More

Social Media

Light
Dark

বাজিগর তো এদেরই বলে!

সালটা ২০০৭। বছরের শুরু থেকেই টালমাটাল ভারতীয় ক্রিকেট। প্রথমে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কার কাছে প্রথম রাউন্ডে হেরেই আকস্মিক বিদায়, বিদায়ের পরেই ‘হেডস্যার’ গুরু গ্রেগের পদত্যাগ। তারপর ইংল্যান্ড সফরেও একদিনের সিরিজে হার। আর অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়েরও পদত্যাগ।

সব মিলিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটে উদযাপন করার মত কিছু দেখা যাচ্ছিলো না। সাদা বলের ক্রিকেটে বারবারই আশা ভঙ্গের কাহিনী শোনাচ্ছিল ভারতীয় দল। এমতাবস্থায় কুড়ি বিশের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের দামামা বাজিয়ে দিলো আইসিসি, কোথায় হবে? ম্যান্ডেলার দেশে সেপ্টেম্বরে।

যে দেশে চার বছর আগের ফাইনাল আরেকটা স্বপ্নভঙ্গের রাত দেখিয়েছিল। যাই হোক এ যাত্রায় বলে রাখা ভালো আইপিএলের ঝংকার তখনো দেখেনি ভারত তথা বিশ্ব ক্রিকেট। ফ্রাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি কি জিনিস সেটাও জানেনা কেউ, ভারতীয় ক্রিকেটে তখনো স্বমহিমায় বিরাজমান শচীন, সৌরভ, দ্রাবিড়, কুম্বলে, লক্ষ্মণের মতো মহারথীর।

ads

ভারতীয় দলের এই উথাল পাথাল অবস্থাতেই শচীনের সুপারিশে রাঁচির এক তরুণের হাতে বর্তালো অধিনায়কের গুরু দায়িত্ব। যিনি ভারতীয় দলের এক বিরাট বিবর্তনের কাণ্ডারি। সেই মহেন্দ্র সিং ধোনি, কুড়ি বিশের বিশ্বকাপে মহারথীদের বিশ্রাম দিয়ে পাঠানো হলো একদল তরুণ তুর্কি, ছোট ছোট শহরের থেকে বেরিয়ে আসা এমন কয়েকজন যাদের মধ্যে নিহিত ছিল ভবিষ্যতের বড় তারকা।

সে দলের সবচেয়ে সিনিয়র শেবাগ, হরভজন, যুবরাজ আর আগারকার। এমনকি জাহির খানকেও পাঠানো হলো বিশ্রামে। এরকম দল দেখে আম জনতা বা বিশেষজ্ঞরা কেউই আশাবাদী হতে পারেননি, আর না হবারই কথা, সব দল যখন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটায় সড়গড় হয়েছে মোটামুটি, সেখানে ভারতীয় দল হাঁটি হাঁটি পা পা! অভিজ্ঞতার ঝাঁপিতে মাত্র একটা টি-টোয়েন্টি।

সবার শেষে ম্যান্ডেলার দেশে পা রাখলো ভারত, আর বিড়ম্বনা শুরুতেই, গ্রুপের সবচেয়ে দুর্বল দল স্কটল্যান্ডের সাথে প্রথম ম্যাচ টাই ভেস্তে গেল বৃষ্টিদেবতার জন্য। পরের খেলা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সাথে, কিংসমিডের সেই সন্ধ্যায় ভারতের শুরুটা হলো ভয়াবহ। মোহাম্মদ আসিফের মারাত্মক স্পেলে আয়ারাম গয়ারাম ভারতের ব্যাটসম্যানরা।

এর মধ্যেই নবাগত উথাপ্পার ৫০-এর সৌজন্যে সম্মানজনক ১৪১ এ পৌঁছালো ভারত, এ রান যদিও যথেষ্ট নয় বিপজ্জনক পাকিস্তানের সামনে, কিন্তু বিশ্বকাপ এলেই ভারতকে দেখে পাকিস্তানের কি হয় কে জানে, আসা যাওয়ার পালা শুরু করলেন পাক ব্যাটসম্যানরাও, যদিও শেষে এমন অবস্থা হলো ভারতের জয় ও হারের মধ্যে দেওয়াল হয়ে দাঁড়ালেন বহুদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিস্মৃত এক পাক ব্যাটসম্যান মিসবাহ উল হক।

শেষ বলে চাই এক রান, এ অবস্থা থেকে পড়িমরি করে দৌড়াতে গিয়ে ভাঙলো উইকেট, হ্যাঁ ম্যাচের ফল – টাই! ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত’, খেলা তো এখনো শেষ নয়, এবার বোল্ড আউট। সে আবার কি জিনিস? না, একজন করে বোলার বল করে উইকেট ভাঙবে, এ দল একবার, ও দল একবার, অনেকটা ফুটবলের পেনাল্টি শুটআউটের মতো, তো ভারতের শেবাগ, হরভজন, উথাপ্পা তিনজনেই সফল হলেন। অন্যদিকে পাকিস্তানের আরাফাত, গুল, আফ্রিদি ব্যর্থ, অর্থাৎ ‘ইউ মিস আই হিট’, ফুটবলের স্কোরলাইনের ঢঙে ৩-০তে জিতলো ভারত!

সুপার এইটের প্রথম ধাপে এবার সামনে নিউজিল্যান্ড। স্পিনারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে যখন ম্যাচে ফিরবো ফিরবো করছে ভারত। তখনই, জ্যাকব ওরাম আর বুড়ো ম্যাকমিলান কিউইদের টেনে নিয়ে গেলেন ১৯০-এ, বীরু-গৌতি শুরু করেছিলেন ঝড়ের বেগে। কিন্তু ড্যানিয়েল ভেট্টোরি’র স্পিন জালে ফেঁসে ১০ রান আগেই থামলো ভারত।

ভারতের কুড়ি বিশের বিশ্বকাপ অভিযান কেও যেন আরও বড় প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল। কিন্তু এই সময়ই তো পরীক্ষা পুরুষের সাথে বীরপুরুষের, যাদের মনে ‘মরার আগে মরবো না ভাই মরবো না’, কলিংউডের ইংরেজ দলবল বুঝে উঠতে পারেনি কি পরিমান বারুদ জমে রয়েছে ভারতীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে।

শোলের জয়-বীরুর মতো একে ওপরের পরিপূরক হয়ে বীরু-গৌতি আবার ও এমন ঝড় তুললেন ইংরেজ সিংহদের বিরুদ্ধে যে তাতেই ১৩৩ রানের ওপেনিং জুটি হয়ে গেল, এরপর ও বাকি ছিল! সিংহের সাথে সিংহের লড়াই, যুবরাজ সিংহের কথাই হচ্ছে। যুবি তখন সবে হাত খোলার চেষ্টায়, মহারাজের ‘ভারী পছন্দের’ ফ্লিনটফ কি একটা বলে টোলে তাতিয়ে দিলেন যুবরাজকে।

১৮ ওভার শেষে রানটা তখন ১৭১, টেনে টুনে ২০০ হয় কিনা ভাবনা, এমন সময় যুবরাজের ব্যাট থেকে ছিটকে একটার পর একটা বল পরপর আছড়ে পড়ছে গ্যালারিতে, টানা ৬ বার, না বোলার স্টুয়ার্ট ব্রডের করুন মুখটার দিকে তাকানোর কেউ নেই। সব আলো শুষে নিয়েছেন যুবি, এক ওভারে ছয়টা ছক্কা মেরে আর মাত্র ১২ বলে ৫০ করে ইতিহাস গড়ে। ২১৮ রানের বিশাল ইমারতের সামনে যদিও লড়াই দিয়ে গেল ইংল্যান্ড, কিন্তু ভারতের জয় আটকালো না।

রোহিত শর্মা নামক এক অত্যন্ত প্রতিভাবান ক্রিকেটারের কথা শোনা যাচ্ছিলো অনেকদিন ধরেই মুম্বাই ক্রিকেটে। তিনি যে নিজের জাত চেনানোর জন্য আয়োজকদেরই বেছে নেবেন কে জানতো। সেদিনের ৪০ বলে ৫০ রানের ইনিংসটা রোহিতের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে চলার পথ দেখিয়েছিলো। ১৫০-এর গণ্ডি টপকানোর পর ভারতকে আর রোখা যায়নি।

রায়বেরিলির রুদ্রপ্রতাপের প্রখর রুদ্রে স্মিথ, গিবস, ডি ভিলিয়ার্স, জাস্টিন কেম্পদের ব্যাটিং লাইন আপে এমন কম্পন ধরে গেল যে আয়োজকরা আবারও ছিটকে গেল মাত্র ১১৬ তে শেষ হয়ে, ম্যাচে দীনেশ কার্তিক এমন একটা ক্যাচ ধরলেন গ্রেম স্মিথের, যে ওরকম একখানা ধরলে জন্টি রোডস ও গর্ব বোধ করতেন।

আবারও ডারবানের কিংসমিড, আবারও বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল, এবার সামনে প্রবল পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়া, যারা কিনা শেষ তিনটা ওয়ানডে বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন। ভারতীয় দলের ওপেনিংয়ের ‘জয়-বীরু’ এর ব্যাট এদিন শান্ত, ভারত ৮ ওভারে দুই উইকেটে মাত্র ৪১। এখান থেকেই আবার ডারবানে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যেখান থেকে শেষ করেছিলেন সেখান থেকেই যেন শুরু করলেন যুবরাজ, ব্রেট লি, স্টুয়ার্ট ক্লার্ক দের বলে যখন ‘যেমন খুশি তেমন মারো’ ব্যাপার টা নিয়ে এলেন যুবি।

ওদিকে সেদিনের অজি অধিনায়ক গিলক্রিস্টকে দেখে মনে হচ্ছিলো কুড়ি বিশের ফরম্যাট বোধ হয় অজিদের জন্য নয়, ৩০ বলে যুবির ৭০ ভারতকে ১৮০’র গণ্ডি পার করে দিল। সাথে ছিল ধোনির ১৮ বলে ৩৬, ফিল্মের আওয়াজ যেন গ্যালারি তেই সেদিন তৈরী হয়ে গিয়েছিলো – ‘মাহি মার রাহা হ্যায়’। এরপর শ্রীশান্ত অসাধারণ একটা স্পেল উপহার দিলেন, ভালো শুরুর পরেও নিয়ন্ত্রিত বোলিং এ ফিরে তাকাতে হয়নি, সোজা জোহানেসবার্গের ফাইনালের টিকিট হাতে ভারতের।

ঠিক সাড়ে চার বছর পর, আবারও জোহানেসবার্গের ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়াম, আবারও একটা বিশ্বকাপ ফাইনাল, এবার সামনে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান। ক্রিকেট প্রেমীদের কাছে ভারত-পাক ফাইনাল পাওয়ার পর আর কি চাহিদা থাকতে পারে। একদিকে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান – তেজি, তরুণ তুর্কি ভারতের, অন্যদিকে অভিজ্ঞতায় ভরপুর, আগের ম্যাচের হার সুদে আসলে তোলার জন্য মরিয়া পাকিস্তান।

যুযুধানে এই তখন দুদলের অবস্থান। শেবাগ এদিন খেলতে না পারায় ইউসুফ পাঠানকে ওপেনে তুলে আনেন ধোনি, সে ফাটকাটা কাজে না লাগলেও গৌতম গম্ভীর, যাঁকে বছরের শুরুতে ওয়ানডে বিশ্বকাপের  দলে রাখা হয়নি, ফাইনালের মঞ্চে নিজের জাত চেনাতে ভুল করেননি।

ইনসাইড আউট শটটা বরাবরই দারুণ খেলেন গম্ভীর, সেদিন যেন ইনসাইড আউট শটের ঝাঁপি খুলে বসেছিলেন.. জীবনের মতো দামি ৫৪ বলে ৭৫ রানের গৌতির ইনিংস টা ভারতকে ১৫৭ তে পৌঁছে দিলো, যার মধ্যে শেষের দিকে রোহিতের আবার ৩০ রানের একটা ঝলক ছিল।

ব্যাট করতে নেমে ইরফান পাঠানের অনবদ্য বোলিংয়ে উইকেট হারাতে হারাতে এক সময় পাকিস্তানের যখন চার ওভারে দরকার ৫৪ রান, হাতে মাত্র ৩ উইকেট। তখন আবার সেই কুম্ভের মতো দাঁড়িয়ে মিসবাহ উল হক। নাটকের শেষ অংক তখনো বাকি ছিল! মিসবাহ আর সোহেল তানভীরের ছক্কাবৃষ্টি পাক সমর্থকদের মনে যখন আশার আলো জাগাচ্ছে, তানভীর আর গুলের স্ট্যাম্প ছিটকে দিলেন শ্রীশান্ত, রুদ্রপ্রতাপ।

ভারতের জয় আর হারের মাঝে আবারও সেই মিসবাহ, প্রথম ম্যাচের মতোই, টেনশন টেনশন! ডাগআউটে দেখা গেল দু’দলের খেলোয়াড় আর সাপোর্ট স্টাফ দের প্রার্থনায় মগ্ন, চমক তখনো বাকি, শেষ ওভারে পাকিস্তানের জিততে ১৩ রান বাকি ধোনি বল তুলে দিলেন অনামী যোগিন্দর শর্মার হাতে।

রোহিত শর্মা দেখিয়ে দিয়েছেন আগেই, এ শর্মা কি করবেন! প্রথম বল টাই বিশাল ওয়াইড, কমেন্ট্রি বক্স থেকে ভেসে আসছে শাস্ত্রীয় কণ্ঠস্বর ‘হি ফিলস দ্য প্রেশার, বিগ ডিসিশন ফর ধোনি!’ এক বল পরেই মিসবাহর বিশাল ছক্কা যোগিন্দরের ফুলটসে, পাকিস্তান ক্যাম্প জয় পাওয়ার আগাম বুনো উল্লাসের প্রস্তুতিতে, কিন্তু ভাগ্য দেবী বোধহয় অলক্ষ্যে হাসছিলেন, ধোনি কানে কানে কি যেন মন্ত্র গুঁজে দিলেন যোগিন্দরের!

সেই মন্ত্রবলে কিনা জানা নেই জয়ের থেকে ৪ বলে ৬ রান দূরে থাকা অবস্থায় মিসবাহর মাথায় কি চাপলো, যোগিন্দরের আপাত নিরীহ বল স্কুপ করে তুলে দিতে গেলেন! বলটা শ্রীশান্থের হাতে জমে যেতে জন্ম নিলো কুড়ি বিশের প্রথম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারত!

হ্যাঁ, সেই দলটাই যাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি ছিল শূন্য, দেশের ক্রিকেটে যখন উথাল পাথাল অবস্থা, নতুন অধিনায়কের হাতে কিছু তরতাজা তরুণ কে পাঠিয়ে দিয়েছেন নির্বাচকরা বিশ্বমঞ্চে, যাদের নিয়ে কেউ কোনো আশাই করেননি ১৯৮৩-এর কপিলদের মতো, তারাই বিশ্বমঞ্চে নিজেদের কে মেলে ধরলো প্রানপনে। আর হ্যাঁ, একজনের কথা না বললেই নয়, অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি!

বিশ্বজয়ের পর ধোনির মুষ্টিবদ্ধ হাতের সেলিব্রেশনটা ছিল না কোনো ঔদ্ধত্বের প্রতীক, সেটা ছিল এক নতুন স্বপ্নের সোপানের প্রতীক, যার মধ্যে পরবর্তী কয়েক বছরের ভারতীয় ক্রিকেটের নিরাপদ হাতের প্রতিবিম্বও ছিল লুকিয়ে। বাজিগর তো এদেরই বলে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link