More

Social Media

Light
Dark

হৃদয়ে কেউ কেউ থেকেই যান

বেলো হরিজেন্তে এমনিতে খুব শান্ত শহর। রিও বা ব্রাজিলের অন্যান্য শহরের মত ঝকমকে নয়। আলোর রোশনাই খুব একটা পাওয়া যাবে না। সেখানেই ম্যাচ শেষে দর্শকাসনে হাতের তালুতে মুখ ঢেকে বসে আছে এক প্লেয়ার। কিছুক্ষণ পর উঠে এল, দাভিদ লুইজের কান্নাভেজা শরীরটাকে বুকে আগলে নিয়ে গোটা মাঠের উদ্দেশ্যে একটা হাততালি ছুঁড়ে দিল। লজ্জার পরাজয়ের পর যখন ব্রাজিল টিম মাঠ ছাড়ছে, বেলো হরিজেন্তেতে নেমে এসেছে ঘোর দু:স্বপ্নের রাত।

অথচ এমনটা নাও হতে পারত। ব্রাজিলের ট্র্যাজেডি ইতিহাসে আরও একটা বেদনার পাতা হয়তো নাও লেখা হতে পারত। ব্রাজিলিয়ানদের একটা বড় অংশ আজও মনে করে, সেদিন মাঠে থিয়াগো সিলভা থাকলে প্রথম টাচেই মুলার ফাঁকা গোলে বল ঠেলতে পারে না। থিয়াগো সিলভা ওদের কাছে একটা বিশ্বাসের নাম। যেটা ক্রমেই বাড়তে বাড়তে অচিরেই বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। থিয়াগো সিলভা একটা ভরসার নাম। সেদিন কার্ড সমস্যায় এই থিয়াগো সিলভাই খেলতে পারেনি, নেয়মার-থিয়াগো বিহীন ব্রাজিলের রিওতে ফাইনালের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে তাই খুব বেশি দেরি হয়নি।

ব্রাজিলের ডিফেন্সে মহাতারকাদের উত্থানের পাশাপাশি কিছু এমন মানুষ এসেছে, যাদের লড়াইটা স্বতন্ত্র। নিজের সাথে, চারপাশের পরিবেশের সাথে লড়াই। ক্রমাগত আলোছায়ার সঙ্গে লড়াই করতে করতে একটা সময় নিজেকে আবিস্কার করে সে আগলে রেখে দেয় বাকি সবকিছু। থিয়াগো সিলভা সেরকমই। লুসিওর উত্তরসূরি। লুসিওর মতোই যার কড়া ট্যাকলের মধ্যে কোনও সৌন্দর্য্য নেই, অহেতুক দেখনদারি নেই।

ads

গোটা ক্যারিয়ারে লুসিও মাত্র একটা রেড কার্ড দেখেছেন, থিয়াগো সিলভা তাও দেখেননি। অথচ দু’জনেই সেন্টারব্যাক। বাকিরা বলের পেছনে ছুটলে থিয়াগো একা কুম্ভ হয়ে রক্ষণে টহল দিতে থাকেন। ডানদিক থেকে দানিলো, বাঁ-দিক থেকে মার্সেলো,রেনেতোরা বল নিয়ে ওভারল্যাপের সময় থিয়াগো নিচে পাহারায় থাকেন, যাতে কোনওভাবেই কোনও ছোট্ট ভুলে লক্ষ্মীন্দরের ঘরের ছিদ্র দিয়ে কালনাগিনী না ঢুকে পড়ে।

রবার্তো কার্লোসের মত স্টার ইমেজ নেই, মাইকনের মত জিরো ডিগ্রি থেকে গোল নেই, তবু থিয়াগো সিলভা আলাদা। একেবারে আলাদা। মিলান থেকে প্যারিস হয়ে লণ্ডন যার যাত্রাপথ। যার প্রতিটা পথে লুকিয়ে রয়েছে অসংখ্য লড়াই। নিজের অস্তিত্বের সাথে, নিজের প্রতিভা আর ডিফেন্সের সাথে। থিয়াগো সিলভা মালদিনি হতে পারেনি, সান সিরোর ঘাস তিন বছর পর গুডবাই করে দিল।

প্রেমের শহরে আট বছর থেকেও প্রেম ভেঙে গেল, প্যারিসের ডিফেন্সে আইফেল টাওয়ারের মত দাঁড়িয়ে থাকা অধিনায়ক থিয়াগোর প্রেমের সমাপ্তি ল্যাম্পার্ডের একটা ডাকে। স্ট্যামফোর্ড ব্রিজের ভালবাসার ডাক থিয়াগো উপেক্ষা করতে পারেনি। যেমন পারেনি ল্যাম্পার্ডের প্রস্থান আর টুখেলের আগমনের মাঝে ক্লাবের মধ্যে চলা অসন্তোষকে সাইডে ফেলে দিতে।

থমাস টুখেলকে বুকে জড়িয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কাপে চুমু খায় থিয়াগো, যা প্যারিস দিতে পারেনি। আসলে যাযাবরদের জীবনটা খুব অনিশ্চিত, কোনও চাওয়া-পাওয়ার হিসেব দিয়ে মাপতে যাওয়াটা বোকামি। নেইমার-ইব্রাহিমোভিচরা গোল করে, মাইকন-মার্সেলো-দানিলো কাফু-দানি আলভেসদের মত উপরে উঠে যায় ওভারল্যাপে, থিয়াগো অবিচল থাকেন রাতে নাবিককে পথ দেখানো শেষ লাইট হাউসের মত। টিমটিম করে জ্বলে, আধো-অন্ধকারে ঠাওর না করা গেলেও একটা সংকেত মেলে, কেউ আছে।

কনফেড কাপ, কোপা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, সিরি এ, লিগা ওয়ান সহ বহু ট্রফি থিয়াগো পেয়েছে। তবু এক জায়গায় তার মন বসে না। প্যারিস ভালবাসার সংজ্ঞা বোঝালেও না, মিলান স্থায়ী বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিলেও না। আসলে আজাদ পাখিরা এক খাঁচায় থাকে না। আর্জেন্টিনার কাছে কোপা ফাইনাল হারে যেমন তা বদলাবে না কিছুতেই। তবে বয়স হচ্ছে যাযাবরের, আগের মত বলের কাছে ছুটে স্লাইডিং ট্যাকল বহুদিন হল অস্তাচলে – এখন শুধু পরিবারের বড় সদস্যের মত সবকিছু আগলে রাখা, যতটা পারা যায় সাধ্যের বাইরে গিয়েও।

থিয়াগো তাই আজন্ম ক্যাপ্টেন, বর্ন ক্যাপ্টেন। একে একে নিভছে দেউটি, থিয়াগোও নিভবেন কোনও এক মনখারাপিয়া সময়, রেখে যাবেন আর্মব্যাণ্ড পরের প্রজন্মের হাতে পরিয়ে দেওয়ার জন্য। ভঙ্গুর সাম্রাজ্যের শেষ প্রতিনিধি থিয়াগো, যিনি ভাল করে জানেন সমালোচকদের ড্রয়িংরুমে একটা ট্যাকল মিস, একটা বল পায়ের ফাঁক দিয়ে গলে যাওয়াটা যেভাবে ভিঞ্চির আর্টের মত সাজিয়ে রাখা হয়, তার আগে বা পরে কত ট্যাকল চাপা পড়ে যায় একটা ভুলের ঢাকনায়। থিয়াগো সন্ত্রস্ত, থিয়াগো সংযত অথচ থিয়াগো লড়াকু। ব্রাজিলের তাবড় সুপারস্টারদের ভিড়ে বেমানান এক নিশ্চুপ সেনাপতি।

থিয়াগো সিলভা অনুপ্রেরণা। ট্র্যাজিক নায়ক-টায়কের মত ভারী শব্দের বাহক নয়। মধ্যবিত্তের প্রতিদিন লড়াইয়ের রসদ, আত্মবিশ্বাসের উপকরণ। থিয়াগো সিলভা বিশ্বাসের নাম, ভরসারও বটে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link