More

Social Media

Light
Dark

এক ঝড় এসে ভেঙে দিয়ে গেল…

যদি প্রশ্ন করা হয়, এই সহস্রাব্দে ক্রিকেটকে বদলে দিয়েছে কোন ঘটনা নির্দ্বিধায় সবাই টি-টোয়েন্টি ফ্যাঞ্চাইজি লিগ গুলো কিংবা আরও বিশেষভাবে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) এর নাম নিবেন। কিন্তু মনে আছে আইপিএলের শুরুটা কেন আর কীভাবে হয়েছিল?

সময়টা ২০০৭ সাল। জি স্পোর্টসের সাথে ভারতীয় ক্রিকেটের সম্প্রচার সত্ত্বের এক প্রকারে ঝামেলায় বিদ্রোহী ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগের (আইসিএল) সূচনা হলো। ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। চন্ড্রিগড় লায়ন্স, চেন্নাই সুপার স্টার্স, দিল্লী জেটস, কলকাতা টাইগার্স দলগুলোর কথা কি মনে আছে? খুব অল্পদিনের মধ্যেই দলগুলো প্রস্তুত হয়ে গেল।

বিসিসিআইও তাঁদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। ঘোষণা দিল এই দলগুলো তে যারা অংশ নিবে তারা জাতীয় দলের জন্য কখনও বিবেচিত হবে না। তাতে কি? প্রতিভার ঘাটতি তো ১০০ কোটি মানুষের ভারতে কখনই ছিল না। অনেক দিন জাতীয় দলের কাছাকাছি ঘুরেও ঠাই মিলছে না নইলে জাতীয় দলে আর সুযোগ পাবার সম্ভাবনা নেই এমন অনেকেই নাম লেখালো।

ads

তরুণদের মধ্যেও যারা হঠাৎ অর্থের হাতছানি ছাড়তে পারেনি নাম লেখালো আইসিএলে। আইসিএল কমিটি টুর্নামেন্টের আকর্ষণ বাড়াতে হাত বাড়াল অন্য দেশের খেলোয়াড়দের প্রতি । শেন বন্ড, ক্রিস কেয়ার্ন্স, অ্যান্ড্রু হল, হামিশ মার্শাল, ড্যারিল টাফি, মারভান আত্তাপাত্তু, পল নিক্সন, মইন খান দের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার প্রায় শেষ। তারা সোৎসাহে যোগ দিলেন আইসিএলে।

ক্রিকেট বিশ্ব তখন এরকম লিগ দেখেছে আরও অনেক আগে ক্যারি প্যাকার সিরিজের আদলে। এই উপমহাদেশে ক্রিকেট নিয়ে এমন উন্মাদনা, চিয়ার লিডার, রঙিন ঝকমকে পোশাকের ধুমধাম টি-টোয়েন্টি শুরুর মৌসুমে ভালই আলোড়ন তুললো। আইসিএল কর্তৃপক্ষ প্রথম আয়োজনের মাস খানেকের মধ্যে চাইল এর রঙ আরও ছড়িয়ে যাক, ব্যবসা আরও রমরমা হোক।

দুটা টোপ ফেললো দু’পাশে। পাকিস্তানের ইনজামাম উল হক তখন ক্রিকেট থেকে অবসরে। সাথে আজহার মেহমুদ এরও দরজা প্রায় বন্ধ, মইন খান, সাকলাইন মুশতাক, হাসান রাজাদেরও। লাহোর বাদশাহ নামে পাকিস্তানি প্লেয়ার দের একটা দল তৈরি হল ২০০৮ এর শুরুতেই। পাকিস্তানি খেলোয়াড় তো টানতে হয় – যাদের অন্তত এই উপমহাদেশে ভাল নাম ডাক আছে। তারা অফার করে বসলো মোটামুটি বেশ নাম ডাক ওয়ালা সবাইকেই।

পাকিস্তান ক্রিকেট বা তাদের টিম কেমিস্ট্রি, সিলেকশন নিয়ে তো নতুন করে কিছু লেখার নেই। যারাই নিজদের জায়গা নিয়ে ডাউট করলো, ঝাক বেধে চলে আসতে লাগলো আইসিএলে। নাম গুলো শুনুন- আব্দুল রাজ্জাক, আজহার মেহমুদ, ইমরান ফারহাত, ইমরান নাজির, মোহাম্মদ সামি, মোহাম্মদ ইউসুফ, নাভিদ উল হাসান, মুশতাক আহমেদ, শহীদ নাজির, শহীদ ইউসুফ, আরশাদ খান।

কি অবাক লাগছে? পাকিস্তান জাতীয় দল মনে হচ্ছে? লক্ষ্য করলে দেখবেন এদের প্রায় অর্ধেক প্লেয়ার ২০০৭ বিশ্বকাপ খেলেছে। আয়ারল্যান্ডের সাথে হেরে বিদায় হওয়া সেই দল তখন ভেঙে চুরে নতুন করে গড়ছে। তবু রাজ্জাক, নাজির, সামি, ইউসুফদের ক্যারিয়ার একেবারে শেষ হয়ে যায় নি। কিন্তু ঐ যে? অর্থের হাতছানি আর দলে আর জায়গা হবে কিনা সেই অনিশ্চয়তা – এরা দল গড়ল।

বিসিসিআই এর সাথে সম্পর্ক খারাপ না করতে পিসিবি ও ঘোষণা দিল যারাই আইসিএল এ যোগ দিবে তাদের জাতীয় দলের জায়গা বন্ধ। এক এক করে সব বোর্ড একই অবস্থানে গেল। কেননা অনেক দেশ থেকে তাদের রাডারে বা পরিকল্পনায় থাকা তরুণ খেলোয়াড় ও বেরিয়ে যাচ্ছে। এই ধারা চলতে থাকলে তো তরুণ রা জাতীয় দলের থেকে এই ফ্র্যাঞ্চাইজি খেলেই অর্থ প্রাপ্তির লোভে নিজ দেশের মায়া ত্যাগ করবে। এই লিগ দর্শকদের বিনোদন দিতে থাকলেও হয়ে গেল ক্রিকেট এমনকি খোদ আইসিসির জন্য কাঁটা।

ক্রিকেটের বড় বাজার তখন আছে বাংলাদেশে। জি স্পোর্টসের নজর তাই বাংলাদেশেও ছিল। তবে, মোটামুটি সকলের আড়ালেই তারা বড় একটা কাজ করে ফেললো। সেপ্টেম্বর, ২০০৮ এর কোন এক সকালে আবিষ্কৃত হল বাংলাদেশ থেকে আইসিএলে যাচ্ছে একটা দল – ঢাকা ওয়ারিয়র্স। একটা ঝড় বয়ে গেল বাংলাদেশ ক্রিকেটের ওপর দিয়ে।

 

খেলোয়াড়দের নামগুলো শুনুন- হাবিবুল বাশার (অধিনায়ক), অলোক কাপালি, আফতাব আহমেদ, ধীমান ঘোষ, মোহাম্মদ শরিফ, শাহরিয়ার নাফিস, ফরহাদ রেজা, গোলাম মাবুদ, মোহাম্মদ রফিক, মঞ্জুরুল ইসলাম , মোশাররফ রুবেল, নাজিমুদ্দিন, তাপস বৈশ্য, মাহবুবুল করিম।

হাবিবুল বাশার ২০০৭ পর্যন্ত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়ক। তার পরে বাংলাদেশের অধিনায়ক বিবেচনায় তৈরি করার কথা ছিল শাহরিয়ার নাফিসকে। এ দলের হয়ে ইংল্যান্ডেও অধিনায়কত্ব করেছেন তিনি। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচেও ছিলেন অধিনায়ক।

একবছর আগেও ছিলেন এক বছরে হাজার রান করা ব্যাটসম্যান। ঠিক তার কিছুদিন আগেই এশিয়া কাপে ( জুন, ২০০৮) এ ভারতের বিপক্ষে দুর্দান্ত সেঞ্চুরি হাকানো অলোক কাপালি বাংলাদেশ দলের অন্যতম ব্যাটিং স্তম্ভ , যার জায়গা নিয়ে ডাউট করত না প্রায় কোন সমর্থকই। আফতাব আহমেদ দলের সবথেকে বিধ্বংসী ব্যাটস্ম্যান, ফ্যান ফেভারিট, জাতীয় দলের দেশে বিদেশে যে কোন ফরম্যাটে অটো চয়েজ।

ধীমান ঘোষ বয়স ভিত্তিক দল থেকে উঠে এসেছেন। ধরা হচ্ছিল, পাইলটের পরে মুশফিক বা তিনিই দাঁড়াবেন গ্লাভস হাতে। এমন কি জাতীয় দলে ওয়ানডে অভিষেক ও হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিরূদ্ধে। একই ঘটনা মোশাররফ রুবেলের বেলায়। রফিকের দিন ফুরিয়েছে, তার জায়গাটা নেবার মতন প্রস্তুত রুবেল। গোলাম মাবুদ কিংবা মাহবুবুল করিমেরাও জাতীয় দলের রাডারে ছিলেন। কেবল বেলা ফুরাবার তালিকায় মোহাম্মদ শরিফ, তাপস বৈশ্য আর মঞ্জুরুল ইসলাম।

এই অকস্মাৎ ধাক্কায় পুরো বাংলাদেশ ক্রিকেট তখন স্তব্ধ, অক্টোবরে নিউজিল্যান্ডের সাথে হোম সিরিজ। তার এক মাস আগেই জাতীয় দলের একাদশের নিয়মিত ৪-৬ জন খেলোয়াড় সব জেনে শুনে জাতীয় দলের মায়া ছেড়ে দিল। আয়োজক কমিটির সাথে যোগাযোগ রেখে দলটা নির্মান করা ও তাঁদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা – শোনা যায় পুরো এই প্রক্রিয়াতে নাকি তৎকালীন দলের আরেক শীর্ষ ক্রিকেটার জড়িত, যার নিজের যাওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে সরে আসেন।

ধীমান ঘোষকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘জাতীয় দলের হয়ে তো লম্বা ক্যারিয়ার করতে পারতেন, কেন চলে যাচ্ছেন? বোর্ড যে এতোদিন ধরে ইনভেস্ট করল তার প্রতিদান কী?’

ধীমানের উত্তর ছিল, ‘বাংলাদেশ কে যা প্রতিদান দেবার দিয়ে ফেলেছি, আর কিছু দেবার নেই এখানে!’ ১৪ ওয়ানডে খেলে সর্বোচ্চ ৩০ রান করা ধীমানের থেকে হয়ত আর কিছু না পেয়ে খুব ক্ষতিও হয়নি বাংলাদেশের। এর বেশি কিছু দেবার সামর্থ্যই হয়ত ছিল না তাঁর। কিন্তু শাহরিয়ার নাফিস? বহুদিন ধরে দেশে কোন বাঁ-হাতি ওপেনার নেই নেই। সেই খরা থেকে মুক্তি দিয়েছিলন। আগের বছর ওয়ার্ন, গিলেস্পিদের বিরুদ্ধে ফতুল্লা’র সেঞ্চুরি যারা দেখেছেন, এখনও ভুলতে পারার কথা না।

ভাল স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির ছাত্র, এই স্টাইলিশ ব্যাটসম্যানের সাথে তাহলে কী ঘটেছিল? সেই কথায় আসছি পরে। জি স্পোর্টসে সস্ত্রীক চারু শর্মা’র এক অনুষ্ঠানে বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথেই বারবার বলছিলেন তার বাংলাদেশ জাতীয় দলের চিন্তা বাদ দিয়ে এই টুর্নামেন্টে আসা ভাল হয়েছে। তিনি এই নিয়ে সেকেন্ড থট দিতেও নারাজ এবং বিসিবি তাদের গ্রহণ করবে না সেটা নিয়ে তিনি বিচলিতও নন।

আফতাব আহমেদ বরাবরই কেয়ার ফ্রি, উদাসীন গোছের। নিজের সামর্থ্য কে একদম গলা টিপে হত্যা করায় মোহাম্মদ আশরাফুলের ভাল প্রতিদ্বন্দ্বী তিনি। ফ্লিনটফ আর হার্মিসন দের লাল বলে এক পা তুলে হুক করে লং লেগ দিয়ে সীমানা ছাড়া করার সময় মাইকেল ভন অবাক হয়ে ভাবছিলেন এই ছেলে তো যে সেই ব্যাটসম্যান না । আপনার বাংলাদেশ দলের অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর দৃশ্যটা মনে আছে?

ঐ যে শেষ ওভারে গিলেস্পিকে ছক্কা হাঁকিয়ে স্কোর লেভেল করা কার্ডিফে? কিংবা প্রথম যখন লংকা কে হারায় বগুড়াতে, সেই ম্যাচের টপ স্কোরার কে বলুন তো? আচ্ছা ভারত কে যখন শততম ম্যাচে হারিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু তে, সে ম্যাচের ই বা টপ স্কোরার কে? দক্ষিণ আফ্রিকা কে প্রথম হারানো ওয়ানড তে জাস্টিন কেম্প মিড উইকেট দিয়ে আছড়ে ফেলা ডায়নামোটাও কিন্তু আফতাব আহমেদ।

আরেকটা মজার স্মৃতি না লিখলেই না। বাংলাদেশ দলের পক্ষে ওডিয়াই তে প্রথম পাঁচ উইকেট শিকারী বোলারকে মনে আছে? হ্যা, তিনিই আফতাব আহমেদ (প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড) । প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে উইন্ডিজ কে হারানোর ম্যাচ টায় আশরাফুলের হাফ সেঞ্চুরির কাছে হয়ত তিনি ম্লান আশরাফুলের থেকে বেশি রান করেও ( ৪৯ বলে ৬২) ।

এরকম খেলোয়াড় রা চলে গেল জাতীয় দলের মায়া, কোটি কোটি ভক্তের ভালবাসার দাবি উপেক্ষা করে আইসিএল নামে শুরুতেই বিদ্রোহী খেতাব পাওয়া এক লিগে। আফতাব দের অনূর্ধ্ব ১৯ এর ব্যাচটি কে ধরা হতো সবথেকে প্রতিভাধর একটি ব্যাচ। সে দলে নাফিস ইকবাল, আফতাব, নাজমুল, এনামুল জুনিওর, শাহাদাত, ধীমানরা ছিলেন নিয়মিত খেলোয়াড়। ২০০৪ এ ঘরের মাঠে সেই দলের হয়ে স্কোয়াডে থেকেও কোন ম্যাচে সুযোগ পাননি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।

সে কথা থাক জাতীয় দল এর এরকম ক্ষতি করে এতোগুলো সম্ভাবনাময়ী খেলোয়াড় যাদের নিয়ে বোর্ডের আরও অন্তত ১০ বছরের পরিকল্পনা ছিল তাদের হারিয়ে দলের কি চেহারা হয়েছিল? এক সপ্তাহের মধ্যে নিউজিল্যান্ড সিরিজের ক্যাম্প। কোচ জেমি সিডন্স কে সবাই চিনি প্রচুর প্রফেশনাল একজন মানুষ হিসেবে।

তিনি কল করলেন রকিবুল, জুনায়েদ ইমরোজ সিদ্দিকি, ইমরুল কায়েস, নাইম ইসলামদের। থেমে তো থাকা যাবে না। ক্যাম্পের শুরুতে জেমি খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করাতে নরমাল ট্রেনিং কিটের পরিবর্তে নিত্য উপহার ব্র্যান্ডের জনপ্রিয়তা পাওয়া লাল সবুজের পতাকা শোভিত টি শার্ট পড়িয়ে অনুশীলন করালেন। সবার উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা যারা আছ, তারাই বেস্ট, এজন্যেই তোমরা এই ক্যাম্পে।

তামিম, সাকিব, মুশফিকেরা তখনও ১-২ বছর হয়নি দলে ডাক পেয়েছে। দলে জায়গা একদম পারমানেন্ট ই যে তাও না। হয়ত এই ২০২০ এ বসে যে সাকিব-মুশফিক-তামিম দের কে চিনেন সেভাবে বড় স্টার তারা হয়ে ওঠেন নি, কেবলই ডানা মেলতে শুরু করেছেন। জুনায়েদ, রকিবুল, নাইম ইসলাম দেরকে ২০০৮ এর সেই অক্টোবর সিরিজে নাফিস, আফতাব, কাপালি দের জায়গায় তাদের চোখ বুজে মেনে নিতে অতটা আত্মবিশ্বাস নাও পেতে পারেন । কিন্তু শুরুর ম্যাচে কী ঘলো মনে আছে?

নিউজিল্যান্ড ২০১ অল আউট, (মাশরাফি ৪ উইকেট)। জবাবে ব্যাট করতে নেমে বড় দলের মতন আয়েশে জিতে গেল বাংলাদেশ ৪৫ ওভারেই। সর্বোচ্চ রান জুনায়েদ সিদ্দিকীর (৮৫), এরপর অধিনায়ক আশরাফুলের ৫৬ বলে ৬০। ম্যাচ সেরা নাফিসে জায়গায় দলে আসা জুনায়েদ সিদ্দিকি। সিরিজের বাকি দু’ম্যাচেও ডমিনেট করে রস টেইলরের কাছে হেরে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু একটা শক্তি পায় সেই দলটা।

কারও জন্য জাতীয় দল থেমে থাকবে না, সেই বার্তাটা ঢাকা ওয়ারিয়র্স দলকে পাঠাতে পেরেছিলেন সাকিব-তামিম-নাইমরা। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি।

আইসিএলে তিন মৌসুম পর বন্ধ হয়ে যায়। জাতীয় দলকে উপেক্ষা করা খেলোয়াড়দের রুজিও বন্ধ হয়ে গেল। সব দেশ এক এক করে নানা রকম শর্ত দিয়ে খেলোয়াড়দের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে লাগল। যে ভারতীয় বোর্ডকে সন্তুষ্ট রাখতে সবাই ঘোষণা করেছিল। তারাই আগে সব তুলে নিয়ে বিনি, তিওয়ারিদের রঞ্জি ট্রফি খেলতে দিল। পাকিস্তানও আব্দুল রাজ্জাক, সামিদের আবার সুযোগ দিল।

বাংলাদেশের নাফিস, আফতাব, কাপালিরাও ফিরেছিলেন। তবে, সিরিয়াস ক্রিকেটের বাইরে থেকে ফিটনেসের অবনতি ঘটে। ফলে, আর বলার মত কিছু করা হয়নি তাঁদের। নাফিস, কাপালিদের প্রত্যাবর্তন ইনিংসগুলো দেখে মনে হচ্ছিল এরা ব্যাটিং টাই ভুলে গেছে যেন, আন্তর্জাতিক মানের নেই আর।

গত বছর নাফিস একটি ভিডিও বার্তায় আইসিএল এ যাওয়া নিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তরে ব্যাখ্যা করেছিলেন তার প্রতি সেই সময়ে দলে হওয়া বিভিন্ন আচরণ থেকে তাঁর মনে হয়েছিল তিনি বিসিবির লং টার্ম প্ল্যানে নেই। প্রায়ই একাদশ থেকে বাদ দেওয়া, কিছু সিরিজের ফর্মহীনতার কারণে না নেয়া এসব থেকে তার মনে হয়েছিল তিনি হয়তো অপাংক্তেয় হয়ে পড়ছেন।

আফতাব সর্বশেষ সুযোগ পেয়েছিলেন ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হোম সিরিজে। সর্বশেষ ইনিংসে মুশফিকের সাথে জুটি বেধে ইংল্যান্ডকে ভালই চেজ করছিলেন, কিন্তু ৪৪ রানে রান আউট হবার পরে বাংলাদেশ খেলা থেকে ছিটকে পরে। আফতাবের সেই রান আউট তার ক্যারিয়ারের ও শেষ আউট যেন। এরপর তাকে নির্বাচকেরাও সেভাবে বিবেচনা করেন নি। আফতাব ও নিভৃতে থেকে এক সময়ে অবসর ঘোষনা করেন। যদিও আকরাম খান বলেছিলেন, ওকে আমরা খোঁজ করেছি, ওর থেকে রেস্পন্স পাইনি। আফতাব যদিও স্বীকার করেননি সেটা ।

আইসিএল বাংলাদেশের কতটা ক্ষতি করেছিল সেটা নিয়ে আরও বিশ্লেষণ করতে চাইলে আরও পরিসংখ্যান হয়ত দাঁড় করানই যায়। কিন্তু বিসিবি নাফিস, আফতাব, কাপালি দের যেভাবে তৈরি করেছিল তারা কি সেটার অপচয় টা তার নিজ বিবেচনায় করেছেন। শুধু খেলোয়াড়ি জায়গা থেকেই না। এই ৩ জন ছিলেন দর্শকদের কাছে চরম জনপ্রিয় (এখনও)। সেই ভালবাসার প্রতিদান টা তারা দিতে পারেন নি।

সেই দলের অধিনায়ক হাবিবুল বাশার বোর্ডের কাছে, সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। এখন তিনি একজন নির্বাচক। ‘মিস্টার ৫০’ একটা সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের সবথেকে সফল ব্যাটসম্যানদের একজন, সফল অধিনায়ক ও ছিলেন।

অর্থের হাতছানি, ভবিষ্যৎ ভাবনা, আত্মসম্মানবোধকে সীমা দিয়ে বেঁধে ফেলা বনাম পারফরম্যান্স দিয়ে, সংগ্রাম করে জাতীয় দলে টেকা বা জায়গা রক্ষার চেষ্টা – এই দুইয়ের ভেতরে কে কোনটাকে প্রাধান্য দিবে সেটা নিতান্তই তার ব্যক্তিগত। কারণ দিনশেষে ক্রিকেট টা একটা খেলা এই বলেই যেমন কথা শেষ করা যায়, তেমনি ক্রিকেট টা দর্শকদের জন্য খেলার চেয়েও বেশি কিছু এই বোধ কেও সামনে নিয়ে আসা যায়। বিবেচনাবোধটা অবশ্যই সর্বজনীন নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link