More

Social Media

Light
Dark

প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ইংলিশ ক্রিকেটার কিংবা এক ফুটবল কোচ

বারবাডোজের আর দশটা খেটে খাওয়া পরিবারের ছেলের মতোই একটা কিশোর ছিলেন তিনি।

পরিবারে এক গাদা মানুষ। আয়ের উৎস বলতে বাবা ও ঠাকুমার হাড়ভাঙা খাটুনি। বাবা ছোট একটা চাকরি করতেন। আর ঠাকুমা রোজ সকালে মাথায় করে সবজি নিয়ে যেতেন বাজারে। ঠাকুমার পেছন পেছন হাটতে থাকা ছেলেটি দেখতো মাঠে মাঠে চলছে ক্রিকেট।

চোখ বড় বড় করে ছেলেটা স্বপ্ন দেখতো টেস্ট ক্রিকেট খেলার। স্বপ্ন দেখতো একদিন সে কেনসিংটন ওভালে মেরুন টুপি পরে ব্যাট করতে নামবে। স্বপ্নপুরণ হয়েছিলো তাঁর।

ads

১৯৮১ সালের ১৩ মার্চ বারবাডোজের হোম গ্রাউন্ড কেনসিংটন ওভালেই অভিষেক হলো তাঁর। কিন্তু সামান্য একটু ‘টুইস্ট’ হয়ে গেছে এর মধ্যে। দল বদলে গেছে। অভিষেক ম্যাচে মাঠে নামার সময় তাঁর মাথায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের মেরুন ক্যাপ ছিলো না। বরং সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বুকে থ্রি লায়ন আকা জার্সি পরে টেস্ট খেলতে নামলেন তিনি।

সাথে সাথে একটা নতুন ইতিহাস হয়ে গেলো।

হ্যাঁ, ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা প্রথম কালো ক্রিকেটার হয়ে গেলেন রোল্যান্ড বুচার। বুচারের জীবনে বলার মতো কীর্তি এই একটাই নয়। বুচার হলেন বিশ্বের ইতিহাসের একমাত্র আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটার, যার উয়েফা প্রো ফুটবল কোচিং লাইসেন্স আছে এবং তিনি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দলের সাথে কাজও করেছেন। আবার সেই বুচারই এখন আবার ক্রিকেট কোচ হিসেবে ফিরে এসেছেন। সবমিলিয়ে তাঁর পরতে পরতে ইতিহাস।

এই ইতিহাসের শুরুটা হলো বুচারের বাবা ভাগ্যান্বেষণে ইংল্যান্ডে চলে আসার পর থেকে। তখন বুচারের বয়স ১৩।

বুচারকে ছোটবেলায় ‘বাফি’ বলে ডাকা হতো। কারণ তার প্যান্টের পকেটে সবসময় একটা বল থাকতো; সেটা ফুলে থাকতো বাইরের দিকে। ‘বাফড আউট’ থেকে এসেছিলো বাফি নামটা।

রোল্যান্ড বুচারের সাথে ক্রিকেটের একটা সম্পর্ক ছিলোই। তার চাচা (বা মামা) ছিলেন বাসিল বুচার; ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ৪৪ টেস্ট খেলা বিখ্যাত ক্রিকেটার। রোল্যান্ড নিজে শৈশবে বারবাডোজের কিছু গ্রেট ব্যাটসম্যানের কাছে আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এতো কিছুর পরও বুচারের প্রথম প্রেম ছিলো ফুটবল। আর ইংল্যান্ডে এসে ফুটবলই খেলবেন, এমন পরিকল্পনা করছিলেন।

বুচারের পরিকল্পনা বদলে গেলো। স্থানীয় স্টিভানেজ ক্রিকেট ক্লাবের তৃতীয় একাদশের খেলা ছিলো সেদিন। তাদের একজন খেলোয়াড় কম ছিলো। ফলে ব্যাটসম্যান বুচারকে অনেকটা জোর করে নামিয়ে দেওয়া হলো। তিনি মনে করতে পারেন যে, ‘ডজন খানেক’ রান করেছিলেন। তাতেই তার মধ্যে সম্ভাবনা দেখেছিলো ক্লাবটি। পরের সপ্তাহে তাকে আবার আসতে বলা হলো।

এভাবে বুচার ক্রিকেটের সাথেই জড়িয়ে গেলেন। খুব দ্রুত ক্লাবের প্রথম একাদশে চলে এলেন। এরপর গ্লুস্টারশায়ার যুব কার্যক্রমে যুক্ত হলেন। আর আলোচনায় এলেন এমসিসির ‘ইয়ং প্রফেশনাল ক্রিকেটার’ কোর্স করতে গিয়ে তার ওপর চোখ পড়লো মিডলসেক্সের। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ১৯৭৪ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত টানা খেলে গেছেন মিডলসেক্সের হয়ে।

এই কাউন্টি দলের হয়ে পারফরম্যান্সে তাকে আর অবহেলা করার সুযোগ ছিলো না। তিনি তখন কাউন্টি ক্রিকেটের অন্যতম শীর্ষ রান সংগ্রাহক। এর স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮১ সালে ইংল্যান্ড দলে ডাক পেয়ে গেলেন। অভিষেকও হয়ে গেলো। তিনটি টেস্ট খেলে ফেললেন; তিনটিই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। রান করতে পেরেছিলেন সাকল্যে ৭১।

বোথামের সমসাময়িক খেলোয়াড় ছিলেন বুচার। একসাথে ফুটবল, ক্রিকেট দুটোই খেলেছেন। বুচার মনে করেন, তিনি বোথামের চেয়ে অনেক ভালো ফুটবলার ছিলেন, ‘বোথাম নিজেকে ভালো ফুটবলার মনে করতো। ও আসলেই ভালো ব্যাটসম্যান বা বোলার ছিলো। কিন্তু আমি ওর চেয়ে ফিল্ডার বা ফুটবলার হিসেবে ভালো ছিলাম।’

প্রায় একই সময়ে ওয়ানডে খেলেছেন তিনটি। অভিষেক ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩৮ বলে ৫২ রানের ইনিংস খেলেন। ক্যারিয়ারটা এখান থেকে অনায়াসে আরও বড় হতে পারতো। কিন্তু ইনজুরি তাকে এই সোনালী সময়টায় খেলার বাইরে রেখে দিলো অনেকটা সময়।

ইনজুরি থেকে ফেরার পর সেই সোনালী ফর্মটা আর খুজে পাননি। ১৯৮৩ সালে জাতীয় দলে ফেরার আরেকটা সম্ভাবনা তৈরী হয়েছিলো। সে সময়টাও দারুন ফর্মে ছিলেন। কিন্তু ইংল্যান্ড দল ঘোষনার দু দিন আগে চোখের নিচে আবার বলের আঘাত পান। ফলে এই দফা আর ফেরা হলো না। স্বপ্ন এখানেই শেষ। তারপরও ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কাউন্টি খেলা চালিয়ে গেছেন। আর এরপরই আরেকটা ইতিহাস করে ফেললেন।

১৯৮৯ সালে মাইক গ্যাটিংয়ের নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিদ্রোহী সফরে যাওয়াটা একরকম নিশ্চিত ছিলো। কিন্তু প্রবল মিডিয়ার প্রতিক্রিয়ায় সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। বিশেষ করে এক ভক্ত তাকে ‘জুডাসের’ সাথে তুলনা করে চিঠি লেখায় প্রবল ধাক্কা খেয়েছিলেন বুচার। পরে সাক্ষাতকারে বলেছেন যে, তিনি জুডাস হতে চাননি।

৩৭ বছর বয়সে ক্রিকেট ছাড়ার পর নিজেকে পুরোদস্তুর ফুটবলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবলেন বুচার। এই বয়সে তো আর খেলা শুরু সম্ভব না। তাই কোচিংকে বেছে নিলেন। উয়েফা প্রো লাইসেন্স কোর্স শুরু করলেন। আর এখানেই পেলেন বন্ধু ব্রেন্ডন রজার্সকে।

হ্যা, লিভারপুলের সাবেক কোচ রজার্স, হোসে মরিনহোর সাবেক সহকারী রজার্স এবং বর্তমানে লিস্টার সিরিটর কোচ রজার্স।

বুচার ও রজার্স একসাথেই প্রো লাইসেন্স পেলেন। রজার্সের যেহেতু ভালো ফুটবল ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলো, তাই তিনি খুব দ্রুত প্রিমিয়ার লিগের দলগুলোর সাথে কাজ শুরু করলেন। বুচারও বসে ছিলেন না। তিনি আর্সেনালের স্কুল প্রোগ্রামে কোচ হিসেবে কাজ করলেন প্রায় দশ বছর। এর মধ্যে রজার্স নিয়োগ পেলেন রিডিং ক্লাবের প্রধাণ কোচ হিসেবে। আর এখানে এসে রজার্স স্মরণ করলেন পুরোনো বন্ধু বুচারকে। নিজের সহকারী হিসেবে ডেকে নিলেন তাকে।

গল্পটা এখান থেকেই অন্যরকম হতে পারতো। রজার্সের সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করা বুচার এরপর অনায়াসে প্রিমিয়ার লিগের কোনো ক্লাবের দায়িত্ব পেয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু এবার জীবনের আরেকটা রূপ দেখলেন বুচার-গায়ের রংয়ের কারণে পিছিয়ে পড়তে শুরু করলেন।

বুচার নিজে বলেছেন, ‘ব্রেন্ডনকে তখন হঠাৎ হোসে (মরিনহো) চেলসিতে ডেকে নিলো। ব্রেন্ডন চলে যাওয়ার পর আমি কিছুদিন চলে বেড়ালাম। কিন্তু দ্রুতই বুঝতে পারলাম যে, আমাকে কেউ কোচিংয়ের কাজ দেবে না। একজন কালো কোচ হিসেবে আমি কিছুতেই কাজ পাচ্ছিলাম না। ইংল্যান্ড দল ও লিগে খেলা কালো কোচরাই কাজ পায় না। আর আমি তো ক্রিকেট থেকে আসা একজন কালো মানুষ। আমি কাজ আশা করি কীভাবে!’

বুচার ফুটবলে আর ভাগ্য গড়তে পারেননি। আবার ক্রিকেটে ফিরে এলেন। ক্রিকেট কোচিং শুরু করলেন। বড় কোনো দল পাননি। ২০০০ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রধান কোচ হওয়ার জন্য ইন্টারভিউতে ডাক পেয়েছিলেন; চাকরিটা হয়নি। পরে বারমুডা দলের দায়িত্ব নিয়েছেন। এখন এইসব ছোট দলেই কাজ করে দিন কাটছে।

সম্প্রতি আবার আলোচনায় এসেছেন ‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার’ আন্দোলনের পর কথা বলে। বুচার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন তিনি কালো না হলে আজ প্রিমিয়ার লিগের কোনো দলের দায়িত্বে থাকতে পারতেন। বর্নবাদ ইংল্যান্ডে প্রবল থাবা বিস্তার করে আছে বলেই তার বিশ্বাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link