More

Social Media

Light
Dark

ঢাকার ডব্লিউ জি গ্রেস

১৮৭৭ সালের ১৫ মার্চকে বলা হয় ক্রিকেটের জন্মদিন। কারণ এদিনই প্রথম মুখোমুখি হয় ক্রিকেটের দুই কুলিন সদস্য অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড।

এরও আগে ১৮৭০ সালে বাংলার মানুষ দেখেছিল অভূতপূর্ব এক দৃশ্য – বাংলার কাদাময় মাঠে ক্রিকেট সাধনা করছে রায় পরিবারের পাঁচ ভাই। সাহেবদের খেলা ক্রিকেটকে পুরো ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এই ভাইয়েরা। আর এই ইতিহাস রচনায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী; যাকে সবাই ডাকে বাংলার ডব্লিউ জি গ্রেস নামে।

শীতের এক কুয়াশাছন্ন দিনে ১৮৬১ সালে সারদারঞ্জন রায় জন্মেছিলেন কিশোরগঞ্জের মসূয়া গ্রামের বিখ্যাত রায় পরিবারে। তার পিতা ছিলেন জমিদার কালীনাথ রায়। পাঁচ ভাই আর তিন বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন সারদারঞ্জন রায়। অন্যরা হলেন কামদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন, প্রমোদারঞ্জন, গিরিবালা, ষোড়শীবালা ও মৃণালিনী। পরবর্তীতে সময়ে কামদারঞ্জন পরিচিত হয়ে উঠেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি নামে। কিন্তু কেন?

ads

কালীনাথ রায়ের ভাই জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরি এবং তার স্ত্রী রাজলক্ষ্মী দেবী ছিলেন নিঃসন্তান। তাই পাঁচ বছর বয়স থাকতেই দত্তক নিয়েছিলেন কামদারঞ্জনকে, নাম বদলিয়ে রাখেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি। সারদারঞ্জন রায়ের এই ছোট ভাই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীও ছিলেন বাংলা সাহিত্যের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর ছেলে সুকুমার রায় ছিলেন বিখ্যাত ছড়াকার। আর সুকুমার রায়ের ছেলে সত্যজিৎ রায় ছিলেন আরও বিখ্যাত; চলচ্চিত্র নির্মাতা পরে তিনি অস্কার জিতেছিলেন। সেজ ভাই মুক্তিদারঞ্জনও নিজে ক্রিকেট খেলতেন এবং তার পুত্র শৈলজা, নিরোজা (ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা থাকায় ১৯৩২ সালে ইংল্যান্ড সফরে যাননি), নীরদা, ক্ষীরদা, হৈমজা সবাই ক্রিকেট খেলতেন। আরেকভাই কুলদারঞ্জন ছিলেন ডাকাবুকো ব্যাটসম্যান। সবার ছোটভাই প্রমোদারঞ্জন ছিলেন বাংলার প্রথম ফাস্ট বোলার।

কিশোরগঞ্জের মাইনর স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন সারদারঞ্জন রায়চৌধুরি। অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন সারদারঞ্জন। গ্রামের ধানখেতের মাঝে কর্দমাক্ত রাস্তা দিয়ে হাতে বই ও ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে হাঁটছে এক কিশোর এমন দৃশ্য কটিয়াদির মানুষের কাছে ছিল পরিচিত দৃশ্য। মাইনর স্কুলে পড়ালেখা শেষ করে ভর্তি হন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে। তারপর ঢাকার একটি স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করে ঢাকা কলেজে। তুখোড় ছাত্র হওয়ায় বিএ পরীক্ষার ঢাকা অঞ্চলে প্রথম হয়েছিলেন।

‘প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ’ বৃত্তি নিয়ে কলকাতায় সংস্কৃতে পড়তে শুরু করেছিলেন সারদারঞ্জন। কিন্তু সেটি অসমাপ্ত রেখে গণিত শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে। আলিগড়ের ছাত্রদেরও ক্রিকেটে হাতেখড়ি তাঁর হাতে। আরও পরে আলিগড় থেকে বদলি হয়ে অধ্যাপক হিসেবে ফিরে তিনি এলেন বাংলায়—নিজের ঢাকা কলেজে।

 

ঊনিশ শতকের শেষের দিকে ইংরেজ সাহেব এবং অভিজাত ভারতীয়রাই কেবল ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেতেন। ঢাকা কলেজে যোগ দেবার পর সারদারঞ্জন চাইলেন এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে, সেই লক্ষ্যে ১৮৮০ সালে ছোট চারভাইকে  নিয়ে গড়ে তোলেন ‘ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাব’। ক্লাব গড়ে উঠার পর আস্তে আস্তে ঢাকায় ক্রিকেটের প্রসার ঘটতে শুরু করে। অখন্ড বাংলার প্রথম ক্রিকেট ক্লাব হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে ক্লাবটি। ১৮৮৪ সালে সারদারঞ্জনের নেতৃত্বে ঢাকা কলেজ কলকাতায় খেলতে আসে প্রেসিডেন্সি কলেজের বিপক্ষে।

ইডেন গার্ডেনে অনুষ্ঠিত সে খেলায় ঢাকা কলেজ জয়লাভ করে। তবে প্রেসিডেন্সি কলেজ এই হার মেনে নেয়নি, তারা দাবি করে কলেজ দলে শিক্ষকেরা কেন খেলবেন? সারদারঞ্জন এই যুক্তির তীব্র প্রতিবাদ করেন। কিন্তু প্রেসিডেন্সির ব্রিটিশ অধ্যাপক এবং কলকাতা ক্রিকেট ক্লাবের সদস্যরা প্রেসিডেন্সির পক্ষে সমর্থন করলে সারদারঞ্জন অপমানিত হয়ে ঢাকা কলেজ থেকে পদত্যাগ করেন। এই সময়েই তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আহ্ববানে তারই প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে যোগ দেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিতে তখন তীব্র আর্থিক সংকট চলছিল। তাই তিনি নিজেই স্বাধীনভাবে কিছু করার চিন্তা করেন।

বাংলায় ক্রিকেট খেলার প্রচলন হলেও তখনো ক্রিকেট ব্যাট-বল আসতো বিলেত থেকে। বিলেত আবার এগুলো নিত অবিভক্ত ভারত তথা বর্তমানের পাকিস্থানের শিয়ালকোট থেকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এসব সামগ্রীর দাম ছিল আকাশচুম্বী। ফলে সাধারণ বাঙালির পক্ষে ব্যাট-বল কেনা সম্ভব হতো নাহ। এমন সময় কলকাতার যশোর রোডে ‘এস রায় অ্যান্ড কোম্পানি’ নামে ক্রিকেটসামগ্রীর একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন সারদারঞ্জন।

১৮৯৫ সালে একটি দোকান তৈরি করেন তিনি, সেখানে পাওয়া যেত বই ও ক্রিকেটসামগ্রী। বলা ভালো, বাংলার প্রথম ক্রিকেটসামগ্রীর দোকান ছিল এটি। শিয়ালকোট থেকে কাঠ এনে স্থানীয় আসবাব তৈরির কারিগরদের ব্যাট বানানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো সারদারঞ্জনের কারখানায়। বানানো হতো ব্যাট। ১৯০৬ সালে কালকাতার শিল্পপণ্য মেলায় সারদারঞ্জনের কারখানায় তৈরি হওয়া ‘ব্যালান্সড ব্যাট’ পেয়েছিল বিশেষ পুরস্কার।

এতকিছুর মাঝেও তার ক্রিকেট খেলা থেমে থাকেনি। ১৮৮৪ সালে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী টাউন ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন সারদারঞ্জন। এটি ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বদেশী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বেলিত করার একটি কৌশল। কেননা সে-সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নিয়মিত খেলত ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাব এবং কলকাতার টাউন ক্লাব। ব্রিটিশরা শাসক আর তারা শোষিত। এরই ধারাবাহিকতায় ইডেন গার্ডেনের মাঠে হঠাৎই একদিন টাউন ক্লাবের হয়ে খেলতে দেখা যায় স্বামী বিবেকানন্দকে। সবাই অবাক!

অবাক হলেও সত্য, সেই ম্যাচে স্বামী বিবেকানন্দ আরো খানিকটা অবাক করে দিয়ে তুলে নেন ৭ উইকেট! সেদিন ব্রিটিশদের গঠন করা কলকাতা ক্রিকেট ক্লাবের মুখোমুখি হয়েছিল টাউন ক্লাব। উল্লেখ্য যে, কলকাতা ক্রিকেট ক্লাব ১৭৯২ এবং কলকাতা টাউন ক্লাব ১৮৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা হেমচন্দ্র ঘোষের কাছে সারদারঞ্জনের সন্ধান পান স্বামী বিবেকানন্দ। তাদের দুজনের অনুপ্রেরণায় স্বামী বিবেকানন্দের পা পড়ে ক্রিকেট মাঠে। ১৮৮৭ সালে তিনি অবশ্য সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করেন। তার আগে বছর দুই পর্যন্ত টাউন ক্লাবের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি।

শুধু যে বিদেশি দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়েছেন তিনি এমন নয়, যেখানে অন্যায় দেখেছেন, সেখানেই সোচ্চার হয়েছেন। কলকাতায় যখন পূর্ব বাংলার খেলোয়াড়দের প্রতি অবহেলা বেড়ে যায়, তখন ওখানে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব বাংলার মানুষজন মিলে তাদের প্রতি অবহেলার প্রতিবাদে ১৯২০ সালে বিখ্যাত ‘ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। ক্লাবের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্টও ছিলেন তিনি।

এই মহান ক্রিকেট পুরোধা নিজের শত সীমাবদ্ধতার মাঝেও চেষ্টা করে গেছেন ক্রিকেটকে আমজনতার মাঝে ছড়িয়ে দিতে। ক্রিকেটের বিকাশে যা যা করা দরকার, সবকিছুই করেছেন নির্দ্বিধায়। আজকে সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবালদের সাফল্য দেখে হয়তো ওপর থেকে মুচকি হেসে উঠেন এই আজন্ম ক্রিকেটপ্রেমী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link