More

Social Media

Light
Dark

বিশ্বমঞ্চে লঙ্কাকাণ্ড

‘বাড়ির পাশে আরশি নগর, সেথা একঘর পড়শি বসত করে’ – হ্যাঁ, এ যেন ঠিক তাই, দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা, যাকে আমরা রাবনের দেশ বলতাম, রামের দেশের লোকেরা, সেই দেশই যে ক্রিকেটের বিশ্বমঞ্চে আবার লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে বসবে – এ কথা নব্বই এর দশকের শুরুতে ক’জন ভেবেছিলো!

দুটো বিশ্বকাপ খেলার পর ১৯৮১ সালে দিলীপ মেন্ডিস, রয় ডায়াস, অনুরা তেনেকুনদের আমলে টেস্টের দরজাটা হাট হয়ে যায়, কিন্তু বিশ্বমঞ্চে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ক্যারিবিয়ান, মারাত্মক পেশাদার অস্ট্রেলিয়া বা পড়শী ভারত কে টপকে বিশ্বকাপ টাই যে ছিনিয়ে নেবে লঙ্কান রা একথা বোধহয় অনেকেই ভাবেননি।

সেবার বিশ্বকাপের নাম উইলস ওয়ার্ল্ড কাপ, আর আসর ও বসেছে উপমহাদেশে বসন্তের শুরুতে জাঁকিয়ে। সে যজ্ঞে সামিল শ্রীলঙ্কা ও, তাদের দেশেও হবে বেশ কিছু খেলা। কিন্তু, বিধি বাম, তখন বোমা বিস্ফোরণে, রাজনৈতিক অস্থিরতায় অশান্ত সিংহল ভূমি। সেখানে খেলতে আসবেনা বলে পণ করেছে অজি আর ক্যারিবিয়ানরা।

ads

কিন্তু, বিশ্বকাপ তো আর থেমে থাকবে না। তা চলবে নিজের ছন্দেই। ফ্লাওয়ার ভাইদের জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে জয় দিয়েই শুরু লঙ্কার অভিযান, ডি সিলভা ‘ডিলাইট’ শুরু টা করলেন চমৎকার ৯১ দিয়ে। এরপর প্রতিবেশি ভারতের বিরুদ্ধে ফিরোজ শাহ কোটলার ব্যাটিং পিচে প্রকৃত সূর্যোদয় হলো লঙ্কা ক্রিকেটের।

সনাথ জয়াসুরিয়ার তেজে পুড়ে গেলেন ভারতীয় বোলাররা। আগের বিশ্বকাপেই চালু হয়েছিল প্রথম ১৫ ওভারে ফিল্ডিংয়ের নানা বাধানিষেধ। আর লঙ্কা বাহিনী এটার চমৎকার সদব্যবহার করে এই বিশ্বকাপে, বিপক্ষ দল কিছু বুঝে ওঠার আগেই ব্যাট হাতে এমন গুন্ডামি শুরু করতেন জয়াসুরিয়া আর কালুভিথারানা যে ওখানেই বিপক্ষের কাঁধ অর্ধেক ঝুলে যেত।

কোটলা থেকে ক্যান্ডিতে পৌঁছেও লঙ্কান তেজ বাড়লো বই তো কমলো না। সেই তেজের সামনে এবার, প্রথম বিশ্বকাপে পা দেওয়া কেনিয়া। ডি সিলভা, গুরুসিংহা, রানাতুঙ্গাদের সামনে শিশুসুলভ কেনিয়া ৩৯৮ রান সমর্পন করলো, যা সেই সময়ের একদিনের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ছিল।

ইডেনের সেই সেমিফাইনালের পর

এসব যা হচ্ছিলো সব গ্রুপ লিগে, কিন্তু এবার তো সামনে নকআউট, হারলেই বিদায়, সেই কোয়ার্টার ফাইনালে ফয়সালাবাদে ফয়সালা হয়ে গেল যে লঙ্কান দল এবার থাকতেই এসেছে। আগের বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট দের দশ ওভার বাকি থাকতেই উড়িয়ে দিলো লঙ্কা বাহিনী। ঘাতক এবারও সেই জয়াসুরিয়া। ৪৪ বলে ৮২ রানের একটা মারাত্মক ঝড়, তাতেই শেষ ইংরেজ দম্ভ।

রানাতুঙ্গা এই পরিকল্পনা আগের থেকেই করেছিলেন। যখন বছর খানেক আগে সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের নেটে দেখেছিলেন ২৪ বছরের একটি ছেলে অসম্ভব জোরে বল হিট করছে দেখেই বুঝেছিলেন তিনি। যা চেয়েছিলেন তা পেয়ে গেছেন, তাঁর বিশ্বকাপের ট্রাম্পকার্ড ছিলেন এই জয়াসুরিয়া।

এই লঙ্কান সূর্যের ব্যাটিং তেজে যখন ক্রিকেট বিশ্ব সম্মোহিত তখন তাঁর বাঁ হাত ও খেল দেখালো যখন কোটলার পর আবার লঙ্কানরা পা রাখলো ভারতে। এবারে কলকাতায়, সেমিফাইনাল খেলতে। এক লাখের ইডেনের এ ম্যাচ পুরোটাই ছিল নাটকীয়তায় ভরা।

ফাইনালে আগুন ঝরান ‘ম্যাড ম্যাক্স’

স্কোরবোর্ডে শ্রীলঙ্কার পাশে একরান লেখার আগেই জয়াসুরিয়া আর কালু আউট। কিন্তু বহু যুদ্ধের ঘোড়া ডি সিলভা কে থামানো গেল না। রোশন মহানামাকে সঙ্গী করে বিপর্যয় কাটিয়ে ২৫১ তে পৌঁছে দিলেন লঙ্কাবাহিনীকে।

ভারত ভালো শুরু করেছিল লিটল মাস্টারের দাপটে, কিন্ত ওই যে, যেদিন আকাশে জয়ের সূর্য দেখা যাবে সেদিন লিটল মাস্টার ও হয়ে যাবেন ছাত্র। আর জয়সুরিয়ার বলে শচীন স্ট্যাম্পড হতেই নিয়তি লেখা হয়ে যায় ভারতের।  দর্শক হাঙ্গামায় ম্যাচ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জয়ের সূর্য সেই বাড়ির পাশের আরশিনগরের ছাতেই উঠলো। চোখের জলে সেমিফাইনালে বিদায় ভারতের আর লাহোরে ফাইনালের টিকিট লঙ্কাবাহিনীর।

ফাইনালে লঙ্কার ঝাঁজের মুখে পড়ার জন্য রীতিমতো তৈরী মার্ক টেলরের অস্ট্রেলিয়া। সেই অস্ট্রেলিয়া যারা শ্রীলঙ্কায় খেলতে যেতে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু হিসেব তো চুকে যাবে এ জীবনেই, এ বিশ্বকাপেই।

লঙ্কার ঝাঁজ আর সূর্যের তেজ যে বড় বিষম বস্তু তা হাড়ে হাড়ে বুঝলো ক্যাঙ্গারু বাহিনী। ১৭ মার্চ, লাহোরে দিন রাতের ফাইনালে মুখোমুখি ক্যাঙ্গারু ও সিংহ। অজি নেতা মার্ক টেলর গোটা বিশ্বকাপে শান্ত থেকে ফাইনালে গিয়ে জ্বলে উঠলেন, ২৪১ রান বোর্ডে তুললো অজিরা, কিন্তু লঙ্কা দলে ছিলেন এমন একজন, ক্রিকেট সার্কিটে যাঁর আদরের নাম ‘ম্যাড ম্যাক্স’। বাইশ গজে এমন পাগলামি ও করা যায়!

বলিউডের নামি চিত্রনাট্যকার ও বোধহয় ভরসা পেতেন না তাঁর নায়ককে দিয়ে এমন ‘হিরোগিরি’ করিয়ে নিতে। অরবিন্দ ডি সিলভা কে দেখলে বোঝা যাবে বিলক্ষণ যে প্রতিভা, সংকল্পবোধ এবং সাফল্যস্পৃহা – শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে ফেলার এই মন্ত্র গুলো থাকলে সত্যিই বিশ্বজয় করা যায়। ফাইনালে অতিমানবীয় কিছুই করেছিলেন সিংহলি ক্রিকেটের প্রবাদপুরুষ।

ব্যাট হাতে ১২৪ বলে ১০৭, বল হাতে ৪২ রানে ৩ উইকেট, শিকার গুলো কারা? মার্ক টেলর, রিকি পন্টিং, ইয়ান হিলি! এসবের পরেও স্টিভ ওয়াহ আর স্টুয়ার্ট ল’র ক্যাচ তালুবন্দি করা, এটা অতিমানবীয় নয়!

অর্জুনা রানাতুঙ্গা যখন প্রয়াত পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর হাত থেকে উইলস বিশ্বকাপ তুলে নিলেন তখন বিশ্বের ক্রিকেট আকাশে উদয় হলো এক নতুন সূর্যর, যে দলটা ১৯৭৫ সালে ‘বিশেষ আমন্ত্রণ’ নিয়ে খেলা শুরু করে, ‘৭৯ সালে যোগ্যতা নির্ণায়ক বাধা টপকায় আর ’৯৬ তেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।

বিশ্বমঞ্চে লঙ্কাকাণ্ডে আবারো দক্ষিণ এশীয় মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। সেবারের পর আরো একাধিকবার বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছে শ্রীলঙ্কা। তবে, ৫০ ওভারের ক্রিকেটে এরপর আর কখনোই শিরোপা জেতা হয়নি। বরং ২০১৪ সালে বাংলাদেশের মাটিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে লঙ্কান সিংহরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link