More

Social Media

Light
Dark

এক ‘নবাবীয়’ সাহস

– আমি তোমার মতো করে খেলতে পারবো না, ডগলাস!

– আমি তোমার অধিনায়ক। নিশ্চয়ই এটা মানো যে, তুমি আমার সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য?

– যদি আমি না মানি?

ads

– তাহলে আমার মনে হয়, তোমার জন্য না খেলাটাই ভাল।

– তাহলেই তাই হওয়া উচিৎ। তোমার কৌশলে আমি খেলতে পারবো না। বন্ধু ডগলাস, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো!

– আমি তোমাকে বলতে পারি, তুমি আর কোনোদিনও টেস্ট ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবে না!

এই কথোপকথনের প্রেক্ষাপট হল বিখ্যাত-কুখ্যাত সেই বডি লাইন সিরিজ। অধিনায়ক হলেন ডগলাস জার্ডিন, বডিলাইন কৌশলের জন্য যে ইংলিশকে ঘিরে নিন্দার কোনো শেষ নেই। আর দ্বিতীয় মানুষটি হলেন ক্রিকেটের প্রথম নবাব। ক্যারিয়ারের মাত্র দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নেমেই যিনি অধিনায়কের কৌশলের সমালোচনা করে চোখে চোখ রেখে নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারটা বিসর্জন দিতে পেরেছিলেন।

সেই বডিলাইন সিরিজের ইংল্যান্ড দল।

না, ডগলাসের ভবিষ্যদ্বানী সত্যি হয়নি আদৌ! দু’বছর বাদেই ফিরেছিলেন। সেবারও স্থায়ী হতে পারেননি। অপেক্ষা আরো বাড়ে। এরপর ১২ বছরের বিরতি এসেছে ঠিকই। তারপরও সেদিনের সেই তরুণ একটা সময় আবারো ফিরেছেন টেস্টে। ইংল্যান্ডের হয়ে নয়, মাতৃভূমি ভারতের হয়ে, তাও অধিনায়ক হয়ে।

তিনি হলেন, ইফতেখার আলী খান পতৌদি। লখনৌ নবাব পরিবারে ছেলে, পতৌদিতের অষ্টম নবাব। যেমন ক্রিকেটার ছিলেন, তেমনি ছিলেন তুখোড় ছাত্র। খ্যাতনামা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জোড়া ব্লুধারী তিনি। ক্রিকেটই শুধু নয়, শীর্ষ পর্যায়ে হকিও খেলতেন। ছেলে মনসুর আলী খান পতৌদি ওরফে টাইগার পতৌদিকে বলা হয় ভারতের অন্যতম সেরা অধিনায়ক, যিনি একটা সময় বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) নির্বাচকও ছিলেন। আর এই এই যুগে এসে সেই পরিবারের কুশীলবরাই কাপাঁচ্ছেন ভারতের সিনেমা অঙ্গন।

জন্ম ১৯১০ সালের ১৬ মার্চ। বাবা দ্রুত মারা যান, যখন বয়স মাত্র সাত – তখনই তিনি নবাব পদবী পেয়ে যান। ১৬ বছর বয়সে চলে আসেন ব্রিটেনে, উচ্চশিক্ষা নিতে। তখন থেকেই পরীক্ষার খাতা হোক, কিংবা হোক বাইশ গজ – সব জায়গাতেই সমান দক্ষতা দেখান তিনি। ১৯২৭ সালে যোগ যেন অক্সফোর্ডের ব্যালিওল কলেজে।

নবাব পরিবারের পারিবারিক ছবি।

ওই সময় ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেটেও একটা ‘অ্যাশেজ’ হত। মুখোমুখি হত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।

১৯৩১ সালের কথা। ক্যামব্রিজের হয়ে আসলেন সারের খ্যাতনামা অ্যালান র‌্যাটক্লিফ। প্রথম ইনিংসে করলেন ২০১ রান, বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেটের রেকর্ড। সেই ম্যাচে ছিলেন ইফতেখার আলী খানও। তার সৌজন্যে র‌্যাটক্লিফের রেকর্ডটা এক দিনের বেশি টিকলো না। চমক দেখিয়ে ইফতেখার করলেন ২৩৮ রান। রীতিমত ঘোষণা দিয়ে তিনি রেকর্ড ভাঙলেন। ২০০৫ সাল অবধি সেই রেকর্ড টিকে ছিল। সেই মৌসুমে অক্সফোর্ডের হয়ে ১৩০৭ রান করেন ৯৩ গড়ে।

সেখান পতৌদি ওরফে প্যাটের জায়গাট হয় উস্টারশায়ারে। তিনি উস্টারশায়ারের কিংবদন্তি। ১২৭ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন জীবদ্দশায়। ২৯ টি সেঞ্চুরি আর ৩৪ টি হাফ সেঞ্চুরি করেছেন প্রায় ৫০-এর মত গড় নিয়ে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও তাঁর অভিষেকটা ছিল স্মরণীয়। ১৯৩২-৩৩ মৌসুমের সেই কুখ্যাত সিরিজে ইংল্যান্ডের টেস্ট ক্যাপ পান। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড। অ্যাশেজের মঞ্চ।

অস্ট্রেলিয়ার ৩৬০ রানের জবাবে ৫২৪ রান করে ইংল্যান্ড দল। রঞ্জিৎসিংজি কিংবা দুলীপসিংজি যা পারেননি সেটাই তিনি করেন। অভিষেকেই পান সেঞ্চুরি। অভিষেকেই পান সেঞ্চুরি। করেন ১০২ রান। ৩৮০ বলের সেই ইনিংসে ছিল ছয়টি চার। প্রথম ম্যাচেই প্রশংসিত হয় ইফতেখারের ফুটওয়ার্ক। ম্যাচে ১০ উইকেটে জেতে ইংল্যান্ড।

সেই ম্যাচে একটাই ইনিংস ছিল ইফতেখারের। পরের টেস্টে দুই ইনিংসে মেলবোর্নে দুই ইনিংসে করেন যথাক্রমে ১৫ ও ৫। কিন্তু, এরপর জার্ডিনের সাথে গণ্ডগোলে জড়িয়ে তো টেস্ট ক্যারিয়ারটাই জলাঞ্জলি দিতে বসেছিলেন।

দু’বছর বাদে ইংল্যান্ড তাঁকে আবারো ফিরিয়ে এনেছিল। তবে, সুযোগ দিয়েছিল মাত্র এক টেস্টে। তাতে দুই ইনিংস মিলিয়ে করেন মাত্র ২২ রান। এরপর নির্বাসন। টানা ১২ বছরের। তখনও ক্রিকেটও নির্বাসনে চলে গিয়েছিল। কারণ, বিশ্বজুড়ে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

১৯৪৬ সালে যখন আবারো সাদা পোশাকে মাঠে নামার সুযোগ পান, তখন ক্রিকেট বিশ্বে বদলে গেছে অনেক কিছুই। পতৌদিও আগের সেই পতৌদি ছিলেন না। সেবার তিনি আগের দল ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই মাঠে নামেন, ভারতের অধিনায়ক হয়ে।

ভারতীয় দলের সেই ইংল্যান্ড সফর। বাঁ-থেকে লালা অমরনাথ, অধিনায়ক পতৌদি ও শরবিন্দু নাথ ব্যানার্জি।

প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতে দাপুটে ব্যাটিং করেন। রান তোলেন ৪৬.৭১ গড়ে। কিন্তু, মূল লড়াইয়ে তিনি ছিলেন সাদামাটা। তিন টেস্টে করেন মাত্র ৫৫ রান। ক্রিকেটার ইফতেখার আলী খান পতৌদির গল্পটা সেখানেই শেষ।

জীবনের গল্পটাও আর খুব বড় নয়। স্থায়ী হয় আর মাত্র বছর ছয়েক। দিল্লীতে পোলো খেলতে গিয়েছিলেন, তখনই হার্ট অ্যাটাক হয়। তাঁর ১১ বছর বয়সী ছেলেটা বাবার অপেক্ষায় ছিল। জন্মদিন পালন করবে বলে ১১ টি মোমবাতি জ্বালিয়ে অপেক্ষায় ছিল। বাবা আর ফেরেনি। এরপর ৬০ বছর পতৌদি প্যালেসে কোনো জন্মদিন পালন করা হয়নি!

সেই ছেলেটা আর কেউ নয়, দ্য গ্রেট টাইগার পতৌদি, পরবর্তীতে যিনি ভারতের হয়ে ৪৬ টি টেস্ট খেলে নেতৃত্ব দেন ৪০ টিতে!

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link