More

Social Media

Light
Dark

হার না মানা আগ্রাসী সৈনিক

২০১৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। শেষ ১০ বলে ভারতের দরকার ২৫ রান, স্ট্রাইকে ছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। লকি ফার্গুসনের বল মিস হিটে অন সাইডে গেলে দুই রানের জন্য দৌড় দেন ধোনি। মিড অনের কাছাকাছি থেকে দৌড়ে এসে ডিরেক্ট থ্রোয়ে স্টাম্প ভাঙলেন গাপটিল। কমেন্ট্রি বক্স থেকে ইয়ান স্মিথের কণ্ঠে ‘Oh direct hit, is this the world cup?’. সেদিন ডিরেক্ট থ্রোয়ে ধোনিকে ফিরিয়ে নিউজিল্যান্ডের ফাইনালে যাওয়াটা একপ্রকার নিশ্চিত করেছিলেন মার্টিন গাপটিল।

পুরো টুর্নামেন্টে ব্যাট হাতে অনেকটাই ব্যর্থ গাপটিল সেই এক রান আউটে বনে গেলেন নিউজিল্যান্ডের হিরো। অবশ্য নাটকীয় ফাইনালে ‘বাউন্ডারি কাউন্টে’ শিরোপা জয় পায় ইংলিশরা। কিন্তু ভারতীয় সমর্থকদের স্বপ্নভঙ্গ হওয়া গাপটিলের সেই ডিরেক্ট থ্রো’য়ে স্টাম্প ভাঙা ২০১৯ বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা এক মুহূর্ত!

বাঁ পায়ে মাত্র দু’ আঙ্গুল নিয়েও কি অসাধারণ ফিল্ডিং করেন তিনি! নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে ‘সেফ হ্যান্ডস’ শব্দটাও তাঁকেই বেশি মানায়। ক্যাচ কিংবা ফিল্ডিং মিস ব্যাপাটা বড্ড বেমানান গাপটিলের সাথে। দুর্দান্ত ফিল্ডিং আর ওপেনিংয়ে তাঁর আগ্রাসী ব্যাটিং – সব মিলিয়ে রঙিন জার্সিতে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ তিনি!

ads

ডিজঅ্যাবিলিটির ব্যাপারটা কখনো মাথায়ই নেননি গাপটিল। পায়ের আঙুল ছিন্ন হওয়ার পর ডাক্তার বলেছিলেন তিনি ঠিকভাবে দৌড়াতে পারবেন না! সেই কথায় এক গাল হেসে ব্যাপারটা স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এরপর ক্রিকেট মাঠে তাঁর দৌড় কিংবা অসাধারণ ফিল্ডিংয়ে ক্রিকেট ভক্তরা কখনো বুঝতেই পারেনি বাঁ পায়ের তিনটি আঙ্গুল নেই গাপটিলের।

অবশ্য এই আঙুল না থাকার হৃদয়বিদারক ঘটনাটা তাঁর ছেলেবেলার। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ফর্ক-লিফটে দূর্ঘটনা বশত বাঁ পায়ের তিন আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় গাপটিলের। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করলেও জোড়া লাগাতে পারেনি ছিন্ন হওয়া সেই আঙ্গুলগুলো। এরপর থেকে গাপটিলের নামের পাশে যুক্ত হয় ‘টু টয়েস’ বা দুই পদাঙ্গুল! অবশ্য এই নিয়ে কখনো আক্ষেপ বা নিজেকে কারোর চেয়ে কম ভাবেননি তিনি। জীবন যুদ্ধে হার মানেননি তিনি। পিছু না হটে নিজের স্বপ্নকে পুঁজি করে ছুঁটেছেন ক্যারিয়ার গড়তে।

২০০৬ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে অকল্যান্ডের হয়ে লিস্ট এ তে অভিষিক্ত হন তিনি। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে অভিষেকটাও হয় একই বছর অকল্যান্ড এসেসের হয়ে। ওই বছরই অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের হয়ে খেলেন তিনি। তিন বছর ঘরোয়া ক্রিকেটে দাপিয়ে বেড়ানোর পর ২০০৯ সালে পৌঁছান স্বপ্নের দোরগোড়ায়। ডাক পেলেন জাতীয় দলে!

ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে খুব একটা ধারাবাহিক ছিলেন না গাপটিল। তবে, ২০০৭-০৮ মৌসুমে লিস্ট এ তে ১১ ম্যাচে প্রায় ৬০ গড়ে ৫৯৬ রান করে সবার নজরকাঁড়েন তিনি। সেখান থেকে ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ড এ দলের হয়ে সুযোগ পান ভারত সফরে। সেখানে অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে ডাক পান জাতীয় দলে। মূলত ১২৪ ও ৫৮ রানের অনবদ্য দুই ইনিংসই মূলত তাঁকে টেনে নেয় জাতীয় দলে।

ওয়ানডেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচেই সেঞ্চুরি করে জাতীয় দলে পদার্পণটা স্মরণীয় করে রাখেন গাপটিল। ইডেন পার্কে বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ার দিনে নিউজিল্যান্ডের হয়ে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডে অভিষেকে গাপটিলের সেঞ্চুরিটা অবশ্য বৃথা যায়!

ওই বছরই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ও ভারতের বিপক্ষে টেস্টে অভিষিক্ত হন তিনি। ওয়ানডেতে বেশ ভালো পারফরম করলেও সাদা পোশাকে ঠিক নিজেকে প্রমাণ করতে পারছিলেন না তিনি। ২০১০ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে হ্যামিল্টনে ১৮৯ ও পরের বছর ২০১১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১০৯ রানের ইনিংস ছাড়া টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম চার বছরে দেখা পাননি আর কোনো সেঞ্চুরির!

ঘরোয়া ক্রিকেটে ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অবদানের জন্য ২০১১ সালে জেতেন রিচার্ড হ্যাডলি মেডেল। পরের বছর ২০১২ সালে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটার অব দ্যা ইয়ার নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৩ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডেতে লর্ডসে খেলেন অপরাজিত শতরানের ইনিংস।

পরের ম্যাচেই রোজ বোলে আবারো ব্যাট হাতে ১৫৫ বলে ১৮৯ রানের তান্ডবময় এক ইনিংস খেলেন তিনি! মাত্র ১১ রানের জন্য দেখা পাননি ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির। তবে নিউজিল্যান্ডের হয়ে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটি করেছিলেন নিজের নামের পাশে।

ডাবল সেঞ্চুরির সেই আক্ষেপটা ঘুচিয়েছিলেন ২০১৫ বিশ্বকাপে। ওই বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে গাপটিলের রেকর্ড গড়া ডাবল সেঞ্চুরি নিশ্চয়ই ভুলেননি? ওপেনিংয়ে নেমে ১৬৩ বলে ২৩৭ রানের সেই মহাকাব্যিই ইনিংস! পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি ছাড়াও নিউজিল্যান্ডের হয়ে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে করেন ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড! তাঁর দাপুটে ইনিংসেই সেবার ফাইনালে পৌঁছায় ব্ল্যাকক্যাপসরা। প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপের মঞ্চে ডাবল সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন তিনি। ওয়ানডে ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোরটিও আছে তাঁরই নামে।

২০১৫ সালেই তিনি টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ সেঞ্চুরি করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৫৮ রানের সেই ইনিংসের পর আর দেখা পাননি সেঞ্চুরির। অবশ্য ক্যারিয়ারটাও আর দীর্ঘ হয়নি তাঁর।

অধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে ভারতের বিপক্ষে সিরিজের পর আর সাদা পোশাকে দলে ফিরতে পারেননি গাপটিল। সবশেষ ২০১৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘টেস্ট ক্রিকেটে এখনো নিউজিল্যান্ডকে অনেক কিছুই দেওয়ার আছে তার।’ কিন্তু বাদ পড়ার পাঁচ বছরেও টেস্ট দলের আর ফিরতে পারেননি এই কিউই ওপেনার।

রঙিন পোশাকে বরাবরই তিনি ওপেনিংয়ে নিউজিল্যান্ডের এক ভরসার নাম। টি-টোয়েন্টিতে তাঁর বিধ্বংসী ব্যাটিং প্রায়সই বিপাকে ফেলেছে প্রতিপক্ষের বোলারদের। নিজের দিনে তিনি কতটা ভয়ংকর হতে পারেন সেটা তাঁর টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারেই স্পষ্ট। এখন পর্যন্ত ১০২ ম্যাচে ৩২ গড় আর ১৩৭ স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন প্রায় ৩ হাজারের কাছাকাছি! রানের দিক থেকে টি-টোয়েন্টিতে আছেন দ্বিতীয়তে। গড় আর স্ট্রাইক রেটই প্রমাণ করে ওপেনিংয়ে তিনি কতটা ভয়ংকর!

আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও ওপেনিংয়ে নিউজিল্যান্ডের ভরসা থাকবেন তিনি। বয়সটা এখন কাটায় কাটায় ৩৫! ক্যারিয়ারের প্রায় শেষদিকে থাকা গাপটিলের সাদা পোশাকে সুযোগের সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীন। তবে, রঙিন জার্সিতে ইতোমধ্যেই নিজেকে নিয়ে গেছেন সেরাদের কাতারে। ওয়ার্ল্ড ক্লাস ফিল্ডিং আর ওপেনিংয়ে আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে হয়তো আরো বছর কয়েক মাঠ মাতাবেন জীবন যুদ্ধে হার না মানা মার্টিন গাপটিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link