More

Social Media

Light
Dark

খলনায়ক থেকে কিংবদন্তি

মিসবাহ উল হকের ক্যারিয়ার হাইলাইটসে ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের চিত্র সবসময় ভেসে উঠে। ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল ম্যাচের টানটান উত্তেজনায়, মনোবল না হারানো একজন ছিলেন তিনি। ডুবে যাওয়া ম্যাচ কে তীরের কাছাকাছি নিয়ে এসে, করে বসলেন ভুল। যোগিন্দর শর্মার গুড লেন্থের বল কে প্যাডেল সুইপ করে শর্ট ফাইন লেগে শ্রীশান্তের হাতে ক্যাচ দিয়ে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্যর্থ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ততক্ষণে গ্যালারিভর্তি ব্লু আর্মিদের উল্লাস ও ডাগআউটে থাকা খেলোয়াড়দের বিচরণে ভারতের বিজয়োল্লাস সবকিছুকে ছাড়িয়ে।

ফাইনাল ম্যাচের ব্যর্থতার পর দল থেকে ছিঁটকে পড়েন মিসবাহ। সমালোচনার প্রতিটি তীর বিদ্ধ হয়েছিলো তার দিকে। অগোছালো ম্যাচকে গুছিয়ে নিয়েও ভুল শটে দলের ভাগ্য পুড়িয়েছেন। পাশাপাশি নিজে নায়ক হওয়ার আশায়ও জল ঢেলেছিলেন পুরোপুরি। পাকিস্তানীদের ঘৃণার চোখ আশ্রয় নেওয়া মিসবাহ যেন দুঃস্বপ্নে বিচরণ করতে থাকলেন। একই বছর অনুষ্ঠিত হওয়া পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপে, দলের করুণ পরিণতির দু:খের বুকে সুখের প্রলেপ দিতে গিয়ে তীরে এসে তরী ডুবিয়ে; দু:খের মাত্রা দ্বিগুণ করে দিয়েছিলেন।

মিসবাহ ডুবেছিলেন জাতীয় ঘৃণার ঘোর অন্ধকারে। কিন্তু নিয়তি যে বড়ই বৈচিত্র্যময়। কখন, কোথায় কাকে নিয়ে যায় বলা মুশকিল। এর স্পষ্ট উদাহরণ মিসবাহ উল হকের পরবর্তী ক্রিকেট ক্যারিয়ারেই প্রমাণিত হয়। আজ তা নিয়েই আলোকপাত করবো। অনেকের মাঝেই একটি ভুল ধারণা বিদ্যমান। সেটা হলো — মিসবাহ অনেক দেরিতে জাতীয় দলে এসেছেন। তা আসলে সঠিক নয়। মূলত মিসবাহ’র পাকিস্তান জাতীয় দলে অভিষেক টেস্ট ক্রিকেটের মাধ্যমে ২০০১ সালের আট মার্চ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে, ইডেন পার্কে।

ads
সেই ফাইনাল

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শুরু যাত্রায় মিসবাহ তেমন একটা সুবিধে করতে পারেননি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পাঠ আত্মস্থ করতেই তাকে ব্যাপক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। ব্যাট হাতে রানের দেখা পেতেই পাড়ি দিতে হয়েছে বহু বন্ধুর পথ। এ পথে কেবল কাঁটার দেখাই পেয়েছিলেন। ২০০১ সালে অভিষেকের পর ২০০৩ পর্যন্ত পাকিস্তানের হয়ে পাঁচটি টেস্টে মাঠে নেমেও দেখা পাননি কোনো অর্ধশতকের। ফলশ্রুতিতে দল থেকে তার নাম কাটা যায়।

একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেকের ঠিক পরের বছর। একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষেই, তবে এবার ঘরের মাঠে। ২০০২-০৪ পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে ১২ ম্যাচে মাঠে নেমে অর্ধ শতক হাঁকিয়েছিলেন দুটি। মোটামুটি ৩০ এর কাছাকাছি গড়ে রান করেও দলের বাইরে ছিলেন প্রায় তিন বছর।

২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবারো ফিরে আসেন মিসবাহ। মিডল ও লোয়ার অর্ডারে দেখা যেতো তাকে। দলের মধ্য ইনিংসে হাল ধরার দায়িত্বের পাশাপাশি স্লগে দ্রুত রান বের করার দায়িত্বও তার কাঁধে বর্তায়। সে বছর মাঝারি মাপের ইনিংস খেলে দলে টিকে ছিলেন। পরিপক্ব হওয়ার জন্য সময় নিচ্ছিলেন। বাইশ গজের সাথে সখ্যতায় মেতে উঠতেই তিনি ৩৩ বছর বয়সেও দলে ফেরত এসেছিলেন ঘরোয়া লিগে দাপুটে নৈপুণ্য প্রদর্শন করে।

এরপরের বছরগুলোতে জাতীয় দলে তিনি অপরিহার্য সদস্য বনে যান। দল কে চাপের মুখে সঙ্গ দেওয়া, প্রতিপক্ষের বোলারদের উপর চড়াও হওয়া, দলের ইনিংস মেরামত, জুনিয়রদের অনুপ্রাণিত করা। সবকিছুই তিনি করেছেন। মাঝে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য সমালোচিত হলেও, দলে ফিরে এসে পুনরায় চমক দেখান। ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইম্প্যাক্টফুল কিছু ইনিংসের জন্ম দিয়ে পাকিস্তানের শিরোপা উদ্ধার করান। শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ে স্বাদ লাভ করে।

ক্রিকেটে যতদিন পার করেছেন, ততদিন শুধু নতুন নতুন রেকর্ডে নিজের নাম বসিয়ে গেছেন। বয়স কোনো বাঁধা নয়! প্রমাণ করেছেন প্রতি ম্যাচেই। ২০১০ সালের বিতর্কিত ইংল্যান্ড সফরে দলে স্থান পাননি। কিন্তু অধিনায়ক সালমান বাট, আসিফ ও আমিরের স্পট ফিক্সিংয়ের পর তাকেই আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত হওয়া দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে তাকে অধিনায়কত্ব দেওয়া হয়। পিসিবির এমন সিদ্ধান্তে অনেকেই নাখোশ ছিলেন।

মিসবাহ কে অধিনায়কত্ব দেওয়ার পর যারা নাখোশ ছিলেন, তাদের সবার ভুল ধারণা ভেঙে দেন মিসবাহ। তার নেতৃত্বে পাকিস্তান ৫৬ টেস্টে মাঠে নেমে ২৬ টি জয়লাভ করে। ১৯ পরাজয়ের পাশাপাশি রয়েছে ১১টি ড্র। এবং তার নেতৃত্বেই ১৯৮৮ সালের পর পাকিস্তান প্রথমবারের মত টেস্টে র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থান দখল করে নেয় ২০১৬ সালে।

পাকিস্তানের সফলতম টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকে। এমনকি ইমরান খানের পর তাকেই সবচেয়ে বেশি সম্মান প্রদান করা হয় অধিনায়ক হিসেবে। অর্জনের দিক দিয়ে সরফরাজ চ্যাম্পিয়ন’স ট্রফি জয়ী অধিনায়ক হলেও, মিসবাহ কেই পাকিস্তানের নতুন দিনের সূচনাকারী নেতা মানা হয়।

২০১১ বিশ্বকাপ আফ্রিদির নেতৃত্বে খেলে পাকিস্তান। মিসবাহ সেখানেও সমালোচিত হয়েছিলেন সেমিতে ভারতের বিপক্ষে স্লো ব্যাটিংয়ের জন্য। বিশ্বকাপের পর আফ্রিদির কাছ থেকে অধিনায়কত্ব নিয়ে দেওয়া হয় মিসবাহ কে। পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক ইমরান খান ও মিসবাহ একে অপরের কাজিন। এবং পাকিস্তানের ইতিহাসে অধিনায়কত্বেও একজনের পরেই অপরজনের অবস্থান। ইমরান খানের অধিনায়কত্বে ওডিআই তে জয়ের হার প্রায় ৫৪ এবং মিসবাহ’র ৫১। পাকিস্তানের ধারাবাহিক জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছিলো মিসবাহ’র অধিনায়কত্ব।

তার নেতৃত্বে পাকিস্তান আইসিসির কোনো ট্রফি না জিতলেও, টেস্ট ক্রিকেটের শীর্ষস্থান ঠিক-ই হাসিল করেছিলো। ব্যক্তিগত অর্জনেও মিসবাহ ছিলেন রঙিন। ২০০৭ সালে টেস্টে ভারতের বিপক্ষে অপরাজিত ১৬১ রানের ইনিংসটি ইএসপিএন ক্রিকইনফোর দর্শক জরিপে তৃতীয় বর্ষসেরা ইনিংস হিসেবে নির্বাচিত হয়। দল কে জেতাতে ব্যর্থ হলেও, একই বছরের ক্রিকইনফোর টি-২০ বিশ্বকাপের সেরা একাদশেও তিনি ছিলেন।

২০১৩ সালে ওয়ানডেতে এক ক্যালেন্ডারে ১৩৭৩ রান সংগ্রহ করে ক্যারিয়ার সেরা র‍্যাংকিং ৭ম অবস্থানে জায়গা করে নেন তিনি। রান সংগ্রহে পেছনে ফেলেন ভিরাট ও হাফিয কে। সে বছর সর্বাধিক ১৫ টি অর্ধশতকের রেকর্ডও করেন। পাশাপাশি এক ক্যালেন্ডারে ওডিআইতে তৃতীয় সর্বোচ্চ ছক্কা হাঁকান তিনি। মিসবাহ সর্বদাই ইএসপিএন ক্রিকইনফোর সুনজরে ছিলেন। সে বছর চ্যাম্পিয়ন’স ট্রফিতে পাকিস্তান বিদায় নিলেও মিসবাহ ক্রিকইনফোর টিম অফ দ্য টুর্নামেন্টে জায়গা পাওয়ার পাশাপাশি অধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

আবুধাবিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টে, টি-টোয়েন্টি মেজাজে ৫৬ বলে শতক হাঁকিয়ে তাক লাগিয়ে দেন ক্রিকেট বিশ্বকে। দ্রুততম শতকে ভিভ রিচার্ডস পাশে নিজের নাম লেখান মিসবাহ। দু’জনেই করেছিলেন সমান ৫৬ বলে শতক। ২০১৬ তে লর্ডসে সবচেয়ে প্রবীণ ক্রিকেটার হিসেবে শতক হাঁকান।

৪২ বছর দুই মাস বয়সী মিসবাহ সবশেষ ৮২ বছরে সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি লর্ডসে শতক হাঁকানো দের মধ্যে। টিমমেট দের স্যালুট দেওয়ার পাশাপাশি, মাঠে দশটি পুশ-আপ দিয়ে অদ্ভুত এক শতক উদযাপন করেন মিসবাহ। পরবর্তীতে তিনি জানান, ‘অ্যাবোটাবাদের সেনা ক্যাম্পের সদস্যদের সম্মানার্থে তিনি এই উদযাপন করেন, যেখানে তারা সেনাবাহিনীর নিয়মে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলো।’

দলে সবচেয়ে প্রবীণ ক্রিকেটার হয়েও, অধিনায়ক হিসেবে মিসবাহ সবসময়েই ছিলেন একজন তরুণ। ঠান্ডা মস্তিস্কের একজন নেতা। মাঠের পরিস্থিতি তিনি বেশ দারুণ আঁচ করতে পারতেন। তার চমৎকার নেতৃত্বে পাকিস্তান টেস্টে শীর্ষস্থান দখল করার পর পিসিবি প্রধান শাহরিয়ার খান ও কোচ ওয়াকার ইউনুস সকল কৃতিত্ব মিসবাহ কে প্রদান করেন। একসময়ের বিশ্বকাপ হারার দায়ভার নিয়ে ধীরেধীরে খলনায়ক থেকে নায়ক-ই বনে গেলেন মিসবাহ।

২০১৫ বিশ্বকাপের পর রঙিন পোশাকের ক্রিকেট থেকে বিদায় নেন। কিন্তু ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর রঙিন পোশাকে দলের নড়বড়ের অবস্থানের ফলে তাকে পুনরায় দায়িত্ব নেওয়ার আহবান জানানো হলেও তিনি তা আর গ্রহণ করেননি।

টেস্ট ক্রিকেট থেকেও ২০১৭ সালে অবসরে যান। যার ফলে পুরোদস্তু মাঠের ক্রিকেট থেকে নিজের নাম সরিয়ে ফেলেন মিসবাহ। উইন্ডিজের মাঠে সেবার ২-১ সিরিজ জেতে পাকিস্তান। উইন্ডিজের মাটিতে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের নেতৃত্বও দিয়েছিলেন মিসবাহ। অর্থ্যাৎ, ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজেও আরেক রেকর্ড গড়ে দিয়ে যান তিনি দল কে।

জাতীয় দলের বাইরে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে তার ছিলো অবাধ বিচরণ। পাকিস্তান ক্রিকেটের বাইরেও ক্রিকেটবিশ্বের বিভিন্ন ফ্রান্সাইজ লিগে তিনি দাপটের সাথেই খেলেছেন। আইপিএল, সিপিএল, বিপিএল, এসএলপিএল সব লিগেই নিজের নাম লিখিয়েছিলেন। শুধু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য খেলতে পারেননি কাউন্টি ক্রিকেট।

অবসরের বছর দুয়েক পর ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখ পাকিস্তানের প্রধান কোচ এবং একইসাথে প্রধান নির্বাচকের দায়িত্বও তিনি লাভ করেন। তিন বছর মেয়াদে তাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রধান নির্বাচকের পদ থেকে তিনি সরে দাঁড়ান।

কোচ হিসেবে এখন পর্যন্ত বড় কোনো সফলতা তার মাধ্যমে পাকিস্তান ক্রিকেট আসেনি। খেলোয়াড় হিসেবে ধুঁকে ধুঁকে শুরু করেও, শেষবেলায় তিনি হয়েছেন তরুণদের জন্য একজন আদর্শ ক্রিকেটারের উদাহরণ। সেভাবেই হয়তো তিনি কোচ হিসেবে দ্যুতি ছড়াবেন সময়ের পরিক্রমায়।

শেষ করছি, এই মেধাবী ক্রিকেটারের আরেকটি দারুণ রেকর্ডের কথা উল্লেখের মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মিসবাহ’র ব্যাটিং গড় টেস্ট ও ওয়ানডেতে যথাক্রমে ৪৬ ও ৪৩। কিন্তু মজার বিষয় হলো — মিসবাহ একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি ওয়ানডেতে  সর্বাধিক পাঁচ হাজারের উপর রান করেও দেখা পাননি কোনো সেঞ্চুরির। সেঞ্চুরি না করেও তিনি এই ফরম্যাটের একজন কিংবদন্তি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link