে মুহূর্তের মাঝে বাউন্ডারি ছাড়া করতে দেখেছি।

আমি কেবল শান্তর দু’টো ম্যাচের উদাহরণ দিলাম। তাঁর ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ম্যাচগুলোর দিকে তাকালে কনফিডেন্সের এই অভাব আরও বেশি দৃশ্যমান হবে বলেই বিশ্বাস। হয় তাঁর ব্যাট চলছে, পা চলছে না, বলের লাইনে যাচ্ছেন না,ব্যাট-প্যাডের মাঝে অনেক ফাঁকা জায়গা ইত্যাদি সেই পুরোনো কাসুন্দী।যাকে সোজা বাংলায় অনেকে বলবেন ‘হাঁটু কাঁপে’।

শান্তর দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরির কথা মনে আছে? মাহমুদউল্লাহর শেষ টেস্ট ম্যাচে বাংলাদেশ যখন প্রথম ইনিংসে ২৯২ রানের লিড পায়। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে যখন নামে, জিম্বাবুইয়ানরা বোলিং করছিলো ডিফেন্সিভ ধাঁচে। বড় লিড নেওয়া যতোটা দীর্ঘায়িত করা যায়, আর কি! শান্ত ১০৯ বলেই সেঞ্চুরি তুলে নেন, দাপুটে ঢঙে। অথচ প্রথম ইনিংসেও তিনি আউট হয়েছিলেন যথেষ্ট বাজেভাবে। একই ব্যাটারের কি অদ্ভুত দ্বৈতরূপ, তাই নাহ!

যে শান্ত আগেরবার বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে দেশীয় বোলারদের বিপক্ষে প্রবল দাপটের সঙ্গে ব্যাট চালাতেন, সেই শান্ত পরেরবার বিপিএলে যেন দ্রুত রান করাই ভুলে যান। যে শান্ত টেস্ট ম্যাচের প্রথম ইনিংসে চাপের মধ্যে ব্যাটিং করতে নেমে আউট হয়ে গিয়ে চাপকে আরও ঘনীভূত করেন, সেই শান্ত দ্বিতীয় ইনিংসে আয়েশি ভঙ্গিতে সেঞ্চুরি করেন। আবার যখন দল যখন টেস্টের চতুর্থ বা পঞ্চম দিনে দ্বিতীয় ইনিংসে লিডের পাহাড়ে চাপা পড়ে ,বা সার্ভাইভ করার দরকার পড়ে, তখন এলোমেলো শট খেলে আউট হয়ে যান কিংবা দ্রুত রান নিতে গিয়ে গড়বড় করে রান আউট হয়ে যান।

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়!’ নাজমুল হোসেন শান্ত যখন বড় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে খেলেন,নামজাদা বোলারদের মোকাবেলা করেন বা ম্যাচের মধ্যে বিরুদ্ধ কন্ডিশনে ব্যাট করেন, অনেক সময় এমনও মনে হয়,তিনি ব্যাট করা ভুলে গেছেন। অথচ তাঁর দু’টি টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরি দেখলে আপনার মনেই হবে, এমন একজন অসাধারণ অ্যাবিলিটির ক্রিকেটারই আমাদের জাতীয় বছরের পর বছর মিস করি।

গেম সিচুয়েশন, প্রতিপক্ষ,পরিপার্শ্ব ইত্যাদি খেলোয়াড় শান্তকে অনেক বেশিই প্রভাবিত করে। অনুকূল অবস্থায় তার ব্যাট যতোটাই ধারালো, প্রতিকূল অবস্থায় তা ততোটাই ভোতা। টেকনিক্যাল ইস্যুর পাশাপাশি শান্তর মানসিক এই দ্বৈত অবস্থা তাঁর ক্যারিয়ারকে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিসিবি যেহেতু শান্তর ওপর প্রচুর বিনিয়োগ করেছে, বিসিবির উচিত টেকনিক্যাল ফল্ট শোধরানোর পাশাপাশি মানসিকভাবে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটের জন্য তাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা।

দরকারে এসবের জন্য তাকে বিরতি দেওয়া, বিরতিতে তাঁর ইস্যুগুলো নিয়ে কাজ করা। না হলে তরুণ প্রতিভাকে দ্রুত জাতীয় দলে ডেকে খেলিয়ে খেলিয়ে তরুণ বয়সে অফফর্মের কারণে বাদ দিয়ে ভবিষ্যতে আর না ডাকার বাজে সংস্কৃতির বলি হতে পারেন নাজমুল হোসেন শান্তের মতোন প্রতিভাবান ব্যাটারও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link