More

Social Media

Light
Dark

যে ম্যাচ বদলে দিয়েছে ক্রিকেটকে

আরব আমিরাত দেশটা ক্রিকেটে বড় কোনো শক্তি নয়। বিশ্বকাপটাও খেলে না দলটা নিয়মিত। তবে, ক্রিকেটের সাথে তাঁদের সম্পর্কটা বেশ পুরনো। আর সেই সম্পর্কের সূত্রপাত হয় শারজাহ স্টেডিয়াম দিয়ে। হ্যাঁ, শারজাহ, লাখ স্মৃতি রোমন্থনের একটা মঞ্চ।

আর ক্রিকেটে শারজাহ’র এই জরুরি হয়ে ওঠার পেছনে বড় অবদান দুটি দলের – ভারত ও পাকিস্তান। ক্রিকেট বিশ্বে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই অন্যরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ক্রিকেটে অ্যাশেজ কিংবা ফুটবলে বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের এল ক্লাসিকো কিংবা আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের সুপার ক্লাসিকো’র মতই উত্তেজনাপূর্ন হয় এ দুই দলের প্রতিটি ম্যাচ।

দুই প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে এদের মধ্যকার যেকোন ম্যাচেই থাকে টান টান উত্তেজনা। খেলার মাঠ ছাপিয়ে যা আন্দোলিত করে পুরো দেশের মানুষকে। কখনো কখনো উত্তেজনা এতটাই তীব্র হয় যে, ম্যাচ নিয়ে কথা বলতে শোনা যায় বরং দুই দেশের বিধান সভার নেতাদেরকেও।

ads

একদিনের ক্রিকেটে এই দুই দলের সুপার ক্লাসিকো ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে মোট ১৩২ বার। ভারত বনাম পাকিস্তানের ১৩২ একদিনের ম্যাচের মাঝে ১২৮ ম্যাচে নির্ধারিত হয়েছে জয়-পরাজয়। যেখানে পাকিস্তানের একচ্ছত্র আধিপত্য দেখা যায়৷ পাকিস্তানের ৭৩ ম্যাচে জয়ের বিপরীতে ভারত জিতেছে ৫৫ ম্যাচে।

এই ১২৮ ম্যাচের মাঝে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওই শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। অথচ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার প্রথম যে ওয়ানডে ম্যাচ এই স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা ছিল নিতান্তেই একটি আন-অফিশিয়াল ম্যাচ। এই ম্যাচ পূর্ববর্তী ঘটনাচক্রও দারুণ রোমাঞ্চকর।

সেটা ছিল ১৯৮১ সালের তিন এপ্রিল। এই ম্যাচের আয়োজক ছিলেন বুখাতির গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং টেন স্পোর্টস চ্যানেলের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল রহমান বুখাতির। আব্দুল রহমান বুখাতির তার প্রাথমিক জীবন কাটান পাকিস্তানে। পাকিস্তানেই তিনি তাঁর শিক্ষাজীবন শেষ করেন। তিনি পাকিস্তানে থাকাকালীন ক্রিকেট খেলার প্রতি মনোযোগী হন।

তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে ফেরার পর ১৯৭৪ সালে শারজাহ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেন। এই অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রনে ১৯৭৬ সালে স্থানীয় দলের বিপক্ষে পাকিস্তান একাদশ ম্যাচ খেলে যায়। মূলত সেটা ছিল পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স (পিআইএ) দল। দলে সাতজন টেস্ট খেলোয়াড় ছিলেন। ছিলেন ইমরান খান, মাজিদ খান কিংবা ওয়াসিম বারির মত তারকারা।

১৯৭৮ সালে আরব আমিরাতের স্থানীয় ক্রিকেটারদের নিয়ে গঠিত একটা দল পাকিস্তান গিয়ে ঘরোয়া লিগের দলগুলোর সাথে নয়টি ম্যাচ খেলে। আস্তে আস্তে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে পাকিস্তানের ক্রিকেট সম্পর্কটা মজবুত হয়।

তবে, নিজেদের অবকাঠামো নিয়ে আলোচনা বাড়াতে চাচ্ছিল আমিরাত কর্তৃপক্ষ। শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে তোলার জন্য দরকার ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ আয়োজনের। সেসময় এই উপমহাদেশে ভারত এবং পাকিস্তান ছিল ক্রিকেটের পরাশক্তি। তাই বুখাতির পরিকল্পনা করেন ভারত একাদশ বনাম পাকিস্তান একাদশের একটি চ্যারিটি ম্যাচ আয়োজনের।

আইডিয়াটা আসিফ ইকবালকে দিয়েছিলেন বুখাতির। তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘তুমি আমাকে একটা ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের ব্যবস্থা করে দাও, ৫০ হাজার ডলারের বাজি ধরতে পারি – এখান থেকে লাভ হবেই।’

তবে, যখন ম্যাচ আয়োজনের পরিকল্পনা করা হয়, তখনও স্টেডিয়ামই নির্মান হয়নি। ১৯৮০ সালের অক্টোবরে বুখাতির সাহেব আসিফ ইকবালকে নিয়ে যান শারজাহ স্পোর্টস ক্লাবের সামনে একটা দুই লাখ স্কয়ার ফিটের জায়গা দেখাতে। মূলত ফুটবলের জন্য স্টেডিয়ামটা বানানোর পরিকল্পনা হলেও সেখানেই ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট লড়াইয়ের ছক আঁকা শুরু হয়।

পরিকল্পনাটা নি:সন্দেহে দুর্দান্ত হলেও সে সময়ে এমন একটি ম্যাচের জন্য এই দুই দলের খেলোয়াড়দের রাজি করানো ছিল অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এই বড় কাজটি করে দিয়েছিলেন স্বয়ং বুখাতির এর সহকর্মী এবং পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার আসিফ ইকবাল।

খেলোয়াড়দের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য বুখাতির ২ লাখ ডলার প্রাইজমানির একটি ম্যাচের ঘোষণা দেন। যে ম্যাচটিই শেষ পর্যন্ত শারজায় অনুষ্ঠিত হওয়া ভারত পাকিস্তানের ম্যাচ হিসেবে স্বীকৃত। অনেক জল্পনা কল্পনা ও শঙ্কা শেষে ম্যাচটা সফল ভাবেই সম্পন্ন হয়।

যদিও, সেখানে ভারত ও পাকিস্তান দল নিজেদের নামে খেলেনি। ভারতীয় দলটা ছিল সুনীল গাভাস্কার একাদশ। আর পাকিস্তান খেলে জাভেদ মিয়াঁদাদ একাদশ নামে। ম্যাচটি দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী এর মাঝে অনুষ্ঠিত হলেও বুখাতির ঐ ম্যাচে দর্শক আগমন নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত ছিলেন। তাই নামমাত্র ২৫ দিরহাম মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল সেই ম্যাচের টিকিটের দাম।

টিকিটগুলো বিক্রি করা হয়েছিল স্থানীয় পাকিস্তানি এবং ভারতীয় রেস্টুরেন্টগুলোতে। জাঁকজমকপূর্ণভাবে ম্যাচটির বিজ্ঞাপন করায় শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি দেখতে বিভিন্ন দেশ থেকে ৮০০০ দর্শনার্থী এসেছিলেন। বুখাতির গলফ খেলায় পারদর্শী হওয়ায় দর্শনার্থী গুলো বেশিরভাগই গলফ খেলুড়ে দেশের ছিল।

ম্যাচটি যখন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তখন শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে মাটির পিচ না থাকায় ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করা পিচে। ম্যাচটিতে ভারত একাদশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুনীল গাভাষ্কার এবং পাকিস্তান একাদশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাভেদ মিয়াদাদ। আসিফ ইকবাল, ইমরান খান, কপিল দেব কিংবা সন্দীপ পাতিল – দুই দলে তারকার কোনো কমতি ছিল না।

ম্যাচটিতে প্রথমে ব্যাট করে সুনীল গাভাষ্কার একাদশ মাত্র ১৩৯ রান সংগ্রহ করেছিল। জবাবে ব্যাট করতে নেমে খুব সহজেই ম্যাচটিতে জয় পেয়েছিল জাভেদ মিয়াঁদাদ একাদশ। ঐ ম্যাচে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহ করায় পুরষ্কার হিসেবে একটি টেলিভিশন পেয়েছিলেন সুনীল গাভাষ্কার। ম্যাচ সেরা হন পাকিস্তানের তসলিম আরিফ।

পরে শারজাহতে মোট ২৪৫টি একদিনের ম্যাচ আয়োজিত হলেও এই ম্যাচটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে সব সময়। কারণ, উপমহাদেশ তো বটেই বিশ্ব ক্রিকেটেরই ভোল পাল্টে দিয়েছিল আরব আমিরাতের এই স্টেডিয়াম পরের বছর আবার দু’বার শারজাহতে মুখোমুখি হয় ভারত পাকিস্তান। অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড থেকেও দল আসতে শুরু করে।

কাছাকাছি সময় গঠন করা এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এসিসি)। সংস্থাটি ১৯৮৪ সালে এশিয়া কাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় শারজাহতে। সেই আসরে খেলে পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলঙ্কা। ১৯৮৪ সালের ছয় এপ্রিল শারজাহতে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। খেলে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। বাকিটা ইতিহাস!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link