More

Social Media

Light
Dark

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নান্দনিক যুবরাজ

মার্ভেলের ফ্যান্টাস্টিক ফোর দেখেছেন নিশ্চয়ই? ওলে সেশন, টিম স্টোরি আর জশ ট্রাংকের পরিচালনার সেই সুপারহিরো ফিল্মটা ছেড়ে এবার একটু ক্রিকেটে মনোযোগ দিন। এখানেও আছে ফ্যান্টাস্টিক ফোর, একেবারে রক্তমাংসে গড়া- বিরাট কোহলি, কেন উইলিয়ামসন, স্টিভেন স্মিথ আর জো রুট!

জো রুটের নামটা একটু শেষেই লিখলাম। কেন লিখলাম? কারণ এই রুট যে বাকি তিনজনের চাইতে একটু কম আলোতেই থাকেন। এই কয়েকদিন আগের ঘটনাটাই দেখুন না। আইসিসি তাঁদের দশকসেরা টেস্ট একাদশটা ঘোষণা করে দিল, ফ্যান্টাস্টিক ফোরের সবার জায়গা হল, হল না কেবল জো রুটের। অথচ এই চারজনের মধ্যে গত এক দশকে সবচাইতে বেশি টেস্ট রান ছিল এই রুটেরই।

জোসেফ এডওয়ার্ড রুট, আদর করে আমরা ডাকি জো রুট নামে। শেফিল্ডে জন্ম নেওয়া ছেলেটার ক্রিকেটের প্রতি ছিল ভীষণ টান। মাত্র পনেরো বছর বয়সে যখন তাকে শেফিল্ডেরই কিং একবার্ট স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল, দেখা গেল ক্রিকেটটা একেবারে রন্ধ্রে মিশে আছে রুটের। ব্যাট আর বলের সাথেই কাটত উঠতি কৈশোরের সেই সময়গুলো।

ads

তা কথায় আছে না? লক্ষ্মীর ভাঁড় নাকি লক্ষ্মী নিজেই রক্ষা করেন। রুটেরও হল তাই। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তিনি পেয়ে যান স্কুলের ক্রিকেট স্পোর্টস স্কলারশিপ। এভাবেই ক্রিকেটে বেঁচে থাকা ছেলেটার ক্রিকেটে বড় হওয়ার শুরু। স্কুলের পাঠ চুকিয়ে শেফিল্ড কলেজে ভর্তি হওয়া আর সেখানেও শেফিল্ড কলেজিয়েট ক্রিকেট ক্লাবে যোগ দেওয়া। মোটামুটি নিখাদ ক্রিকেটীয় জীবন বলতে যা বোঝায় রুটের ছিল তাই!

রুট নিজের আদর্শ মানেন মাইকেল ভনকে। আদর্শ মানার কারণও আছে অবশ্য। রুট উঠতি বয়সে খেলতেন যে শেফিল্ড কলেজিয়েট ক্রিকেট ক্লাবে, মাইকেল ভনও ক্রিকেটের শুরুর পাঠ চুকিয়েছেন এখানেই। যা হোক, শেফিল্ড কলেজিয়েট ক্রিকেট ক্লাব বানবারি উৎসব বলে এক ধরণের উৎসবে আয়োজিত ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নিত প্রতিবছর। এই টুর্নামেন্টটা ক্লাবটির জন্যে বেশ মর্যাদারও ছিল। সেই টুর্নামেন্টেরই একটা আসরে একবার রুট হয়ে গেলেন টুর্নামেন্টসেরা খেলোয়াড়। রুটকে তখন আর দেখে কে। উঠতি বৃক্ষের মত তিনি তখন ডালপালা মেলতে শুরু করেছেন, ছায়া দিতে শুরু করেছেন চারপাশে, হয়ে উঠতে শুরু করেছেন একজন জো রুট।

তবে ইংলিশ ক্রিকেটে এই ‘হয়ে ওঠা’ ব্যাপারটার জন্যে সবচাইতে বড় যে প্রভাবক কাজ করে সেটা হল কাউন্টি ক্রিকেট। শুধু তো আর ইংলিশ ক্রিকেট নয়, কাউন্টি ক্রিকেটের দর্শক পাওয়া যাবে বিশ্বজুড়ে। এই কাউন্টিতে পারফর্ম করেই তো অভিষেকের আগেই অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের গায়ে সেঁটে গেছিল ইয়ান বোথামের তকমা। তো এত প্রতিভাবান জো রুট কাউন্টিতে সুযোগ পাবেন না তা কি হয়?

নাহ, হয়না আর হয়ওনি। তবে শেফিল্ড নয়, রুটকে নিয়েছিল কাউন্টির দল ইয়র্কশায়ার। ইয়র্কশায়ারের দ্বিতীয় বিভাগের দলে রুটের অভিষেক হয় ১৮ জুলাই, ২০০৭ সালে। ডার্বিশায়ারের সেই ম্যাচে তিনি একাই করেন ৫৩, এডাম লিথের সাথে গড়েন ১৩৩ রানের পার্টনারশিপ। চমকপ্রদ অভিষেকের পর ইয়োর্কশায়ারের এই দ্বিতীয় দলে নিয়মিত পারফর্ম করতে লাগলেন তিনি। সেই পারফর্মের পুরষ্কারও মিলল এক সময়- হেডিংলিতে এসেক্সের বিপক্ষে ইয়োর্কশায়ারের প্রথম দলে অভিষেক হয়ে গেল একদিন।

সুচনাতে সম্ভাষণ- এবারেও নিজের বৈশিষ্ট্যের ব্যাতিক্রম করলেন না জো রুট। দলের হয়ে প্রথম ম্যাচেই খেললেন ৬৩ রানের ইনিংস, এরপর ইয়োর্কশায়ারের রান ১৮৭-৭ দাঁড়ালে দেখা গেল দলের হয়ে সবচাইতে বেশি রান জো রুটেরই।

ক্লাবদল- কাউন্টির দ্বিতীয় দল- এরপর প্রথম দলে অভিষেক, সবকিছুর ধারাবাহিকতায় জো রুটের গায়ে ইংলিশ ক্রিকেটের জার্সি উঠতে সময় লাগেনি। খুব দ্রুতই ইংল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পেয়ে যান তিনি। ঘরোয়া ক্রিকেটে তো আস্তে আস্তে ইংলিশ ক্রিকেট বিশ্লেষকদের নজর কাড়তে শুরু করেছেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও নিজের ছাপ রাখলেন তিনি বাংলাদেশে এসে। ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে বাংলাদেশ সফরে এসে সিরিজসেরা হয়ে মোটামুটি নিজের পরিচিতির সিড়ির একধাপ উপরেই ডিঙিয়ে গেলেন তিনি।

এরপর যা কিছু হয়েছে সব নিয়ম মেনেই হয়েছে। জো রুটের জন্যে সেসব হওয়ারই ছিল। ২০১০ এর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড দলের হয়ে সুযোগ পেয়ে গেলেন তিনি। তবে জো রুটের কাছে যেটুকু প্রত্যাশা ছিল বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের সর্বোচ্চ এই পর্যায়ে সেটুকু তিনি পূরণ করতে পারেননি। পুরো আসরে হংকং-এর সাথে ৭০ রান ছাড়া আর বলার মত সাফল্যও নেই।

তা সাফল্য না থাকুক, জো রুটের তো দেওয়ার তখন শুরুই হয়নি। তাই বিশ্বকাপের পর ইংলিশ ক্রিকেট বোর্ড আর জো রুট নিজেই টের পেলেন তাঁর ব্যাটিং নিয়ে কাজ করতে হবে ঢের। সেই কাজ করতে জো রুটকে পাঠিয়ে দেওয়া হল সাউথ অস্ট্রেলিয়ায়, অ্যাডিলেডের ড্যারেন লেহম্যান ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে।

সেখান থেকে ফিরে এসে আবারও তিনি যোগ দেন কাউন্টিতে। ওরচেস্টারশায়ারের বিপক্ষে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে অভিষেক হয়ে গেলে পুরো টুর্নামেন্টে তিনি সুযোগ পেলেন গোটা পনেরো ম্যাচে। সে টুর্নামেন্টে দারুণ পারফর্ম করায় রুটের সামনে ডাক আসে ‘ইংল্যান্ড লায়ন্স’ দলের হয়ে শ্রীলঙ্কার ‘এ’ দলের বিপক্ষে খেলার। সেখানেও ভাল করতে থাকলেন তিনি। এরপর ২০১৪ সাল নাগাদ তো ইয়োর্কশায়ারের কাপ্তানিটাও পেয়ে যান রুট।

তবে এত কিছুর পরও আসল অভিষেকটা কিন্তু রুটের বাকি রয়ে গেছে। সেটাও হয়ে গেল না, ইয়োর্কশায়ারের কাপ্তানী নেওয়ার আগেই হয়ে গেছে। ২০১২ সালের ঘটনা সেটি। ইংলিশ ক্রিকেটের ৬৫৫ তম খেলোয়াড় হিসেবে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট ক্যাপ মাথায় দেন তিনি।

ব্যাস, সেই যে পল কলিংউডের কাছ থেকে টেস্ট ক্যাপটা নিলেন এরপর যেন আর থামাথামি নেই। জো রুটের মাথায় টেস্ট ক্যাপ পরিয়ে দেবার সময় পল কলিংউড নিজেও কি জানতেন তিনি ক্যাপ পরিয়ে দিচ্ছেন আসছে দিনের টেস্ট ক্রিকেটের অন্যতম সেরা এক খেলোয়াড়ের মাথায়!

সেই ২০১২ সাল থেকে এই ২০২১ অবধি জো রুটের ব্যাটিং গড় দেখুন – ৯৩.০০, ৩৪.৪৮, ৯৭.১২, ৬০.২১, ৪৯.২৩, ৫০.৮৪, ৪১.২১, ৩৫.৮০, ৪২.১৮, ১৩৮.৩৩!

সবচাইতে খারাপ পারফর্ম করা বছরটাতেও (২০১৩) জো রুটের ব্যাটিং গড় ৩৫ ছুঁইছুঁই করছে। আর শেষ যে গড়টি, এটা ২০২১ এ যে দুটি টেস্ট খেলেছেন তাঁর গড়। ইংল্যান্ড তো শ্রীলঙ্কার সাথে টেস্ট খেলছে, সিরিজে জো রুট ইতোমধ্যেই পেয়ে গেছেন এক ডাবল সেঞ্চুরি। বোঝাই যাচ্ছে, বছরটা বেশ পয়মন্তই যাবে রুটের জন্যে। তা তো যেতেই হবে, ইয়োর্কশায়রের সেই ছেলেটা যে এখন ইংল্যান্ডের অধিনায়ক, বয়ে বেড়াচ্ছে ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী ‘মাথাব্যাথা’ টেস্ট দলের দায়িত্ব।

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link