More

Social Media

Light
Dark

লা মাসিয়া, বার্সেলোনার চালিকাশক্তি

১৬ নভেম্বর ২০০৩, পোর্তো এফসির ঘরের মাঠ ডো দ্রাগাও। পোর্তো-বার্সা ফ্রেন্ডলি ম্যাচের ৭১ মিনিটে সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে ছিল একটি খেলোয়াড় বদলি হয়ে মাঠে নামবার অপেক্ষায়। ১৬ বছর বয়সী সেই ছেলেটি আজ পৃথিবীর অন্যতম সেরা একজন খেলোয়াড়, মেসি।

নভেম্বর ২৯, ২০১০। লা লিগার ম্যাচে মুখোমুখি দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল ও বার্সা। ৮ মিনিটের মাথায়, মাঝ মাঠ থেকে মেসির পাস জাভিকে, জাভি মাঠের বাম পাশে ইনিয়েস্তাকে পাস বাড়িয়ে দিয়েই দৌড়ে তৈরি করে নিলেন নিজের জায়গা। একটু সামনের দিকে এগিয়ে কাট করে ইনিয়েস্তা পাস ছুড়ে দিলেন ডি-বক্সে থাকা জাভির দিকে। সে বলে চিপ করে বোকা বানালেন সে সময়ের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক ইকার ক্যাসিয়াসকে। ম্যাচের ৯ মিনিটেই জাভি-ইনিয়েস্তার জুঁটি লিড এনে দেয় স্বাগতিকদের।

দুইটি ভিন্ন ঘটনা। কিন্তু ঘটনা দুইটি একই সূত্রে গাঁথা। সূত্রটি ‘লা মাসিয়া’। দ্য বার্থ প্লেস অব গ্রেট প্লেয়ার্স। এই লা মাসিয়া বার্সাকে দিয়েছে মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তা, পিওল, পিকে। শুধু বার্সাকে দিয়েছে বললে ভুল বলা হয়, উপহার দিয়েছে পুরো ফুটবল বিশ্বকে। হালের আনসু ফাতি, কিংবা সার্জি রবার্তোও এসেছেন বার্সার সেই খেলোয়াড় তৈরির আঁতুরঘর থেকে।

ads

‘লা মাসিয়া’ স্প্যানিশ এই শব্দটির ইংরেজি অর্থ দাঁড়ায় ‘দ্য ফার্মহাউজ’। শব্দটি যথার্থই বটে। কেননা সেখান থেকেই তো ফুটবলার তৈরি হচ্ছে সোনালী ফসলের মত। এর উদাহরণ হতে পারে ২০১২ সালে লা-লিগায় লেভান্তের বিপক্ষের ম্যাচটি। তৎকালীন কোচ তিতো ভিলানোভা ম্যাচটি জিতেছিলেন ৪-০ গোলে এবং সে ম্যাচে শুরু থেকে শেষ অবধি খেলেছিল লা মাসিয়া গ্রেজুয়েটরা। লা মাসিয়া কখনোই নিরাশ করেনি।

১৭০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া লা মাসিয়া ১৯৫৭ পরবর্তীতেও ছিল বার্সার ফুটবলের কেন্দ্রবিন্দু। প্রথম দিকে দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করা হলেও ১৯৭৯ সালের দিকে এটি প্রথম খেলোয়াড়দের আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর পর থেকেই চলে লা মাসিয়া একাডেমির কার্যক্রম। ২০১১ সালে নতুন করে সংস্করণ করা হয় মূল বিল্ডিংটাকে।

লা মাসিয়ার সাফল্যের পেছনের বড় কারণ এর দর্শন, এর আদর্শ। লা মাসিয়া ছোট থেকেই তাদের খেলোয়াড়দের মস্তিষ্কে ইঞ্জেক্ট করে দেয় টোটাল ফুটবলের ধারণা। ফুটবলের প্রতিটি পজিশনে কি করে ডমিনেট করতে হয় তা ছোট্ট বেলা থেকেই শিখে বড় হতে থাকে লা মাসিয়ার ছাত্ররা। খুব অল্প বয়সেই তারা পরিপক্বতাও অর্জন করে ফেলে। উদাহরণ মেসি কিংবা হালের আনসু ফাতি৷

তাছড়া ওয়ান টাচ পাস, যা খুব বেশি পরিচিত টিকি-টাকা নামে। সেই অসাধারণ ফুটবলীয় ট্যাক্টিসের দীক্ষা লা মাসিয়া থেকেই পেয়ে থাকে স্বপ্নে বিভোর ক্ষুদের খেলোয়াড়েরা। এই টিকি-টাকা যে কত প্রতিপক্ষের রক্ষণদূর্গ ভেঙ্গেচুরে চুরমার করেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করার এক দারূন অস্ত্র এই টিকি-টাকা। টেম্পারমেন্ট ধরে রাখতে না পেরে বারংবার ভুল করছে প্রতিপক্ষ, আর প্রতিবার সেই ভুলের ফায়দা তুলেছে বার্সা।

বার্সার এই টিকি-টাকা ফুটবল আর মানসিক দৃঢ়তা স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল ২০০৯/১০ মৌসুমে। পেপ গার্দিওয়ালা তার প্রেমিকার মতো করে হয়ত ভালবেসে ফেলেছিল লা মাসিয়ার আদর্শ, লা মাসিয়ার ফুটবলীয় ফিলোসোফি, ট্যাকটিস।

সফলতার বিচার যদি ট্রফি দিয়েই হয় তবে সে মৌসুমে ছয়টি ট্রফি ঘরে তুলেছিল কাতালানরা৷ যা ফুটবলের ইতিহাসে হয়ত কেও স্বপ্নেও ভাবেনি। বার্সা সেবার স্বপ্নকে বাস্তব করেছিল। স্পেন থেকে ইউরোপ, সেখান থেকে পুরো বিশ্বে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছিল তাদের আদর্শ আর ফুটবলীয় শৈল্পিক কারুকাজ দিয়ে। বার্সা সর্বদাই চেষ্টা করেছে তাদের এই দর্শন আকড়ে ধরে রাখতে।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে লা মাসিয়া থেকে মূল দলে আশা খেলোয়াড়দের হার ক্রমাগত ঢাল বেয়ে নেমে চলেছে। এর পেছনে দায়ী করা হয় বার্সার বর্তমান নীতিনির্ধারকদের৷ তাদের ভঙ্গুর পরিকল্পনাই এই নিম্নগামী গ্রাফের কারণ বলে মত জাভির। কাতালানদের মূল চালিকাশক্তি ছিল তাদের একাডেমি লা মাসিয়া।

কিন্তু, বর্তমান সময় সংঠকদের অধিকাংশ পরিকল্পনাতেই অবহেলিত সেরাদের সেরা করে গড়ে তুলবার এই পরিচর্যাকেন্দ্র৷ বার্সা কখনোই কারি কারি অর্থ খরচ করেনি খেলোয়াড় কিনতে। সর্বদাই চেষ্টা করেছে লা মাসিয়া গ্রাজুয়েটদের নিয়ে দল সাজাতে। সেই বার্সা আজ ট্রান্সফার মার্কেটে অর্থের রেসে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। সেই দৌড়ে তাল মেলাতে ছেড়ে দিতে হয়েছে তাদের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় মেসিকে।

বার্সেলোনা ম্যানেজমেন্ট কর্তাদের স্মৃতিতে হয়ত মলিন হয়ে যাচ্ছে লা মাসিয়ার ইতিহাস। তারা হয়ত ভুলতে বসেছেন ক্লাবের গোড়াপত্তন কোথায়, তারা হয়ত ভুলে যাচ্ছেন মেসি, ইনিয়েস্তা, জাভি, পুয়োলদের মতো বিশ্বসেরা খেলোয়াড়দের কীর্তি।

বার্সেলোনা সমর্থক তথা ফুটবল সমর্থক হিসেবে হয়ত সবাই আশা করছে ম্যানেজমেন্ট আবার তাদের কাঠামোগত পরিবর্তন এনে মনোনিবেশ করবে লা মাসিয়ার উন্নয়নে। গুরুত্ব দেবে, ভরসা করবে লা মাসিয়ার খেলোয়াড়দেরকে। সমর্থকদের প্রত্যাশা আবার বার্সার ডমিনেশনে লা মাসিয়ার খেলোয়াড়দের জয়জয়কার দেখবে তাঁরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link