More

Social Media

Light
Dark

সাঈদ আনোয়ার কেন আন্ডাররেটেড!

নব্বই দশকের সেরা টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান কে? কিংবা সেরা ওপেনার? শচীন টেন্ডুলকার কিংবা সনাথ জয়াসুরিয়া – ওপেনার বললে এই নাম দু’টোই আসবে সবার ওপরে। টপ অর্ডার বিবেচনা করলে ব্রায়ান লারা বা অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, স্টিভ ওয়াহরা আসতে পারেন।

কিন্তু, এ যুগের ক্রিকেট ভক্তরা কখনোই সাঈদ আনোয়ারের নাম নেন না। কিংবা কোনো সর্বকালের সেরা একাদশেও তাঁর ঠাই হয় না। কেন? সাবেক পাকিস্তানি এই ওপেনার কেন এতটা আন্ডাররেটেড!

একটু পেছনে ফিরে যাই। আনোয়ার তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ার শুরু করেন ১৯৮৯ সালের প্রথম দিন। তবে, তার পরের বছর অনুষ্ঠিত বেনসন অ্যান্ড হেজেস ট্রাই সিরিজের আগ অবধি তাঁকে দিয়ে পাকিস্তান ইনিংসের শুরু করায়নি। দিনটা ছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি।

ads

এর দু’দিন আগে ব্রিসবেনে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিনে নেমে ২৪ বল খেলে করেন ৩৭ রান। সেই ইনিংসটাই পাকিস্তানের টিম ম্যানেজমেন্টকে সাহস দিয়েছিল আনোয়ারকে ওপেনিংয়ে পাঠানোর।

ওপেনিংয়ের অভিষেকে আনোয়ার করেন ৩০ বলে ২৭ রান। সেই সপ্তাহেই তিনি ৯৯ বলে ১২৬ আর ৩৬ বলে ৪৩ রান – এই দু’টি ইনিংস খেলেন। সেই ত্রিদেশীয় সিরিজে তিনি ১০৫.৩৯ স্ট্রাইক রেটে রান করেন। অন্য যে কারো চেয়ে তিনি বেশি চার কিংবা ছক্কা হাঁকান।

নব্বই দশকের একদম গোড়াতেই মারমুখী ওপেনিং দেখিয়ে গিয়েছেন সাঈদ আনোয়ার। স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে তিনি যখন বিশাল সব ছক্কা হাঁকাতেন, তখন তাতে একরকম ‘সুপারম্যানিও’ ছোঁয়া ছিল। জাদুকরী টাইমিং আর প্লেসমেন্ট – তাঁকে সবার থেকে আলাদা করে তুলেছিল।

তবে, পাকিস্তানের টিম ম্যানেজমেন্টের আনোয়ারকে নিয়ে কোনো পরিকল্পনাই ছিল না। যখন তিনি দারুণ ছন্দে ব্যাট করতেন, তখন পাকিস্তান সেটা উপভোগ করতো, কিন্তু তাঁর ভবিষ্যতের ক্ষেত্রটা আরও মজবুত করার কোনো চেষ্টা করতো না।

যতদিনে জয়াসুরিয়া কিংবা টেন্ডুলকাররা এসে নিজেদের চূড়ান্ত রূপে মেলে ধরতে পেরেছেন, ততদিনে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেন আনোয়ার। পাকিস্তানের হয়ে ৪২ টি টেস্ট আর ১০৮ টি ওয়ানডে যতদিনে খেলেন আনোয়ার, তার পরে গিয়ে লঙ্কানদের হয়ে ওপেনিংয়ের সুযোগ পান জয়াসুরিয়া। ততদিনে ৪১ টি ওয়ানডে ইনিংসে ছয়টি সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন আনোয়ার।

আনোয়ারের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ নি:সন্দেহে ১৯৯২ বিশ্বকাপ। ইনজুরি তার বিশ্বকাপের স্বপ্ন চুরি করে। পাকিস্তান বিশ্বকাপ জিতলেও, তাতে আনোয়ারের ভাগ নেই। কে জানে, তখন যা ফর্ম – তাতে টুর্নামেন্টটা আনোয়ারেরও হতে পারতো।

তবে, এত কিছুর পরও এটা সত্যি যে, অন্তত ওয়ানডেতে নব্বই দশকে তাঁর কীর্তিগুলোকে খুব কমই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। নব্বই দশকে তিনিই সবচেয়ে বেশি রান করা ওয়ানডে ওপেনার। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯ – এই দশ বছরে তিনি এই ফরম্যাটে ওপেনিংয়ে করেন ৬৪২৭ রান। সামান্য ব্যবধান নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন শচীন, তিনে থাকা সনাথ জয়সুরিয়া রানের দিকে থেকে আনোয়ারের প্রায় দু’হাজার রান পেছনে।

পাকিস্তানের হয়ে ৫৫ টি টেস্ট খেলেছেন আনোয়ার। সমান সংখ্যক টেস্ট খেলেছেন কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান হানিফ মোহাম্মদও। আনোয়ার ১১ টি ও হানিফ ১২ টি টেস্ট সেঞ্চুরি পেয়েছেন। রানের দিক থেকে আনোয়ারই এগিয়ে, গড়েও এগিয়ে। তারপরও স্বীকৃতি বা আলোচনার ক্ষেত্রে তিনি হানিফের চেয়ে যোজন যোজন ব্যবধানে পিছিয়ে।

অভিষেক টেস্টের কোনো ইনিংসেই রানের খাতা খুলতে পারেননি আনোয়ার। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৬৮ গড় থাকার পরও তাই এরপর তিন বছরের জন্য তিনি টেস্টে বিবেচিতই হলেন না। তার প্রথম থেকে দ্বিতীয় টেস্টের মধ্যে পাকিস্তান আরো ৪৮ টি টেস্ট খেলে ফেলে। এর জন্য একটা ‘কৃতিত্ব’ অবশ্য দিতে হয় স্বয়ং ইমরান খানকে। কারণ, তৎকালীন এই পাকিস্তানি অধিনায়ক মানতেন যেন, আনোয়ার কেবলই সাদা বলের ক্রিকেটার। কে জানে, ওই তিনটা বছর খেললে হয়তো তিনি আজ শচীন-লারাদের কাতারেই থাকতেন।

নব্বই দশকে দেশের কমপক্ষে ২০ ইনিংস খেলেছেন, এমন টেস্ট ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সাঈদ আনোয়ারের গড়ই সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় আর তৃতীয় স্থানে আছেন যথাক্রমে গ্যারি কার্স্টেন ও সনাথ জয়াসুরিয়া। প্রথম ১৯ জনের মধ্যে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার সাবেক কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহের নাম থাকলেও নেই স্বয়ং শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। ইমরান খান কত বিরাট ভুল যে করেছিলেন, সেটা এটুকুতেই বোঝা যায়।

এখানেই শেষ নয়, সাঈদ আনোয়ার আক্ষরিক অর্থেই তখন বিরাট ব্যাপার ছিলেন। তিনি কত বড় ব্যাটসম্যান ছিলেন – সেটা বোঝাতে একটা পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। নব্বই দশকে টেস্টে কমপক্ষে ৪০ ইনিংস ব্যাটিং করেছেন এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সাঈদ আনোয়ারের ব্যাটিং গড় দ্বিতীয় স্থানে আছেন। এখানে সবার ওপরে আছেন গ্যারি কার্স্টেন, তৃতীয় স্থানে সনাথ জয়াসুরিয়া। এই তালিকাতেও শচীনের নাম নেই।

আনোয়ার টেস্টে দেশের বাইরে তিনবার নিজের ইনিংসকে ১৫০-এর ওপর নিতে পেরেছেন। এই কীর্তিটা নব্বই দশকের আর কোনো ওপেনারের নেই। রবি শাস্ত্রীর আছে দু’টি। আর এর চেয়েও বড় ব্যাপার হল, আনোয়ারের সেই ইনিংসগুলো খেলার তিন ম্যাচেই পাকিস্তান দল জিতেছে।

একটা ‘ভুতুড়ে’ ব্যাপার কাজ করেছে আনোয়ারের ক্যারিয়ারে। তিনি দলের একমাত্র তারকা ছিলেন না। দলে ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, মুশতাক আহমেদ, ইনজামাম উল হক, আমির সোহেল, সাকলাইন মুশতাকরা ছিলেন। ফলে, আলাদা করে নিজের দিকে নজর টানতে আনোয়ারকে ‘বাড়তি’ কিছু করতে হত। সাঈদ আনোয়ারের কোনো বিশ্ব একাদশে না থাকাটাও ঠিক তেমনই একটা ব্যাপার। যারা ঠাঁই পান যেমন ওয়াহদের দুই ভাই, শেন ওয়ার্ন, শচীন বা লারা – সবাই তো সাঈদ আনোয়ারকে ছাপিয়ে যান। বাকিদের মত তিনিও দৃষ্টিনন্দন, বরং কারো কারো চেয়ে একটু বেশিই ‘স্টাইল’ ছিল তার মধ্যে। কিন্তু, তারপরও কি একটা যেন ছিল না!

সেটা তিনি কখনো কখনো করেছেনও। ১৯৯৯ সালে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের বিপক্ষে ইডেনে তাঁর খেলা ১৮৮ রানের ইনিংসটি তার বড় প্রমাণ। যদিও সেই ম্যাচে শচীন-শোয়েব যুদ্ধ, শচীনের রান আউট, জাভাগাল শ্রীনাথের ১৩ উইকেট আর মঈন খানের সংগ্রামী ব্যাটিংয়ে সেই অর্জন কিছুটা ম্লান হয়ে যায়।

আনোয়ারের সাথে একটা অন্যায় করেছিল নিয়তিও। ২০০১ সালের আগস্টে তিনি নিজের মেয়েকে হারান। জীবনটা এক নিমিষে পাল্টে যায়। তিনি বিরতি নেন ক্রিকেট থেকে। ধর্মে মনোযোগী হন। ক্রিকেটে ফিরেছিলেন, কিন্তু আগের সেই ধার ছিল না। শচীনের সাথে চলমান লড়াইয়ে তিনি আর তাই পেরে ওঠেননি। আর ফিল্ডিংটা মানসম্পন্ন নয় – সেই নিয়ে আলোচনা তো ছিলই।

সাঈদ আনোয়ারের সবচেয়ে সোনালী দিন সম্ভবত ১৯৯৭ সালের ২১ মে। সেদিন চেন্নাইয়ে পেপসি ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ১৪৬ বল খেলে ১৯৪ রান করেন এই বাঁ-হাতি। সেটা ওই সময়ে ওয়ানডের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের ইনিংস। আজকের দিনের মত তখন প্রতি মাসে মাসে কেউ ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি পেয়ে যেতেন না। লম্বা সময় টিকেছিল আনোয়ারের রেকর্ড।

তারপরও কেন সাঈদ আনোয়ার সর্বকালের সেরাদের একজন নন? কেন তিনি ডুবে গেলেন! কেন ক্রিকেটাকাশে তাঁকে আর পাওয়া যায় না। এর একটা উত্তর এমন হতে পারে যে, তিনি ঠিক প্রচলিত ঘরানার সাবেক ক্রিকেটার নন। তিনি কোচিং বা অন্য কোনো রকম ক্রিকেটীয় ব্যাপারের সাথেই নিজেকে খেলোয়াড়ী জীবন শেষে আর জড়াননি। তাই, তাকে ভুলে যাওয়াটা আমাদের জন্য সহজ হয়েছে।

স্বীকৃতি একেবারেই যে পাননি, তা আবার বলা যাবে না। শেন ওয়ার্ন একবার বলেছিলেন, যাদের বিপক্ষে তিনি খেলেছেন, তাদের মধ্যে সেরা পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান হলেন সাঈদ আনোয়ার। সেখানে ওয়ার্ন একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘স্টাইলটাই সবাই মনে রাখে, পরিসংখ্যান সবাই ভুলে যায়।’

সত্যি, নান্দনিক ব্যাটিং দিয়ে মনে রাখার মত অনেক স্মৃতিই রেখে গিয়েছেন সাঈদ আনোয়ার!

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link