More

Social Media

Light
Dark

নরক থেকে স্বপ্নের রঙ্গশালায়

সাও পাওলোর অসাস্কো অঞ্চলের একটি বস্তির নাম হল ইনফারনিনহো, এই পর্তুগিজ শব্দের বাংলা অনুবাদ হল নরক। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে ড্রাগ ডিলার থেকে শুরু করে বহু অপরাধীই জায়গাটাকে নিজেদের আড্ডাখানা বানিয়েছে, খুন-রাহাজানি তাই এখানকার দৈনন্দিন ব্যাপার। এমন এক ভয়ংকর জায়গায় সকালে ঘর থেকে বের হয়ে রাতে আপনি জীবিত অবস্থায় ঘরে ফিরতে পারবেন কিনা সেই নিশ্চয়টা আপনাকে কেউ দিবে না, নরক নামটা তাই বেশ মানানসই বটে।

ব্রাজিলের এই নরকেই টিকে থেকে বড় হয়েছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নতুন দলে ভেড়ানো ফুটবলার অ্যান্টনি। সম্প্রতি আয়াক্স অ্যামস্টারডাম থেকে ৮১.৩ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে তিনি ওল্ড ট্রাফোর্ডে যোগ দিয়েছেন।

প্রিমিয়ার লিগে এসে এই বিশাল ট্রান্সফার ফির চাপ সামলে ঠিকঠাক নিজের খেলাটা খেলতে পারবেন তো? অনেকেই এমন প্রশ্ন তুলছেন। তবে সাত ঘাটের পানি খেয়ে বেড়ে ওঠা এই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার, জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য যাকে দারিদ্র ও সহিংসতার সাথে লড়াই করতে হয়েছে তিনি চাপ টাপের কথাকে ক্যারিয়ারে কখনোই পাত্তা দেননি।

ads

যখনই  কেউ তাঁকে এই প্রশ্ন করেছে তিনি বলেছেন, ‘আসল চাপ ছিল যখন আমি বস্তিতে থাকতাম, সকাল নয়টায় স্কুলের জন্য ঘর থেকে বের হওয়ার পর আবার রাত নয়টার আগে আমার কপালে কোন খাবার জুটবে কিনা যখন আমাকে এই চিন্তা করতে হতো সেটা আমার জন্য ছিল চাপের ব্যাপার। আর বাদবাকি সব হল মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপার যা আমরা সবাই কম বেশি করতে পারি।’

নরক থেকে উঠে আসা এই ফুটবলার তাই ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় মাটিতে পা রেখেই চলেছেন। শৈশবের দুর্বিষহ দিনগুলো তাকে বিনীত হতে শিখিয়েছে।

২০১৯ সালে সাও পাওলোর মূল দলের সাথে প্রাক মৌসুম সফরে যাওয়ার সুযোগ ছিল অ্যান্টনির। সেবার আমেরিকায় গেলে তিনি আয়াক্স ও আইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুটের মত ইউরোপিয়ান দলের বিপক্ষে খেলার সুযোগ পেতেন। কিন্তু ম্যানেজমেন্টের পরামর্শ পাওয়ার পর তিনি এই ট্যুর বাদ দিয়ে ক্লাবটির অনূর্ধ-২০ দলের হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নেন যা তাঁর ক্যারিয়ারের গতিপথ পাল্টে দেয়।

কয়েক মাস যাবত মূল দলের সাথে অনুশীলন করলেও তরুণ এই ফুটবলারকে যখন বলা হয় যে প্রাক মৌসুম সফরে না গিয়ে বরং অনূর্ধ্ব- ২০ দলের হয়ে কোপা সাও পাওলোতে খেলার জন্য তিনি এক কথায় রাজি হয়ে যান। এই প্রতিযোগিতায় মূলত ব্রাজিলের ক্লাবগুলোর অনূর্ধ্ব-২০ দলগুলো খেলে থাকে।

ব্রাজিলের এই যুব টুর্নামেন্টে খেলে অ্যান্টনি ছয়টি অ্যাসিস্টের পাশাপাশি চারটি গোল করেন আর এখান থেকেই বিশ্ব ফুটবল নতুন এক ব্রাজিলিয়ান তারকার আগমনী বার্তা পায়। টুর্নামেন্ট শেষে অ্যান্থনি যখন সাও পাওলোর মূল দলে ফিরে আসেন তখন দলে তার ওজন অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। সতীর্থ বা কোচ কেউই আর তাকে শুধু সম্ভবনাময় এক ফুটবলার হিসেবে বিবেচনা করে না, তারা তাকে যথেষ্ট সমীহ করে কারণ তাঁদের আর বুঝতে বাকি নেই যে এই ছেলেটা অন্য ধাতুতে গড়া, বড় ফুটবলার না হয়ে দমবার পাত্র এ নয়।

এই সম্পর্কে সাও পাওলোর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আলেজান্দ্রে পাসসারো বিবিসি স্পোর্টসকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে, বলেন, ‘এটা তাঁর ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। অন্য তরুণ ফুটবলাররা যেখানে যুব দলে ফিরে যেতে আপত্তি করে এই ভেবে যে এটা তাদের ক্যারিয়ারকে পিছিয়ে দিবে, সে কোন বাক্য ব্যায় না করেই রাজি হয়ে যায়। এই কারণে অবশ্য প্রি সিজন ট্যুরটায় সে যেতে পারে নি, অন্য কোন খেলোয়াড় হলে যা মিস করতে চাইত না। সে শুরু থেকেই বিনীত স্বভাবের ছিল। তার কাছে এই ধরণের ট্যুরে যাওয়ার চাইতে নিজের খেলায় উন্নতি করাই বেশি প্রাধান্য পায়। সেই মৌসুমে সে বেশ ভাল পারফর্মেন্স দেখায় এবং আজকে যাকে নিয়ে আমরা এতো আলোচনা করছি সেই খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে তুলে ধরে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিছুদিন পরেই আয়াক্স তাঁর ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়। ২০১৮ সালে অ্যান্থনিকে দলে ভেড়ানোর জন্য ক্লাবটি ৩ মিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাব দিয়েছিল আর এবার তাকে অ্যামস্টারড্যামে নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা এর থেকেও অনেক বেশি অর্থ খরচ করতে প্রস্তুত ছিল। ২০২০ এর শুরুর দিকে তাকে আমরা বিক্রি করে দেই তবে তার চুক্তির মধ্যে পরবর্তী দলবদল থেকে পাওয়া লাভের ২০ শতাংশ আমরা পাব এমন শর্ত জুড়ে দেই কারণ আমরা জানতাম যে সে আরো উন্নতি করবে।’

পাসসারো যে অ্যান্থনির ব্যাপারে ঠিক অনুমান করেছিলেন তা তো আজ প্রমানিত। আয়াক্সে গিয়ে শুরু থেকেই ভাল খেলা এই ফুটবলার দুই মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৪৭ গোল করেছেন যা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ৮১.৩ মিলিয়ন পাউন্ড দাম দিয়ে এই খেলোয়াড়কে দলে ভেড়ানোর আস্থা দিয়েছে। চুক্তির শর্ত পূরণ সাপেক্ষে আরও ৪.২৫ মিলিয়ন পাউন্ড যোগ হয়ে দলবদলের খরচটা ৮৬ মিলিয়ন পাউন্ডে গিয়ে ঠেকতে পারে।

ম্যানচেস্টার সিটির জ্যাক গ্রিলিশ, চেলসির লুকাকু এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পগবার পর এই ২২ বছর বয়সী ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার হলেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের চতুর্থ সর্বোচ্চ দামি খেলোয়াড়। আমেরিকার প্রি সিজন ট্যুর বাদ দিয়ে আরও বেশি ফুটবল খেলার জন্য তিনি যখন যুব টুর্নামেন্টটিতে খেলছিলেন তখন বোধয় তিনি এমনটি হবে কল্পনাও করেননি।

ক্যারিয়ারে তিনি যতই উন্নতি করুণ বস্তিতে কাটানো নারকীয় দিনগুলো তিনি কখনো ভুলে যাননি, আর ভুলে যাননি তার কাছের মানুষদের যারা তাকে সহযোগিতা করেছে এতদূর আসার ক্ষেত্রে। এই সম্পর্কে পাসসারো বলেন, ‘সাও পাওলো তে থাকাকালীন সময় আমরা যখনই তার চুক্তি নবায়ন করেছি প্রত্যেকবার চুক্তি সই করার দিন সে পরিবারের সকলকে নিয়ে আসতো। তার মা, বাবা, ভাই, বোন কেউ বাদ পড়ত না, পরিবার ছিল তাঁর সব কিছু।’

কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে অ্যান্টনি নিজের স্বাস্থ্যের উন্নতির দিকে নজর দেন। এসময় তিনি নিজের মাংসপেশি বিল্ড আপ করেন যা তাকে এখন শারীরিকভাবে একজন শক্তিশালী ফুটবলার হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। এছাড়া তার ড্রিবলিং দক্ষতা এবং গতি তো আছেই।

ব্রাজিল জাতীয় দলের ম্যানেজার টিটে তার খেলায় বেশ মুগ্ধ, কাতার বিশ্বকাপগামী ব্রাজিল জাতীয় দলে যে তিনি থাকছেন তা প্রায় নিশ্চিত। তবে শুধু সেলেকাউদের বসই নন তার পায়ের কারুকাজ এবং গতি মন জয় করে নিয়েছে পিএসজিতে খেলা ব্রাজিলিয়াল তারকা ফুটবলার নেইমারের। দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের এক খেলা চলাকালীন সময় অ্যান্থনিকে আরও বেশি পাস দিয়ে বলায় নেইমার বলেন, ‘না, তাঁকে ড্রিবলিং করতে দাও, তাঁকে নিজের মত খেলতে দাও।’

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে এরিক টেন হাগের সাথে পুনর্মিলন হতে যাচ্ছে অ্যান্টনির, টেন হাগ আয়াক্সে থাকাকালীন সময় এই দুই জন একসাথে কাজ করেছিলেন। ব্রাজিলিয়ান এই উইংগার তার দুর্ধর্ষ ফিনিসার হওয়ার পুরো কৃতিত্ব দেন ডাচ এই ম্যানেজারকে তিনি বলেন যে টেন হ্যাগ তাঁকে আমূলে বদলে দিয়েছে।

তবে শুধু টেন হাগ নয় ব্রাজিলিয়ান এই ফুটবলারের সাথে যারাই কাজ করেছেন তাঁদের কেউই নাকি এই ফুটবলারকে দল থেকে হারাতে চান না, এমনটাই মত সাও পাওলোর এক্সজিকিউটিভ ডিরেক্টর আলেজান্দ্রে পাসসারোর।

তিনি বলেন, ‘মনে হতেই পারে যে ২২ বছর বয়সী এই ফুটবলারের জীবনে দ্রুত সব ঘটনা ঘটছে এবং তার তেমন কোন অভিজ্ঞতা নেই। তবে আমি হলফ করে বলতে পারি যে তার সাথে যে সকল কোচ কাজ করেছে তাদের কেউই তাকে যে কোন মূল্যে হারাতে চাননি। টেন হাগ তো আছেই তবে ব্রাজিলের অন্যান্য কোচ যারা তার সাথে কাজ করেছেন যেমন আন্দ্রে জার্দিন এবং টিটেও একই মনভাব পোষণ করেন।’

‘তারা অ্যান্থনির পরিশ্রম, প্রতিভা এবং বল পায়ে তার কারুকাজ সম্পর্কে অবগত তাই তারা তাকে এতো মূল্যায়ন করে। দলের প্রয়োজনের সময় তার উপর আপনি আস্থা রাখতে পারেন যে সে পারফর্ম করবে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডর মত দলের তাঁর পেছনে এতো টাকা খরচ করাটা আপনার কাছে অবান্তর মনে হতেই পারে, তবে টেন হ্যাগ জানেন যে তিনি কি মাপের খেলোয়াড় তিনি পেতে যাচ্ছেন’, যোগ করেন তিনি।

দলবদলের বাজার বন্ধের আগে টেন হ্যাগ নিজের পছন্দের খেলোয়াড় পেলেন এটা রেড ডেভিল সমর্থকদের জন্য আনন্দের ব্যাপার। তবে পগবা, মাগুয়ারের মত সর্বশেষ সবগুলো বিগ মানি সাইনিং যেভাবে মাঠে মারা গেছে তাতে অ্যান্থনিকে নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা করাটা মোটেও অমুলক নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link